English Version
আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর, ২০২০ ১০:২১

আমার স্বামীকে এখনও ভীষণ ভয় পাই!

অনলাইন ডেস্ক
আমার স্বামীকে এখনও ভীষণ ভয় পাই!

দেড় বছর আগে এক দুপুরে স্বামীর মারের ভয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম আমি। হ্যাঁ আমিই। এই মহুয়া ভট্টাচার্য, যে একটু ছুঁতো পেলেই কথায় পিষে মারি পুরুষদের, পোস্টে সাড়ে সাত হাত বাঁশ দিতে ছাড়ি না। আমি আমার স্বামীকে ভয় পাই। এখনও, ভীষণ। তিনি একটি আতঙ্কের নাম আমার কাছে। এক কাপড়ে শূন্য হাতে সিএনজিতে উঠে চলে গিয়েছিলাম আকতারী আপার বাসায়। নেমে সিএনজি ভাড়াও দিয়েছি তার কাছ থেকে নিয়ে। 

একটা চাকরি পাবার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেছি দ্বারে দ্বারে। যার কাছেই বলতাম, সেই বলত আপনার তো অনেক পরিচিত!  তাদের বলুন না! শেষে চাকরি মিলল। যিনি চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন, তিনি এই সমাজের চোখে সুশীল, প্রগতিশীল ইত্যাদি ইত্যাদি নামে আপনারা যাদের অবিহিত করেন তাদের কেউ নন। তার কথা আলাদা করে বলব একদিন।

চাকরির ইন্টারভ্যিউতে কেউ আমাকে পছন্দ করেননি। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া নেই আমার, তার ওপর যেদিন  সাক্ষাৎকার দিতে গেলাম, সেদিন আমার মুখের বামদিকে কপাল থেকে চিবুক পর্যন্ত কুচকুচে কালো হয়ে আছে আমার স্বামীর শাসনের নমুনায়। রিসেপশনে এমন ত্রুটিপূর্ণ মুখ গ্রহণযোগ্য না। কিন্তু আমার তো চাকরি দরকার, ভীষণ দরকার একটি চাকরি। 

আমার কম্পিউটার জানা নেই, দেখতে ভালো নই এসব দায় নিয়েও চাকরির জন্য হন্যে হয়ে পড়েছিলাম। সেই রাতগুলোতে ঘুম ভেঙে দেখতাম আকতারী আপা আমার মুখে ক্রিম লাগিয়ে দিচ্ছেন। আমার মুখের দাগ যেন ঢেকে যায়, সেই আশায়! বাইরে যাবার সময় নিজের কাপড় পরিয়ে সাজিয়ে দিতেন যেন কোথাও আমাকে দুর্বল মনে না করে কেউ। অনেক অনুরোধ, অনুনয়ের পর কম্পিউটার পরীক্ষা এবং নিজের নানা দক্ষতার প্রমাণ দিয়েও আমি যে ছয় হাজার টাকা বেতনের চাকরি পেতে হন্যে হয়েছি, এখন দেখি একই পোস্টে নিজের নামটি অব্দি ভালো করে লিখতে জানে না, এমন মানুষও চাকরি করে ভাত খাচ্ছে!  যাই হোক, সেই কথাও আরেকদিন বলব।

চাকরি পাবার অনিশ্চয়তার সময় ভাবলাম, আকতারী আপার বাসা অনেক দূর। এতো টাকা গাড়িভাড়া দিয়ে রোজ জামালখানে আসা সম্ভব নয়, তাই কাছেপিঠেই একটি থাকার জায়গা হলে আমার সুবিধা হতো। যার নিজের চলার মত টাকা নেই, খাওয়ার টাকা নেই সেই মানুষ আমি কি করে কারো কাছে থাকার জায়গা খুঁজতে যাব!

