English Version
আপডেট : ১১ জুলাই, ২০১৮ ১৫:৪৪

ক্রোয়েশিয়ার ইংলিশ পরীক্ষা

অনলাইন ডেস্ক
ক্রোয়েশিয়ার ইংলিশ পরীক্ষা

ছোটবেলায় ইংলিশ পরীক্ষা দিতে গিয়ে আমাদের অনেকেরই কপালের ভাঁজ চওড়া হওয়ার স্মৃতি আছে নিশ্চয়ই। ক্রোয়েশিয়ানামক দেশটির শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা আমাদের মতো কি না কে জানে! তবে আজ দুশ্চিন্তায় কপালের ভাঁজ চওড়া হওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড়দের জন্য।

আজ যে তাদের ইংলিশ পরীক্ষা! তাও আবার পরীক্ষাটা এমন একমঞ্চে যেখানে প্রত্যাশার পাহাড় কাঁধে নিয়ে বুক চিতিয়ে লড়াই করতে না পারলে ইতিহাস মুখ ফিরে তাকায় না। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে আজ রাত ১২টায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই কঠিনতম পরীক্ষার মুখোমুখি হচ্ছে ক্রোয়েশিয়ার ‘সোনালি প্রজন্ম’।        ক্রোয়েশিয়া এমন এক উঠতি দল যারা নিকট ভবিষ্যতে ফুটবল বিশ্বকে শাসন করার ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে একের পর এক। রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছে বিশ্বমঞ্চে নিজেদের সেরা অর্জনের হাতছানি এখন তাদের সামনে। গ্রুপ পর্বে দারুণ খেলা ক্রোয়েশিয়া শেষ ষোলোয় ডেনমার্কের বিপক্ষে ও কোয়ার্টার ফাইনালে রাশিয়ার বিপক্ষে টাইব্রেকারে জয় পায়।  ১৯৯১ সালে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে যাওয়ার পর ছয়টি বিশ্বকাপের পাঁচটিতেই খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে ক্রোয়েশিয়া। ১৯৯৮ সালে বিশ্বমঞ্চে নিজেদের অভিষেকেই শেষ চারে পা রেখেছিল তারা। ওই আসরের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের কাছে সেমিফাইনালে হারের পর তৃতীয় স্থান নির্ধারণী খেলায় জয় পায় নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। এটাই বিশ্বমঞ্চে দেশটির সেরা পারফরম্যান্স। চলতি রাশিয়া বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত অপরাজিত ক্রোয়েশিয়া। ‘ডি’ গ্রুপে তিন ম্যাচই জিতে পুরো নয় পয়েন্ট নিয়ে নকআউট পর্বে পা রাখে জ্বলাতকো দালিচের দল। প্রতিপক্ষের জালে সাতবার বল জড়ানোর বিপরীতে নিজেরা হজম করেছে মোটে একটি। ইতিহাস বলছে, বিশ্বকাপে এর আগে কখনোই ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয়নি ক্রোয়েশিয়া। আন্তর্জাতিক কোনো টুর্নামেন্টে দুই দলের একমাত্র দেখাটা হয়েছিল ২০০৪ সালের ইউরোয়। সেবার ৪-২ গোলে ইংলিশদের পরাস্ত করে ক্রোয়াটরা। সব মিলিয়ে দুই দলের দেখা হয়েছে সাতবার। চার জয় নিয়ে এগিয়ে আছে থ্রি-লায়ন্স। ক্রোয়েশিয়ার জয় দুটি। ১৯৯৬ সালে দুই দলের প্রথম ম্যাচটি ছিল গোলশূন্য ড্র। ক্রোয়েশিয়ার আত্মবিশ্বাসের পারদ উঁচুতে তুলে ধরছেন তাদের দ্বাদশ খেলোয়াড়- দেশটির প্রেসিডেন্ট কলিন্দা গ্রাবার-কিতারোভিচ! ক্রোয়েশিয়ার সর্বশেষ ম্যাচে সারা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীরা প্রত্যক্ষ করেছে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য! টাইব্রেকারে ক্রোয়েশিয়া রাশিয়াকে হারিয়ে দিতেই দুই হাত তুলে নাচতে শুরু করলেন ক্রোয়েশিয়ার প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট কলিন্দা। আর সে দৃশ্যের গম্ভীর দর্শক তখন পাশে থাকা হতাশ রুশ প্রধানমন্ত্রী। গল্প এখানেই শেষ হচ্ছে না। যেন কোনো অস্বস্তির বালাই নেই এই প্রেসিডেন্টের। খেলা শেষ হতেই সটান তিনি ঢুকে পড়লেন ক্রোয়েশিয়ার ফুটবলারদের ড্রেসিংরুমে। ফুটবলারদের গায়ে তখন সামান্য কিছু জামা-কাপড়। ওই অবস্থাতেই তিনি একে একে ফুটবলারদের আলিঙ্গন করতে শুরু করলেন। সবশেষে ওখানেই শুরু হলো ফুটবলারদের নিয়ে তার নাচ! আজ অন্তত এই প্রেসিডেন্টের জন্য হলেও মরণপণ লড়তে চায় ক্রোয়েটরা।    ইংল্যান্ডের প্রধান পারফরমার হ্যারি কেনে ভয় নেই ক্রোয়েটদের। তাদের কোচ জ্বলাতকো দালিচ বললেন, ‘হ্যারি কেন সব চেয়ে বেশি গোল করেছে। 

