প্রেমের টানে সাইকেল চালিয়ে ইউরোপ গমন

প্রেমিকাকে বলাই যায়, তোমার জন্য আকাশের চাঁদটাও এনে দিতে পারি। কিংবা পাড়ি দিতে পারি সাত সমুদ্র তের নদী। বলা সহজ কিন্তু করাটা অত সহজ নয়। তাই বলে পৃথিবী থেকে তো ভালবাসা হারিয়ে যায়নি। আকাশের চাঁদ এনে দিতে না পারলেও যুগে যুগে পাগল প্রেমিক-প্রেমিকারা একে অপরের জন্য কত কিছু্ই না করেছে। এমনকি ধ্বংস হয়েছে ট্রয় নগরী। পোপ ভ্যালেন্টাইনকে দন্ডিত করা হয়েছে মৃত্যুদন্ডে। ভালবাসা তবু থেমে নেই। কারন ভালবাসা ছাড়া পৃথিবী টিকে থাকবে না। ভারতের দলিত শ্রেণীর যুবক মহানন্দিয়া তেমনি অবিশ্বাস্য এক প্রেমকাহিনীর নায়ক । ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যে দলিত শ্রেনীর এক দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম । সমাজের নীচুতলার মানুষ হিসেবে উঁচু জাতের লোকের কাছে অস্পৃশ্য। তার একটি বিশেষ গুণ ছিল। তা হলো ছবি আঁকা। সেই ছবি আঁকা থেকেই শুরু হলো এই অমর প্রেমকাহিনীর।

প্রেমকাহিনীর নায়িকা ইউরোপের নাগরিক শার্লোট ভন শেডভিন। তাদের দুজনের প্রথম দেখা হয়েছিল দিল্লিতে শীতের এক সন্ধ্যায়। সেই ১৯৭৫ সালে। একদল বন্ধুর সঙ্গে দল বেঁধে প্রথমবারের মত গাড়ি চালিয়ে ইউরোপ থেকে দিল্লি। দিল্লির কনট প্লেসে প্রথম দেখা হলো দুজনের। মহানন্দিয়া শিল্পী। ছবি আঁকেন। দশ মিনিটে একেঁ ফেলতে পারেন যে কারও অবিকল প্রতিকৃতি। মেয়েটি অনুরোধ করলো তার ছবি এঁকে দিতে। শার্লোটকে দেখে মহানন্দিয়ার মনে পড়ে গেল তার মায়ের করা ভবিষ্যদ্বাণী। সেই প্রথম দেখাতেই প্রেম।
অবিশ্বাস্যভাবে মায়ের ভবিষ্যতবাণী মিলে গেল শার্লোটের সাথে। শার্লোটের জন্মরাশি বৃষ, সুইডেনের এক অভিজাত পরিবারের বংশধর, সঙ্গীতেও তার আগ্রহ আছে। আর তাদের পরিবার সত্যি এক বনাঞ্চলের মালিক। মহানন্দিয়া বলেন, আমার ভেতর থেকে কেউ যেন বললো, এই সেই মেয়ে। প্রথম দর্শনেই যেন আমরা পরস্পরের দিকে আকৃষ্ট হলাম চুম্বকের মতো। এ যেন প্রথম দর্শনেই প্রেম। শার্লোটকে চায়ের আমন্ত্রণ জানালেন মহানন্দিয়া। অনেক সংকোচ ছিল তার। কিন্তু শার্লোট যেন এরই প্রতীক্ষায় ছিলেন। এরপর দুজনে বেড়াতে গেলেন উড়িষ্যায়। কোনারক মন্দির দেখে মুগ্ধ শার্লোট। শাড়ি পরে মহানন্দিয়ার বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন শার্লোট। তাদের ধর্মীয় রীতি মেনে দুজনের বিয়ে হলো। এর পর শার্লোট ফিরে এলেন ইউরোপে। মহানন্দিয়ার কাছ থেকে কথা আদায় করলেন, সুইডেনের বস্ত্র শিল্প শহর বোরাসে দেখা হবে আবার দুজনের। কথা দিল মহানন্দিয়া। বছর গড়ালো। দুজনের মধ্যে কেবল চিঠিপত্রে যোগাযোগ।
কিন্তু ইউরোপ যাবার মত এত টাকা যে তার নেই। কোত্থেকে আসবে প্লেনভাড়া। মহানন্দিয়ার কাছে এটা আকাশ কুসুম কল্পনা। কিন্তু সত্যিকারের প্রেম হয়তো অনেক অসম্ভবকেই সম্ভব করে দেয়। তাই প্রেমের টানেই একদিন পথে নামলো মহানন্দিয়া। প্লেনের টিকিটের টাকা নেই তাতে কী। সব বিক্রি করে একটা সাইকেল কিনলেন তিনি। সেই সাইকেল চালাতে চালাতে নানা দেশ পাড়ি দিয়ে মহানন্দিয়া পৌঁছে গেলেন ইউরোপে তার প্রেমিকার কাছে।
১৯৭৭ সালের ২২শে জানুয়ারি মহানন্দিয়া শুরু করেছিলেন তার এই অভিযান। প্রতিদিন গড়ে ৭৭ কিলোমিটার করে পথ পাড়ি দিতেন। খুবই ক্লান্ত লাগতো। পা ব্যাথা করতো। কিন্তু ভালবাসার মানুষ শার্লোটের সঙ্গে দেখা করতেই হবে। সেটাই ছিল মহনন্দিয়ার শক্তি। এই শক্তিই তাকে উজ্জীবীত রাখতো।

দেখা হলো শার্লোটের সঙ্গে। সে এক অপূর্ব স্বর্গীয় মিলন! তবে প্রেমের ক্ষেত্রে বাবা-মা যা করে থাকে আরকি। প্রথমে বিয়ের ব্যাপারে শার্লোটের বাবা-মা এত সহজে রাজী হলোনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুইডেনের আইন-কানুন মেনে আনুষ্ঠানিক বিয়ে হলো তাদের মধ্যে। তাদের প্রেম এখনো অটুট। সন্তান বড় হয়েছে। সুইডেনে তাদের সুখের সংসার। ৬৪ বছর বয়সী মহানন্দিয়া এখনো সুইডেনেই থাকেন তার স্ত্রী শার্লোট এবং দুই সন্তানকে নিয়ে। কাজ করেন শিল্পী হিসেবে।
তিনি সাইকেল চালিয়ে ইউরোপে এসেছিলেন, সেটা শুনে যখন অনেকেই অবাক হয়, সেটা ঠিক বুঝতে পারেন না মহানন্দিয়া। তার মতে, ব্যাপারটা তো খুব সহজ। আমি আসলে যা করার দরকার তাই করেছি। ওর সঙ্গে দেখা করতে আসার মতো টাকা ছিল না আমার। তাই আমি সাইকেল চালিয়েছি। প্রেমের টানে। সাইকেল চালানোর প্রতি আমার কোন আকর্ষণ ছিল না।
বিবিসি অবলম্বনে