শহরের একজন নামকরা ডাক্তার দম্পতি আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন সে সময়  তাদের অন্য আরেকটি ফ্ল্যাটে, সাথে সঙ্গী পেলাম দুটি দেবশিশু। পরম যত্মে, মায়ায়, ভালোবাসায় তারা আমায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। তাদের কাছে আমার এক জীবনের ঋণ। আমাকে না খাইয়ে তারা কখনও খেতে বসতেন না। পাশেই আরেকটি ফ্ল্যাটে তারা থাকতেন, খাবার সময় হলেই আমাকে ডাকতে চলে আসতেন। তাদের সাথে জীবনের কিছু অসাধারণ সময় আমি কাটিয়েছি। কিন্তু আমার নিজের ভেতর খুব সংকোচ বোধ হতো, আমার নিজেরই সামর্থহীনতার জন্য। প্রতিবেলায় খেতে বসতে ভীষণ লজ্জা হতো,তাই একটা বুদ্ধি করতে হলো। তারা খেতে ডাকলে প্রায়ই বলতাম-  বাইরে প্রচুর খেয়ে এসেছি। ব্যাগে একটা ছোট বিস্কুটের প্যাকেট রাখতাম। 

আমার বহু আত্মীয়, চেনা পরিচিত ফোন করত তখন। তারা কেউ আমি কেমন আছি জানতে চাইতো না। জানতে চাইতো আমি কোথায়, কার সাথে আছি। সেসময় আমাকে নিয়ে এই পুরো চট্টগ্রামে চেনা মহলের সবার মধ্যে একটি কথা চাউর হয়ে গেল। আমি মুসলমান হয়ে গেছি! কোনও এক মুসলমানকে বিয়ে করেছি! এই সাহিত্য জগতেরই অনেক দু’মুখে সাপও তাতে ঘি ঢেলেছিল। এখনও আমাকে নিয়ে দুটি দল। একদল তাদের আড্ডা আলোচনায় বলেন- আমি মুসলমান হয়ে গেছি। অন্যদল বলেন- আমি সাম্প্রদায়িক। আমার পক্ষে-বিপক্ষে সমস্ত কথাই আমি খুব উপভোগ করি। আমার ভালো লাগে। আমার নিজের সমালোচনা গ্রহণ করার মত সামান্য ক্ষমতা আমার তৈরি হয়েছে। আমি এখন আমার সেই ক্ষমতার ইমপ্রোভাইজেশন চালিয়ে যাচ্ছি।

তো এই লেখা আসলে তাদের জন্য, যারা বলেন আমি আমার কাটকাট পোস্টের জন্য জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি, মানুষের অপ্রিয় হয়ে যাচ্ছি। এই কথা একবছর আগে বললেও আমি খুব দুঃশ্চিন্তা করতাম। এখন হয় না ভাই। এখন আমি চাকরি হারালে পান বিড়ি বেঁচে নিজের পেট চালানোর মত মনের সাহস আছে। মাথার ওপর ছাদ টিকিয়ে রাখতে শেষ অবধি লড়াই করার শক্তি আছে। আমি এখন চিনি এই শহরটা, এই শহরের মানুষদের। আমার এই শরীর এখন ঝড়, তাপ, শৈত্য- সমস্ত কিছুর সাথে লড়াই করতে পারবে। কষ্ট হবে, তবে পারবে।

আমার জীবনে অনেক অনেক জটিলতা আছে, কিন্তু কোনও গোপনীয়তা নেই। জনবিচ্ছিন্নতা শব্দে আপনারা যে জনগণের কথা আমাকে বলেন সেই জনগণকে আমি এখন খুব ভালো জানি। তাই সেই বিচ্ছিন্নতা নিয়ে দুঃখ লাগে না আর।

শুধু ভালোবাসা পাবার লোভ কাটাতে পারি না কিছুতেই। জীবনে নির্মোহ হবার চেষ্টা করে করেও এই লোভের কাছে হার মেনে আছি প্রতি পলে পলে। আমি অকৃতি অধম জেনেও যারা ভালোবেসেছেন তারাই সেই লোভ বাড়িয়ে দিচ্ছেন অহর্নিশ।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)