ওকে আটকানো কঠিন। কিন্তু আমাদেরও দারুণ সেন্টার ব্যাকরা রয়েছে। আমরা মেসিকে আটকেছি। আটকেছি ডেনমার্কের এরিকেসেনকেও। আশা করি, কেনকেও আটকাব।’ দালিচ হুঙ্কার দিচ্ছেন, ‘আমাদের নিজেদের শক্তির ওপর পুরো আস্থা আছে। ইংল্যান্ডকে ভয় পাই না।’ তাহলে কি এই ইংল্যান্ড আদৌ ভালো দল না? দালিচের জবাব, ‘এক বারও বলছি না এমন কথা। ভালো না হলে সেমিফাইনালে উঠত না।’ এখানেই থামেননি ক্রোয়েশিয়ার কোচ, ‘ওদের যেটুকু খেলা দেখেছি তাতে বুঝেছি ওরা খুব দ্রুত ডিরেক্ট ফুটবল খেলে। সেটপিসেও ভালো। কর্নার পেলে ওদের লম্বা ফুটবলাররা যে কোনো সময় হেডে গোল করে যেতে পারে। এগুলো মাথায় রেখেই আমাদের খেলতে হবে।’ এবার আসি ইংলিশদের কথায়। আর দুই ম্যাচ জিতলেই ১৯৬৬ সালের পর প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতবে ইংলিশরা। ছেষট্টির বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড নায়ক জিওফ হার্স্ট নিজেদের সঙ্গে যথেষ্ট মিল খুঁজে পাচ্ছেন হ্যারি কেনদের! জিওফ হার্স্ট মনে করেন, ইংল্যান্ডের ফাইনালে না ওঠাটা হবে অঘটন। নিজেদের ছেষট্টির দলটির সঙ্গে যথেষ্ট মিল খুঁজে পাচ্ছেন ছেষট্টির ফাইনালের হ্যাটট্রিক-ম্যান, ‘১৯৬৬ বিশ্বকাপজয়ী দলটির সঙ্গে ২০১৮ বিশ্বকাপের ইংল্যান্ড দলটির বেশ মিল দেখতে পাচ্ছি।

