English Version
আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ১২:৪৩
সূত্র:

রাসায়নিকের মজুদ সরানো শুরু

রাসায়নিকের মজুদ সরানো শুরু

পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকার ওয়াহিদ ম্যানশনের বেইসমেন্টে গোপনে মজুদ করে রাখা রাসায়নিকের বস্তা মাথায় নিয়ে একের পর এক বের হচ্ছিল শ্রমিকরা। রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা ট্রাকে তোলা হচ্ছে সেগুলো। পাশে দাঁড়িয়ে তদারক করছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। সঙ্গে ছিলেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের একজন রেজিস্ট্রার। খাতা-কলম নিয়ে বসে আছে মালিকপক্ষের লোকজন।

দুপুর ১টা ২০ মিনিটের দিকে অবৈধভাবে মজুদ করা এসব রাসায়নিক সরানো শুরু হয়। সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এক হাজার বস্তা বের করে ট্রাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

তদারকির দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা মোরাদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কখন যে শেষ হবে তা বলা যাচ্ছে না। সারা রাত লেগে যেতে পারে।’

গতকাল শনিবার চুড়িহাট্টা মোড়ে আলোচিত এই ভবনের বেইসমেন্ট থেকে রাসায়নিকের মজুদ সরানোর কাজ করছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এ সময় রাসায়নিক ব্যবসার পক্ষের লোকজন পরিবেশ অশান্ত করার চেষ্টা করে। এর মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। ওয়াহিদ ম্যানশন থেকে রাসায়নিক সরানোর মধ্য দিয়ে পুরান ঢাকাকে রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানামুক্ত করার ঘোষণা দিয়ে মেয়র বলেন, ‘এলাকায় যেসব বাড়িতে রাসায়নিকের গুদাম আছে, তা দ্রুত সরিয়ে নিতে হবে। কোনো বাড়িতে রাসায়নিকের গুদাম পাওয়া গেলে সেই বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ হুঁশিয়ার করে তিনি বলেন, এ এলাকার সব বাড়ির মালিক, ব্যবসায়ীরা যাতে নিজ বাড়ির নিচে গুদামে রাসায়নিক মজুদ রাখতে না পারে সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে। কেউ যদি এ রকম তথ্য পায় তাহলে চকবাজার থানায় যোগাযোগ করলেই তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মেয়র সাঈদ খোকন যখন ওয়াহিদ ম্যানশনের সামনে দাঁড়িয়ে এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছিলেন তখন তাঁর আশপাশে অবস্থান নিয়েছিলেন স্থানীয় রাসায়নিক ব্যবসায়ীরা। তবে মেয়র যতক্ষণ ছিলেন তারা চুপ করে ছিলেন। যেই মেয়র এলাকা ত্যাগ করেন, তখন তারা গলাবাজি শুরু করেন। এ সময় ইমরান নামের একজন বলতে থাকেন, ‘এটা মগের মুল্লুক পাইছে, কইলেই হইল, আমগো বাপ-দাদার ব্যবসা আমরা ক্যামনে ছাড়ুম? ছাড়তে পারুম না। আগুন লেগেছে গ্যাস সিলিন্ডার থাইক্যা, সবাই কইতাছে ক্যামিক্যাল থাইক্যা।’

রাসায়নিকের মজুদ সরানো শুরু

ওয়াহিদ ম্যানশনের বেইসমেন্ট থেকে রাসায়নিক সরানোর তদারক করছিলেন চকবাজার থানার পরিদর্শক মোরাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ওয়াহিদ ভবনে থাকা সব দাহ্য পদার্থ সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কারণ ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ। এভাবে থাকলে যেকোনো সময় আরো বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাঁর পাশেই ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এক্সিকিউটিভ রেজিস্ট্রার মাসুদ রানা। তিনি বলেন, এসব দাহ্য পদার্থ ওয়াহিদ ম্যানশন থেকে সরিয়ে সিটি করপোরেশনের হেফাজতে নেওয়া হচ্ছে। পরে মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এর একটি সুরাহা করা হবে।

মালিকপক্ষের হয়ে হিসাব রাখছিলেন ফরিদ উদ্দিন আহমেদ নামের একজন। তিনি বলেন, এগুলো সিটি করপোরেশন নিলেও পরে তাদেরকে ফেরত দিতে হবে। কারণ এটি ব্যবসায়ী পণ্য। ভবনের নিচে থাকা কনটেইনার সরানোর খবর পেয়ে সেখানে ভিড় জমায় শত শত মানুষ। তাদের ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের সদস্যরা। ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এই ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বের করা কেমিক্যালের হিসাব ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে রাখা হচ্ছে।

বুধবার রাতে চুড়িহাট্টা মোড়ে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় পুড়ে মারা গেছে ৬৭ জন। দগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে বেশ কয়েকজন। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচটি ভবনের মধ্যে ওয়াহিদ ম্যানশনের বেইসমেন্টে রাখা বস্তা ও ড্রামভর্তি রাসায়নিক অক্ষত থেকে যায়।

