উপলক্ষটা ছিল রূপকথাকে হার মানানো মাশরাফির জীবনকাহিনী নিয়ে লেখা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান। মাশরাফির অবিশ্বাস্য সংগ্রামমুখর জীবন দুই মলাটে লিপিবদ্ধ করেছেন ক্রীড়া সাংবাদিক ও লেখক দেবব্রত মুখোপাধ্যায়। তার পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই আছে নিজের শরীরের সঙ্গে নিত্য লড়াইয়ের গল্প। বারাবার আঘাত তাকে শরীর ও মনকে ভেঙ্গে দিয়েছে, যুদ্ধ করে আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন মাশরাফি। তার জীবনটাই তো একটা মহাকাব্য।

বইটির নাম দেয়া হয়েছে ‘মাশরাফি’। মাশরাফির পরিবার, নড়াইলে দূরন্ত কৌশিকের বেড়ে ওঠা, চিত্রা নদীর সঙ্গে মিতালি, নড়াইল এক্সপ্রেস হয়ে আবির্ভাব, মাঠের ভেতরে-বাইরে তার নাটকীয় ও রোমাঞ্চকর জীবন উঠে এসেছে এই বইয়ে। মাশরাফির জীবনী ভিত্তিক বই এটিই প্রথম। সোমবার খুলনায় টিম হোটেলেই মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান পরিণত হয়েছিল দারুণ এক আনন্দ আড্ডায়। আয়োজনে ছিলেন জিম্বাবুয়ে সিরিজের বাংলাদেশ স্কোয়াডের সব ক্রিকেটার ও কোচিং স্টাফের সবাই।

অনুষ্ঠানের আকর্ষণীয় এক অধ্যায় ছিল ব্যতিক্রমী সংবাদ সম্মেলন, যেখানে মাশরাফিকে ইচ্ছেখুশি প্রশ্ন করেছেন সতীর্থরা। চোট-জর্জরিত, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সেই সময়গুলোতে পেছন ফিরে তাকিয়ে আবেগআপ্লুত হলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।

ম্যাশ যাকে ‘হিরো’ বলে ডাকেন অধিনায়ক, সেই পেসার তাসকিন আহমেদের প্রশ্ন, ‘জীবনের এই পর্যায়ে আসবেন, আপনার জীবনী লেখা হবে, এটা ভাবতে পেরেছিলেন কখনও?’ মাশরাফির উত্তরে হাসল পুরো হলরুম, “হিরো, ভালো খেলো, তোমাকে নিয়ে এর চেয়েও বড় বই লেখা হবে!”

প্রশ্নোত্তরে ভীষণ মজা করলেন তামিম-মাহমুদউল্লাহরা। মাহমুদউল্লাহ শোনালেন ২০০৯ সালের এক গল্প। প্রথমবার অধিনায়ক হওয়ার পর দলের সবাইকে আলাদা করে খামে ভরে চিটি লিখে হাতে তুলে দিয়েছিলেন মাশরাফি, যাতে লেখা ছিল অনুপ্রেরণাদায়ী নানা কথা ও তার কাছে দলের চাওয়া। এতে দারুণ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। এত দিন পর এই উপলক্ষে মাশরাফিকে ধন্যবাদ জানালেন আনুষ্ঠানিকভাবে।

উপলক্ষটাকে অধিনায়কের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর মঞ্চ হিসেবে বেছে নিলেন তামিম ইকবালও। ২০১৫ বিশ্বকাপের সময় ক্রিকেট আঙিনা ছাপিয়ে গোটা দেশে তুমুল সমালোচনায় যখন ভেঙে পড়েছিলেন তামিম, একান্ত আপন একজনের মতোই মাশরাফি উজ্জীবিত করেছিলেন এই ওপেনারকে।

মঞ্চে উঠে আয়োজন মাতালেন জাতীয় দলের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেও। মজা করে বললেন, বাংলাদেশে মাশরাফির যে জনপ্রিয়তা, তাতে চাইলে সে রাজনীতিতে নামতে পারে! ম্যাচের আগে কিভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন মাশরাফি, সেটা অভিনয় করে দেখিয়ে কোচ বললেন, তবে মাঠে নামলে সে চোটের কথা সব ভুলে যায়। শতভাগ নয়, দুশ’ ভাগ ঢেলে দেয়।

ট্রেনার মারিও ভিল্লাভারায়ন জানতে চাইলেন, চোটের সঙ্গে বছরের পর বছর লড়াই করেও মনোবল না হারানোর গল্প। আনন্দ-আড্ডার মাঝেও এবার আবেগ ছুঁয়ে গেল অধিনায়ককে। চোট-পুনবার্সন-লড়াইয়ের সেই দু:সহ দিনগুলির কথা বলতে গিয়ে ধরে এল মাশরাফির কণ্ঠ, চোখের কোণে চিকচিক করল জল। বাস্পরুদ্ধ কণ্ঠে সামনে সারিতে বসা তাসকিন, আবু হায়দার রনিদের বললেন তার জীবন থেকে শিক্ষা নিতে।

ইমরুল কায়েসের প্রশ্নের উত্তরে অধিনায়ক জানালেন, ক্যারিয়ার শেষে নিজেরই ইচ্ছে আছে আত্মজীবনী লেখার।

বইটির প্রকাশক বাংলাদেশ ক্রিকেট সাপোর্টাস অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএসএ)। সমর্থক সংগঠনের কোনো ক্রিকেটারের জীবনী প্রকাশের ঘটনা ক্রিকেটে যথেষ্টই বিরল। এটিও দারুণ ভাবে ছুঁয়ে গেছে মাশরাফিকে। সমর্থকদের এভাবে বই প্রকাশ সত্যিই অনন্য এক ব্যাপার। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সম্পদ সমর্থকেরাই। আপনারা এভাবে আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবেন। শুধ ভালো সময়ে নয়, যখন খারাপ সময় আসবে, তখনও দলের পাশে থাকবেন।