টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিচ্ছেন মাশরাফি!

টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটটা যেকোনো দিন ছেড়ে দিতে পারেন জেনে তামিম ইকবাল আগাম প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন, ‘ভাই, তাহলে পরের বিপিএলে আমি যে দলে খেলব সে দলের কোচ হয়ে যান প্লিজ!’ কিন্তু আপাতত সে সম্ভাবনা নেই। কিন্তু কদিন আগেই দামি গাড়ি উপহার দিয়ে অন্তত পরবর্তী মৌসুমের জন্য মাশরাফি বিন মর্তুজাকে ‘ভালোবাসার ঋণবন্দি’ করে ফেলেছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের মালিক। কিন্তু আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি আর ভালোবাসায় আটকে রাখতে পারছে না তাঁকে। বিশ্ব টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচটিই হবে মাশরাফির শেষ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি। ১৬ বছর। ২০০১ সাল থেকে আঙুলের কড় গুনলে তা-ই হয়। প্রতিটা বছর, দিন-মাস-মুহূর্ত কত কী-ই না করেছেন মাশরাফি। কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্য মাড়িয়ে মধ্য তিরিশে পা রাখার পথে প্রেম-বিয়ে-বাবা হওয়া, বাড়ি-গাড়ি কত্ত বিজ্ঞাপন এবং অখণ্ড আড্ডা—সে অর্থে আর দশজন ব্যস্ত মানুষের মতোই কেটেছে জীবন। তবে আর দশজন থেকে তাঁকে আলাদা করেছে ক্রিকেট। জাগতিক সব কর্মকাণ্ডের মাঝেও যে মাশরাফির মনজুড়ে ক্রিকেট। টেস্ট ক্রিকেট প্রথম পছন্দ, কিন্তু ওটা খেলেন না সেই ২০০৯ সাল থেকে, কখনো খেলাও হবে না সম্ভবত। ওয়ানডেটা যে সবচেয়ে উপভোগ করেন, সে তো পারফরম্যান্স গ্রাফই বলে। টি-টোয়েন্টির ভক্ত কখনোই নন, তবে এটাই এখনকার বাস্তবতা আর শেষমেশ ক্রিকেট বলে এটাও ‘গোগ্রাসে খাচ্ছেন’ তিনি। কিন্তু আর নয়, টিম ম্যানেজমেন্ট এবং ঘনিষ্ঠদের নাকি এমনটা জানিয়েও দিয়েছেন মাশরাফি। এ ফরম্যাট থেকে বিদায়ের জন্য ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচটিকে বেছেও নিয়েছেন তিনি। আর ২০১৭ আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারেরই ইতি টানার ইচ্ছা তাঁর। তবে সে তো দূর ভবিষ্যতের ব্যাপার, আপাতত মাশরাফির বিদায় ভাবনায় আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি। বিষয়টি যেহেতু এখনো সরকারি নয়, সেহেতু এখনই এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন মাশরাফি। তবে আরব আমিরাতের বিপক্ষে ম্যাচের পর নিজে থেকেই বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমি আর বেশি দিন নেই।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এ সিদ্ধান্ত তাঁর গত পরশুই নেওয়া নয়। বিপিএলে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের হয়ে শিরোপা জয়ের পরপরই জাতীয় দলের কোচ চন্দিকা হাতুরাসিংহে এবং প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদকে জানিয়েছিলেন তিনি। তাঁদের পরামর্শে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনাও করেছিলেন, কিন্তু শেষমেশ অবসরের পুরনো সিদ্ধান্ত থেকে মাশরাফি পিছু হটছেন না বলেই খবর। টি-টোয়েন্টি নিয়ে মাশরাফির নিজের চিন্তা এবং তাঁকে নিয়ে দলের চিন্তাও এখন নাকি একই সমান্তরালে। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে একের পর এক চোট বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে তাঁর ক্যারিয়ার। এ নিয়ে মাশরাফির নিজের যেমন আক্ষেপ আছে, তেমনি সেরা মাশরাফিকে না পাওয়ার আফসোস রয়েছে বাংলাদেশ দলেরও। আজকের মুস্তাফিজুর রহমানকে যেমন সবাই একবাক্যে ভবিষ্যতের সেরা বলে দিচ্ছেন, ক্যারিয়ারের শুরুতে একই ভবিষ্যদ্বাণী শুনেছেন ১৭ বছর বয়সী মাশরাফিও। গতি, সুইং আর আগ্রাসী মনোভাবের কারণে এখনো বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা একাদশে অনায়াসে জায়গা করে নেবেন তিনি। মাঝে যে কেটে গেছে ১৬টি বসন্ত, তবে বয়স ৩৩ খুব বেশি নয়। কিন্তু সাতটি অস্ত্রোপচারের ধাক্কায় তাঁর এখনো বল হাতে ছোটাটাই ক্রিকেট বিশ্বের বিস্ময়! যদিও তিনি নিজে আর ফিজিও ও ট্রেনার ছাড়া বাকিদের সামান্যই ধারণা আছে এ অবস্থায়ও ছোটার জন্য কত কী করতে হয় মাশরাফিকে। সে লিস্টটা অনেক লম্বা, যার সবগুলোই অবিরাম ত্যাগের একেকটা নমুনা মাত্র! জীবনের চেয়েও বড় বলে একটা কথা আছে। মাশরাফি বিন মর্তুজার বেলায় সেটা ‘ক্রিকেটের চেয়েও বড়’। টি-টোয়েন্টিতে দল মোটেও তাঁর কাছ থেকে পুরো ৪ ওভারের দাবি নিয়ে বসে নেই। দলের সেরা ফিল্ডারদের মধ্যেও আর পড়েন না মাশরাফি। আর তাঁর ব্যাটে এক-দুটা ছক্কার বেশি প্রত্যাশা নেই আমজনতারও। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি একাদশে হেঁটে হেঁটে ঢুকে পড়াটা একটু কঠিনই মাশরাফির জন্য। তবু একাদশে তাঁর নামটাই লেখা হয় সবার আগে, তিনি অধিনায়ক যে! আর এই ‘অধিনায়ক’ মাশরাফিকে ছাড়তে হবে বলেই বারবার পুনর্বিবেচনা করছেন টিম ম্যানেজমেন্টও। এমন নয় যে দলে অধিনায়ক করার মতো কেউ নেই। তবে মাশরাফির ব্যক্তিত্ব আর তাঁর মতো করে দলটাকে একাট্টা নিশ্চিতভাবেই করে রাখতে পারবেন, এমন কাউকে এখনই হাতের কাছে খুঁজে পাচ্ছে না বাংলাদেশ দল। সে ক্ষেত্রে ‘বিকল্প’ একটা প্রস্তাব পেতেও পারেন মাশরাফি। টি-টোয়েন্টি ছাড়লেও যেন দলের সঙ্গে ম্যানেজার কিংবা বোলিং কোচ হিসেবে থেকে যান তিনি। ড্রেসিংরুমে অধিনায়ক মাশরাফির অনুপস্থিতি পূরণের বিকল্প ব্যবস্থা আর কি! সে প্রস্তাব শেষমেশ কোথায় কি গড়ায়, তা ভবিতব্যই জানে। সুনাম আর সম্মানের চূড়ায় বসে থাকা মাশরাফির শেষটা কেমন হয়—সেটাও ভবিষ্যতের হাতে তোলা। তবে গত দেড় যুগে যে ক্রিকেট খেলেছেন, যে ক্রিকেট সংস্কৃতি রেখে যাবেন—তার জন্যই হূদয়ের অন্তস্তল থেকে ধন্যবাদ পাবেন মাশরাফি।