ওয়াহিদ ম্যানশনের মালিকদের দেখা নেই : ভবনটির মালিক হাজী ওয়াহিদ অনেক আগেই মারা গেছেন। তাঁর ছেলে সোহেল ও হাসান বর্তমানে বাড়ির মালিক। ঘটনার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত তাঁরা ভবনে ঢোকেননি বলে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। পুলিশ জানায়, তাঁরা এখন মামলার আসামি। তাঁদেরকে খোঁজা হচ্ছে।

আগুনের সূত্রপাত নিয়ে বিতর্ক চলছেই : প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই ঘটনার সময় আগুনের লেলিহান শিখা দেখলেও এর সূত্রপাত সম্পর্কে তারা কোনো তথ্য দিতে পারেনি। দায়িত্বশীল কোনো সূত্র এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি কিভাবে আগুন লাগল। এ নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে। চুড়িহাট্টা মোড়ে দাঁড়িয়ে কথা হয় ইমরান নামের একজন বাড়ির মালিকের সঙ্গে। তাঁর বাড়ির নিচতলায় রাসায়নিকের গুদাম, প্রসাধনসামগ্রীর পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকান ভাড়া দেন তিনি। তিনি ছাড়াও মো. মুসলিম, মফিউজ্জামান, হুমায়ন কবির, ইয়াসিন আলীসহ আরো কয়েকজন বাড়ির মালিক আগুন লাগার জন্য গ্যাস সিলিন্ডারকে দায়ী করেন।

নাসিরউদ্দিন নামের একজনকে দেখা গেল ওয়াহিদ ম্যানশনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে। কাছে গিয়ে কথা বলতেই তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, আগুনে তিনি তাঁর একমাত্র ছেলে ওয়াসিউদ্দিন মাহিদকে হারিয়েছেন। তিনি এই আগুনের জন্য রাসায়নিককেই দায়ী করেন।

রাসায়নিকের কারণে আগুন লেগেছে—কাউকে এ কথা বলতে শুনলেই ব্যবসায়ীরা তার দিকে তেড়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে পুড়ে যাওয়া পিকআপ, প্রাইভেট কার, অটোরিকশা, মালটানা ভ্যান, মোটরসাইকেল, মানুষের ব্যবহৃত স্যান্ডেল, ব্যাগ—এসব সরিয়ে নিচ্ছিলেন।

আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ওই এলাকার রাজমহল হোটেলের ক্লোজড সার্কিট (সিসি) টিভি ক্যামেরার ফুটেজ পাওয়া গেছে। পুলিশ বলছে, ফুটেজে দেখা গেছে, বুধবার রাত ১০টা ৩২ মিনিটে বিস্ফোরণ হয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় হোটেলের কর্মীরা কাজে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ আগুন দেখতে পেয়ে তারা দিগ্বিদিক দৌড় শুরু করে।

গতকাল কালের কণ্ঠ’র কাছেও এ রকম একটি ফুটেজ এসেছে। তবে ফুটেজের ছবি স্পষ্ট নয়। রাজমহল হোটেলের সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়া ফুটেজে দেখা গেছে, রাত ১০টা ৩২ মিনিটে প্রথম বিস্ফোরণ হয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এতে হোটেলের সামনের অংশ ধসে পড়ে এবং ইট ও বোতল হোটেলের দিকে উড়ে আসে। সড়কে থাকা মানুষজনকে আগুন ও ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে বের হয়ে দৌড়াতে দেখা যায়। ঘটনাস্থল ওয়াহিদ ম্যানশনের সামনে তখন একটি পিকআপ দাঁড়ানো ছিল। এতে ছিল গ্যাস সিলিন্ডার।

ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) কামাল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, হোটেল রাজমহলের একটি সিসিটিভি ক্যামেরাসহ আশপাশ থেকে আরো কিছু ফুটেজ সংগ্রহ করে আগুন লাগার সঠিক কারণ জানার চেষ্টা চলছে।

বিদ্যুতের লাইন মেরামত : গতকাল সকাল থেকে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বৈদ্যুতিক খুঁটি ও লাইন মেরামতের কাজ চলছিল। এরই মধ্যে কিছু জায়গায় সংযোগ চালু হয়েছে। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) লালবাগ জোনের এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার হরিচাঁদ হালদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঘটনাস্থলে কোনো ট্রান্সমিটার ছিল না। আগুন অন্য কারণে লেগেছে।’

এক গলিতেই পাওয়া যায় ২৬ লাশ : চুড়িহাট্টায় আগুন লাগার পর ওয়াহেদ ম্যানশনের সিঁড়ির পাশের একটি সরু গলিতেই ২৬টি লাশ পায় ফায়ার সার্ভিস। এরপর ওই এলাকার একটি ডেকোরেটরের দোকান থেকে আটটি লাশ এবং দুটি ওষুধের ফার্মেসি থেকে আরো আটটি লাশ উদ্ধার করা হয়। বাকি লাশের বেশির ভাগ ওয়াহিদ ম্যানশনের সামনের রাস্তা থেকে উদ্ধার করা হয় বলে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের লালবাগ জোনের ফায়ার স্টেশনের লিডার সাইদুল করিম। তিনি বলেন, ‘আমি ২৪ বছর ধরে ফায়ার সার্ভিসে চাকরি করছি। অনেক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উদ্ধার তৎপরতা চালিয়েছি। কিন্তু একসঙ্গে এতগুলো লাশ কখনো উদ্ধার করিনি।’