বাড়ি ভাড়ার চাপে চ্যাপ্টা ঢাকার ভাড়াটিয়ারা

রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি হল সবার জন্য নিশ্চিত আবাসন। ১৪৬৩.৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট এ শহরে ঘুমাতে হয় প্রায় ২ কোটি মানুষকে। গত বছর জাতিসংঘ এক প্রতিবেদনে জানায়, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহরের তালিকায় ৭ম স্থানটি দখল করেছে আমাদের ঢাকা। আর ২০১৭ সালে জাতিসংঘের বসতি সংক্রান্ত উপাত্তের বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর এটি।
ঢাকার চিত্র দেখলে বোঝা যায় সে যেন তার নামের মতো করেই তার বাসিন্দাদের ঢেকে রেখেছে। একদিকে সংকীর্ণ বাসস্থান অন্যদিকে উচ্চ ভাড়া এ দুইয়ের চাপে পড়ে ঢাকাবাসী এখন অসহায়। তার ওপর প্রতিটি নতুন বছরের শুরুতে ভাড়া বাড়ানোর খড়্গ মানুষকে অর্থনৈতিক নির্যাতনের মুখে ফেলেছে। ঢাকায় এখন এমন অনেক বাড়িওয়ালা আছেন যারা কর্মজীবনে অন্য কিছু করেন না। শুধু ফ্লাটের ভাড়া তুলে সংসার চালান। ফলে ফি বছর ভাড়া বাড়ানোর চেষ্টা চালান। তাদের এ চেষ্টা বহু মানুষের তেষ্টা লাগিয়ে দিচ্ছে। সমীক্ষা বলছে, ঢাকা শহরের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকেন। ফলে ঢাকা যেন এখন আধুনিক যাযাবরের শহরে পরিণত হয়েছে। আরব ভূখণ্ডের যাযাবরদের মতো করেই নিদারুণ কষ্টে বছর কাটে ভাড়াটিয়াদের। নির্দিষ্ট বাসভূমি না থাকায় বিড়ম্বনাই যাদের নিত্য সঙ্গী। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। তবে বছর ঘুরলেই ভাড়া বাড়ে সেই সঙ্গে বাসা বদলের তাড়া বাড়ে ভাড়াটিয়াদের। ফলে সাধ্যের মধ্যে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে বছর বছর মানুষকে ঠিকানা বদলাতে হয়। বাসা বদলের যন্ত্রণা ও খরচ তাই ভাড়াটিয়াদের জন্য অত্যাচারের নতুন খড়্গ। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য এ শহরে আশ্রয় খোঁজা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। উচ্চবিত্তের জন্য সুরম্য অট্টালিকা ও বিলাসবহুল ফ্লাট যতটা তৈরি হচ্ছে বাকি দুই শ্রেণির জন্য ততটা নয়। ফলে উচ্চমূল্যের বহু ফ্লাট রাজধানীতে এখন ফাঁকা পড়ে থাকলেও সংকট রয়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের থাকার জায়গার। আর তাই বছর ঘুরতেই নোটিশ ঝোলে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির। নিরুপায় ও বাধ্য হয়েই এ দুই শ্রেণির মানুষকে অনেকটা যাযাবরের মতো করেই বাসস্থান বদলাতে হয়। অথচ বাসস্থান প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার।
এ বিষয়ে লক্ষ্য রেখে বাংলাদেশের সংবিধানে সব নাগরিকের আবাসনের কথা বলা হয়েছে (অনুচ্ছেদ ১৫ক)। সংবিধানেরে এ নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য ২০১৬ সালের জাতীয় গৃহায়ণ নীতিতে সাধ্যের মধ্যে সবার আবাসনের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে, বিশেষত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য। কিন্তু দেশের রাজধানী শহর ঢাকায় এখন সবচেয়ে বেশি আবাসন সংকটে রয়েছে এ দুই শ্রেণির মানুষ। তবে দেশের বাড়ি ভাড়া আইনেরও নেই সঠিক ব্যাবহার। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১ থাকলেও তার কোনো তোয়াক্কা নেই কোথাও। আইনের কোনো কার্যকারিতা না থাকায় বাড়িওয়ালার ইচ্ছা মতোই চলছে সব। তার মতে অমত হলে বিনানোটিশে বাড়ি ছাড়তে হবে। লিখিত চুক্তি, বাড়ি ভাড়ার পরিমাণ, ভাড়া আদায়ের পদ্ধত্তি, বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি প্রভৃতি বিষয়ে রাষ্ট্রীয় আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই।