আমাদের নেতা ছিল অ্যালফ রামসে, গ্যারেথ সাউথগেটও এখন পর্যন্ত এই দলটাকে দারুণভাবে গুছিয়ে রেখেছে। আমি এই দলের বিশ্বকাপ না জেতার কোনো কারণ দেখছি না। রোববারের ফাইনালে যদি তারা না থাকে, এটা হবে অঘটন।’ ওদিকে ফাইনালে ওঠার এই সুযোগ হাতছাড়া না করে কাজে লাগাতে সতীর্থদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ইংল্যান্ডের ডিফেন্ডার জন স্টোনস। শুধু ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ সামনে এমনটা ধরে খেলার জন্য সতীর্থদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জোনস। ক্রোয়েশিয়াকে পেরুতে আমাদের আরেকটা ধাপ যেতে হবে। এ ম্যাচটাকে আমরা ‘একটাই ম্যাচ’ ধরে খেলব। এ ম্যাচে আমরা আমাদের পুরো মনোযোগ ও শক্তি দেব এবং এটাই আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ হবে। ইংল্যান্ড অধিনায়ক হ্যারি কেন সে কথা মেনেও নিয়েছেন। টুর্নামেন্টে ছয় গোল করে ফেলা এই স্ট্রাইকার বলছেন, ‘ফুটবল জীবনের বড় ম্যাচটা খেলার মাত্র একধাপ পেছনে রয়েছি আমরা। ছেলেরাও মনে করছে, এখনো ফুরিয়ে যাইনি। সেমিফাইনাল থেকে ফিরে যাওয়ার কোনো প্রশ্ন নেই। ফাইনালের জন্য সর্বশক্তি দিয়ে লড়বে সবাই। ১৯৬৬ সালের কোনো বিশ্বজয়ী ফুটবলারের সঙ্গে দেখা হলেই দুর্দান্ত প্রেরণা পাই।’ ইংল্যান্ডের আছে শক্তিশালী ফুটবল ঐতিহ্য, তাই স্বাভাবিকভাবেই পরিসংখ্যান কিছুটা তাদের দিকে ঝুঁকে আছে। কোনো বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড প্রথম সেমিফাইনাল খেলেছিল ১৯৬৬ সালে দেশের মাটিতে। ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ৯০ হাজারেরও বেশি দর্শকের সামনে ববি চার্লটন ফিরতি এক শটে প্রথমার্ধে এগিয়ে দেন ইংল্যান্ডকে। ১৯৬৫ সালের ব্যালন ডি’অর জয়ী ইউসেবিওর নেতৃত্বে পর্তুগালের মুখোমুখি হয়েছিল তারা। চার্লটন বিরতির পর ৮০ মিনিটে আরেক গোল করলে সহজ জয় পাওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল ইংলিশরা। কিন্তু ২ গোলে পিছিয়ে যাওয়া পর্তুগিজ ৮২ মিনিটে এক গোল শোধ দেয় ইউসেবিওর পেনাল্টি থেকে। এভাবে ২-১ গোলের জয়ে পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে ফাইনাল নিশ্চিত করে ইংল্যান্ড। যেখানে নির্ধারিত সময় ২-২ গোলে শেষ হলে অতিরিক্ত সময়ে ৪-২ গোলের জয় নিশ্চিত করে তারা। ইংল্যান্ড ঘরে তোলে তাদের একমাত্র বিশ্বকাপ শিরোপা। অন্যদিকে ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে গেলে স্বাধীন দেশ হিসেবে ক্রোয়েশিয়া প্রথমবার বিশ্বকাপে ওঠে ১৯৯৮ সালে। ওইবারই তারা নিশ্চিত করে সেমিফাইনাল। ক্রোয়েশিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডেভর সুকারের নেতৃত্বে অ্যালেন বোকসিচ, জোনিমির বোবান ও রবের্তো প্রোসিনেকির মতো ওই তরুণ দল দারুণ পারফরম্যান্স করে শেষ চার নিশ্চিত করেছিল। সে সময় স্বাগতিক ফ্রান্সকে ১-০ গোলে পেছনে ফেলে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই। টুর্নামেন্টের পঞ্চম গোল করেন সুকার। কিন্তু লিলিয়ান থুরামের জোড়া গোলে ঘুরে দাঁড়ানো জয়ে ফাইনালে ওঠে ফরাসিরা। ব্রাজিলকে হারিয়ে ফ্রান্স তাদের প্রথম শিরোপা ঘরে তোলার দিনে ক্রোয়েশিয়া তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে সুকার ও প্রোসিনেকির লক্ষ্যভেদে ২-১ গোলে জেতে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। এটাই বিশ্বকাপের ইতিহাসে ক্রোয়েটদের সর্বোচ্চ তৃপ্তি। এই তৃপ্তিটা এবার আরও বাড়িয়ে নিতে লড়বে ক্রোয়েশিয়ার ‘সোনালি প্রজন্ম’।