বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে ফ্লাইওভারে বৃষ্টির পানি জমে’
বৃষ্টিতে ঢাকায় জলাবদ্ধতা নতুন কিছু নয়। তবে এ জলাবদ্ধতা নগরীর প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি ছাড়িয়ে এখন পৌঁছেছে ফ্লাইওভারে। বৃহস্পতিবার (৩১ মে) এমন চিত্র দেখা গেছে মগবাজার-মৌচাক, খিলগাঁও ও মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে। বৃষ্টি শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরও ফ্লাইওভারে পানি জমে ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতির কারণে ফ্লাইওভারে পানি জমছে। এভাবে পানি জমলে যানচলাচলে ঝুঁকির পাশাপাশি ফ্লাইওভারের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত রাজধানীতে ৮১ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়। টানা তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতে নগরীর বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। যানবাহনগুলোকে ফ্লাইওভারে ওঠার পরও দুর্ভোগ পিছু ছাড়েনি। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকেই।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ফ্লাইওভারে জলাবদ্ধতা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার নয়। নকশায় ত্রুটি ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা না নিয়ে একের পর এক ফ্লাইওভার নির্মাণ করায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের বেশ কয়েকটি স্থানে পানি জমে আছে। ফ্লাইওভারের চৌধুরীপাড়ার অংশের কয়েকটি স্থানে পানি জমেছে। মগবাজার ওয়ারলেস গেট সংলগ্ন উপরের অংশেও পানি জমে আছে। সোনারগাঁওমুখী লুপেও জমে ছিল পানি। এসব স্থানের পানি দুপুরেও অপসারণ হয়নি। তাছাড়া ফ্লাইওভারটির দুটি ট্রাফিক সিগন্যালের সংক্রিয় কোনও বাতি কার্যকর নেই। ফলে যানবাহনগুলোকে ঝুঁকি নিয়ে ট্রাফিক সিগন্যাল পার হতে হয়।
ফ্লাইওভারে পানি জমে আছেদুপুরের দিকে এ ফ্লাইওভারের শান্তিনগর অংশ দিয়ে প্রবেশ করে চৌধুরীপাড়া লুপ দিয়ে রামপুরায় আসেন একটি প্রাইভেট কারের চালক রাজিব উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘দেশের বাইরেও গাড়ি চালিয়েছি। অনেক ফ্লাইওভারে ওঠার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু সেগুলো আমাদের দেশের ফ্লাইওভারের মতো নয়। ভারী বর্ষণ হলেও একটু পানি জমে না।’
অন্যদিকে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের চানখারপুল অংশের লুপেও জলাবদ্ধতা দেখা গেছে। এই অংশে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা দেখা দেয় বলে জানান এ পথের যাত্রী ও পরিবহন চালকরা। জলাবদ্ধতা নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনও কাজ শুরু হয়নি বলে জানিয়েছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
খিলগাঁও ফ্লাইওভারেও একই চিত্র দেখা গেছে। একটু ভারি বর্ষণ হলেই ফ্লাইওভারটির বিভিন্ন অংশে জামি জমে যায়। তাছাড়া এই ফ্লাইওভারের অনেক জায়গায় বাতি না থাকায় সন্ধ্যার পর অন্ধকার হয়ে পড়ে। ফ্লাইওভারটির পানি অপসারণের বিভিন্ন সংযোগ লাইন বন্ধ হয়ে পড়েছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফ্লাইওভারে পানি জমে যাওয়া মোটেও কাম্য নয়। আমরা শুধু উন্নয়নের মহড়ায় আছি। কিন্তু উন্নয়ন কাজের রক্ষণাবেক্ষণে মোটেও নজর নেই। কারণ সেখানে পয়সা নেই। আমাদের উচিত হবে উন্নয়ন যেমন করছি সেটা রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা। কিন্তু এতে যেহেতু অর্থ নেই সে কারণে কেউ দায়িত্ব নেয় না। তাই এখাতেও অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের অবস্থা খুবই খারাপ। অনেক বলার পর কিছু অংশে এখন পাইপ দেওয়া হয়েছে। তাও নিচের ড্রেন পর্যন্ত সংযোগ দেওয়া হয়নি। আর ফ্লইওভারে পানি জমে থাকলে স্ট্রাকচারের ক্ষতি করে। রডে পানি জমলে মরিচা ধরে রড ফুলে যায়। তখন কংক্রিট ফেটে যায়। যার ফলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ফ্লাইওভারে পানি জমতে দেওয়া যাবে না। এতে স্থাপনার স্থায়িত্ব অনেক কমে যাবে।’
একই কথা বলেন অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিটিউটের (এআরআই) পরিচালক ও বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফ্লাইওভারে পানি জমে থাকার কোনও কারণ নেই। পানি নিষ্কাশনের লাইনগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এটা হয়েছে। কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই দায়িত্ব নিয়ে এর তদারকি করতে হবে। এভাবে পানি জমে থাকলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়বে ফ্লাইওভার। তাছাড়া দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।’
এদিকে ফ্লাইওভারে পানি জমা নিয়ে অনেকেই হাস্যরস করেছেন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেগুলোতে এ নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। তাহকীক খান নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ফ্লাইওভারে জলাবদ্ধতার ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘হাস্যকর হলেও সত্যি জলাবদ্ধতা এবার মগবাজার ফ্লাইওভারের উপরে।’
মালিবাগ-মৌচাক ফ্লাইওভারের প্রকল্প পরিচালক সুশান্ত কুমার পাল বলেন, ‘বিষয়টি আমরা শুনেছি। ফ্লাইওভারগুলোর পানি অপসারণের মুখগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এমনটা হতে পারে। এটা ছোট একটা কাজ, রক্ষাণাবেক্ষণের বিষয়। এগুলো করবে সিটি করপোরেশন। আমরা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সিটি করপোরেশনকে চিঠি দিয়েছি। তারা তদারকি করবে। এর রক্ষণাবেক্ষণের ম্যানুয়াল তৈরি করে তাদের দিয়েছি। আশা করি ঠিক হয়ে যাবে।’
একাধিকবার ফোন করেও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মো. বিলালকে পাওয়া যায়নি।