বাড়ি ভাড়ার এ আইন ভাড়াটিয়াদের সুরক্ষায় কোন কাজেই আসছেনা বলা চলে। ফলে বাসাবাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে যাচ্ছেতাই নীতি চালান বাড়িওয়ালারা। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক প্রতিবেদন মতে, গত ২৫ বছরে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ। এদিকে ঢাকায় কান্না চাপা জীবনের নাম ব্যাচেলর লাইফ। অবিবাহিত ছেলে বা মেয়েদের বাসা ভাড়া দিতে চান না অধিকাংশ বাড়ির মালিক। ফলে ঢাকায় পরিবার নেই এবং অবিবাহিত এমন শিক্ষার্থী বা কর্মজীবীদের বাড়ি ভাড়া পাওয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে ডুমুরের ফুল। অধিকাংশ পুরুষ ব্যাচেলরদের বাড়ি ভাড়া নিতে গিয়ে শুনতে হয়, বউ না থাকলে বাসা ভাড়া দেয়া হবে না। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মাত্র ১০-১৫ শতাংশ হল বা ছাত্রাবাসে থাকে। আর বাকি ৮৫-৯০ শতাংশই (আনুমানিক ২০ লাখ শিক্ষার্থী) বাইরে বাসা ভাড়া করে থাকে।
অন্যদিকে চাকুরীজীবী ব্যাচেলরদের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। যারা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন এমন সঙ্গে ব্যাচেলর গার্মেন্টকর্মী আছেন ৫-৬ লাখ। সব মিলিয়ে প্রায় ৬০ লাখ ব্যাচেলর থাকেন রাজধানীতে। এ বিপুলসংখ্যক ব্যাচেলরের থাকার জায়গা নিয়ে এক কঠিন জীবনযুদ্ধের মোকাবেলা করতে হয়। অধিকাংশ ব্যাচেলরদের ভরসা হয়ে ওঠে বিভিন্ন বেসরকারি বাণিজ্যিক হোস্টেল ও মেসে। সেখানেও ভোগান্তির কোনো শেষ নেই। বিশেষ করে রাজধানীর ফার্মগেট ও তার আশপাশের এলাকায় এইচএসসি পরীক্ষার পর থেকে বাসা ভাড়ার হার বেড়ে যায় দ্বিগুণেরও বেশি। এ বিষয়ে প্রশাসনের কোনো মনিটরিং নেই। অপরদিকে মেয়ে ব্যাচেলর বা অবিবাহিত মেয়েদের জন্য বাসা পাওয়া আরও ভোগান্তির ব্যাপার। ছেলে ব্যাচেলরদের সব ভোগান্তিই মেয়ে ব্যাচালরদের সঙ্গী, সঙ্গে নিরাপত্তা সংকট উপরি পাওনা। যেসব বাসাতে মেয়ে ব্যাচেলরদের ভাড়া দেয়া হয় সেখানে থাকে সান্ধ্য আইনও। সন্ধ্যার পর তাদের চলাচলে আরোপ করা হয় নিষেধাজ্ঞা। ফলে যেসব শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইভিনিং মাস্টার্স করেন কিংবা যাদের অফিস রাত ৮টায় শেষ হয় তাদের এ শহরের বাঁকে বাঁকে থাকা যানজট ছাড়িয়ে বাসায় ফিরতে অনেক সময়ই ৯টা বা ১০টা বেজে যায়। এমন মেয়ে ব্যাচেলরদের বাড়ি ছাড়ার নোটিশ শোনার মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হয় যখন তখন।
তবে ‘ব্যাচেলররা ফ্ল্যাট নষ্ট করে ফেলেন। তারা বাড়িঘরের যত্ন নেন না’ বলে বাড়িওয়ালাদের অভিযোগ রয়েছে বরাবর। এ সব কারণে বাড়িওয়ালারা ব্যাচেলরদের ভাড়া দিতে চান না। ব্যাচেলর ও বাড়ির মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া পাওয়া নিয়ে বিড়ম্বনা বেশ পুরনো হলেও সেই বিড়ম্বনাকে চরম মাত্রা দিয়েছে জঙ্গি আতঙ্ক। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে কয়েকজন তরুণ জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটালে বাড়ির মালিকদের মধ্যে ‘ব্যাচেলর খেদাও’ মনোভাব দেখা যায়। ওই হামলার পর বহু বাড়ির মালিক ব্যাচেলরদের ভাড়া দেয়ার ইতি টেনেছেন। এ ছাড়াও হতাশা কিংবা প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যার প্রবণতাও তরুণদের মধ্যে বেশি থাকায় ব্যাচেলরদের ঠাঁই দিতে চান না বাড়ির কর্তারা।
