ফরাসিদের দ্বিতীয় বিপ্লব

বিশ্বকাপ ফাইনালের আগের দিন ফ্রান্সের সবচেয়ে নামি ক্রীড়া দৈনিক ‘লেকিপ’ বিশাল ছবি দিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছিল একটা তথ্য। এনগোলো কান্তে এবং পল পোগবা একসঙ্গে খেললে কোনোদিন হারেনি ফ্রান্স। গতকাল রোববার মস্কোর লুঝনিকে কন্তে আর পোগবা দুজনই খেলেছেন। ফ্রান্সও তাই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন।
আর ক্রোয়েশিয়া। যে দেশ ফুটবল পায়ে স্বাধীনতার পথে হেঁটেছিল মস্কোয় তারা ফরাসি বিপ্লব থামাতে পারেনি। ৪-২ গোলে হেরেছে তারা। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ হাসছিলেন। ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট কলিন্দা গ্রাবার কিতারোভিচ বিমর্ষ। স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় কাঁদছিল লুঝনিকের ক্রোয়াট সমর্থকরা। আসলে কাঁদছিল ক্রোয়েশিয়া। সেই দেশ যারা একটা ফুটবল ম্যাচের বিক্ষোভ থেকে হেঁটেছিল সুমহান স্বাধীনতার পথে। ১৯৯০ সালের ১৩ মে যুগোশ্লাভিয়া লিগে খেলা ছিল ক্রোয়েশিয়ার দিনামো জাগ্রেব এবং সার্বিয়ার রেডস্টার বেলগ্রেডের। তার কিছুদিন আগে, ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতার দাবিতে ভোটাভুটি হয়েছে পঞ্চাশ বছর পর। সে ম্যাচে সার্বিয়ান এবং ক্রোটদের তুমুল মারধর হয়। শ’ খানেক ক্রোট মারাত্মক আহত হন। ওই ম্যাচের পরই যুগোস্লাভ ফুটবল লিগ থেকে নাম তুলে নেয় ক্রোয়েশিয়া এবং স্লোভেনিয়ার ক্লাবগুলো। দেশে স্বাধীনতার ডাক আরও প্রবলতর হয়। ভেঙে যায় যুগোস্লাভ লিগ। অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, ওই ফুটবল দাঙ্গার ফলে নতুন দেশের স্বাধীনতার দাবিতে আরও একজোট হন ক্রোটরা। ফুটবল প্রেমে মহান হয়ে ওঠা এমন দেশ বিশ্বকাপ জিতলে বেশ হতো। কিন্তু ছবি আর কবিতার দেশ ফ্রান্স তা হতে দেয়নি। বিপ্লবের দেশ ফ্রান্সের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো সোনার ট্রফিটা ছিনিয়ে নিয়েছেন গ্রিজম্যান-পোগবা-এমবাপেরা। ম্যাচ শুরুর ১৮ মিনিটেই এগিয়ে যায় ফ্রান্স। আত্মঘাতী গোলে পিছিয়ে পড়ে ক্রোয়েশিয়া। ডি-বক্সের বাইরে গ্রিজম্যানকে ফাউল করেন মার্সেলো ব্রজভিচ। প্রায় ৩০ গজ দূর থেকে সেট পিস নেন গ্রিজম্যান। গোলের মুখে হেড দিতে উঠে মানজুকিচের মাথায় লেগে বল জড়িয়ে যায় ক্রোয়েশিয়ার জালে। গোলরক্ষক সুবাসিচের কার্যত কিছুই করার ছিল না। এর ১০ মিনিট পর ইভান পেরসিচের দুর্র্ধর্ষ গোলে সমতা আনেন। কিন্তু মিনিট দশেক পর তারই হাতে বল লাগায় পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। অ্যান্তনিও গ্রিজম্যান এবারের বিশ্বকাপে তার চতুর্থ গোলটি করেন। ক্রোয়োট দল পিছিয়ে থেকে বিরতিতে যায়। বিরতি থেকে ফিরে মাত্র ৬ মিনিটের ব্যবধানে দুই গোল করে ক্রোয়েশিয়াকে বিধ্বস্ত করে দেন গ্রিজম্যান-পগবা-এমবাপেরা। পারফেক্ট ফিনিশিং দেখিয়েছেন পগবা ও এমবাপে। ৫৯ আর ৬৫ মিনিটে গোল দুটি করেন তারা। ম্যাচ কার্যত ওখানেই শেষ। কিন্তু ফরাসি গোলকিপারের শিশুসুলভ ভুলে ৬৯ মিনিটে একটি গোল শোধ করে আশা জাগিয়েছিলেন মানজুকিচ। কিন্তু সেই আশা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে গ্রিজম্যান, এমতিতি, এমবাপে, কান্তে, পোগবার পায়ের কাছে। এরাই আসলে ফুটবলে দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লবের নায়ক। ফ্রান্স এনিয়ে তিনবার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলে দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হলো। ১৯৯৮ সালে প্রথমবার উঠেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তারা। সেবার বিশ্বকাপের আসর বসেছিল ফ্রান্সেই। জিতেছিলও তারা। ’৯৮-এর ফরাসি দলের অধিনায়ক ছিলেন দিদিয়ের দেশঁম। এবার তিনি কোচ। দুই ভূমিকায় ইতিহাস গড়ে বসলেন বেকেন বাওয়ার এবং মারিও জাগালোর পাশে। এই বিশ্বকাপে দেশঁম বলেছিলেন, ‘আমার কাছে আনন্দ মানে হচ্ছে শুধু সাফল্য।’ সত্যিকার অর্থেই সফল তিনি। না হওয়ার কারণও নেই।
বর্তমান ফরাসি কোচের বিশ্বকাপ ও ইউরোজয়ী সতীর্থ মার্সেই দেসাই একবার বলেছিলেন, ‘দিদিয়ের সব সময় দেখেছি, সময়ের আগে আগেভাগে। বয়সের আন্দাজে অনেক পরিণত। ও তো কোনো বিউটি কম্পিটিশনে নামছে না। ওর কাজ হচ্ছে ট্রফি জেতা। ওর কোনো কাজ অর্ধেক মন দিয়ে করে না। পুরো মন দিয়ে করে।’ গতকাল তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর গেছে বলেই মাত্র ৪.২ মিলিয়ন লোকের দেশ ক্রোয়েশিয়াকে হারতে হলো। ১৯৫০ সালে উরুগুয়ের পর বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলা সবচেয়ে ছোট দেশ।
যারা স্বাধীনতা পেয়েছে ১৯৯১ সালে। ১৯৯৮ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপে খেলেই উঠেছিল সেমিফাইনালে। কুড়ি বছর পর এবার রাশিয়া বিশ্বকাপে রানার্স আপ। ফুটবলের ফরাসি সুগন্ধে যখন মস্কোর আকাশ-বাতাস ভরে উঠছিল তখন ক্রোয়েশিয়ার ফুটবলাররা বীরের মতো হাঁটছিলেন লুঝনিকের সবুজ ঘাসের ওপর। পাশে ফরাসি তরুণরাও ছিলেন। যারা বিশ^জয়ের পর আনন্দে আত্মহারা। সবুজ মাঠে দুই দলকেই মনে হচ্ছিল ফুটবলের সবুজ প্রতিভার বার্তাবাহক।
কে জানে এই ছবিটা দেখে মস্কোর সুবিশাল পাথরের লেলিন হেসে উঠেছিলেন কি না! দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব দেখে তার হাসারই কথা।