এসব সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ মেস সংঘ দাবি জানিয়েছে, শহরে বসবাসরত ‘ব্যাচেলর’ ভাড়াটিয়াদের আবাসন নিশ্চিত করার জন্য সরকারিভাবে আবাসনের ব্যবস্থা করা, ‘ব্যাচেলরদের’ হয়রানি এবং বাড়ির মালিকদের ভাড়া বাড়িয়ে অর্থনৈতিক নির্যাতন ও উচ্ছেদ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজধানীতে বেশিরভাগ মানুষই ভাড়া থাকেন। কিন্তু এ বিশাল ভাড়াটিয়া জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকারের কথা কোনো জনপ্রতিনিধিরা বলেন না এবং তাদের অধিকার রক্ষা করেন না। ভাড়াটিয়ারা নানাভাবে অধিকারবঞ্চিত। টাকা দিয়ে ভাড়া থাকেন, কিন্তু কোনো সুবিধা পান না। তাই এবার ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সব দলের প্রার্থীদের নির্বাচনী ইশতেহারে ভাড়াটিয়াদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিতে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি। দাবিগুলো হল- ১. ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃক নির্ধারিত বাড়িভাড়া রেট কার্যকর করতে হবে। ২. বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১ কার্যকরে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। ৩. অযৌক্তিক বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি বন্ধ করতে হবে। ৪. ইচ্ছামতো বাড়ি ভাড়ার অগ্রিম নেয়া বন্ধ করতে হবে এবং ৫. ভাড়াটিয়াদের সব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে অধিকাংশ মানুষের বেতনের অর্ধেক যাচ্ছে বাড়ি ভাড়ায় আইনের প্রয়োগ না থাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাড়াবাড়ির শেষ নেই। ফলে বাড়ি ভাড়ার চাপে চ্যাপ্টা হচ্ছেন ভাড়াটিয়ারা। মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা বেতন পান এমন আয়ের মানুষদের বেতনের অর্ধেকটাই চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া বাবদ। ফলে পরিবারের সদস্যদের অনান্য চাহিদা পূরণে হিমশিম খেতে হচ্ছে নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষদের। খরচ কমাতে অনেকেই কর্মস্থল থেকে বেশ দূরে বাসা নিয়ে থাকেন। ফলে ঢাকার সামগ্রিক যানজট যেমন বাড়ে তেমনি বাসা দূরে হওয়ায় আয়ের একটা অংশ খরচ হচ্ছে যাতায়াত বাবদ। এমন একজনের কর্মস্থল গুলশান হলেও তিনি বাসা নিয়েছেন কর্মস্থল থেকে বেশ দূরে মোহাম্মাদপুরে। মাসে ১৬ হাজার টাকা শুধু বাড়ি ভাড়া বাবদই গুনতে হয় তাকে। সঙ্গে বিদ্যুৎ ও গ্যাস ভাড়া নিয়ে তা আরও ১৫০০ টাকার মতো বাড়িয়ে দিচ্ছে। রাজধানীতে দু’রুমের একটি মোটামুটি মানের ফ্লাটে থাকতে এখন ১৫-২৫ হাজার টাকা গুনতে হওয়ায় তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে অনান্য ক্ষেত্রে। এর ফলে কম আয় করা বাবার সন্তানেরা ভালো স্কুলে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন না, বঞ্চিত হচ্ছেন ভালো খাবার, সময়মতো চিকিৎসা ও বিনোদন থেকেও। আর এ বাড়তি বাড়ি ভাড়ার চাপে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলেও দাবি সচেতন সমাজের।