English Version
আপডেট : ৫ জুন, ২০১৬ ১৫:৫৭

রাজধানীর জনজীবন তীব্র পানি সংকটে

অনলাইন ডেস্ক
রাজধানীর জনজীবন তীব্র পানি সংকটে

মৌসুম শুরু হতে না হতেই রাজধানীতে সুপেয় পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কোথাও কোথাও ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ আর ময়লা-আবর্জনা আসছে। গত দু’সপ্তাহ ধরে চলমান এ পরিস্থিতিতে নগরীর বেশকিছু এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তবে এরপরও দুর্ভোগ নিরসনে ওয়াসার পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় নগরবাসী ক্ষোভে ফুঁসছে। এ নিয়ে এরই মধ্যে বিক্ষুব্ধ মানুষ রাস্তা অবরোধসহ নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করেছেন। দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দেয়া না হলে তারা কঠোর আন্দোলনে নামারও হুমকি দিয়েছে। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, বৈশাখের শুরুতেই যেভাবে দাবদাহ বইছে, তাতে নগরীতে পানির চাহিদা আরো বাড়বে। এ সময় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আরো নেমে যাওয়ায় ওয়াসার পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সত্যিকার অর্থেই কঠিন হবে। আর স্বাভাবিকভাবেই স্বার্থান্বেষী মহল জনক্ষোভকে উসকে দেয়ার সুযোগ খুঁজবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রামপুরা, মগবাজার, আজমপুর, কাঁঠালবাগানসহ মিরপুর-১, ১০ ও ১৪ নাম্বার, সেনপাড়া ও পর্বতা এলাকা, মোহাম্মদপুরের কাটাসুর, ধানম-ির কিছু এলাকা, কলাবাগান, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, মগবাজার, মালিবাগ, ওয়্যারলেস গেট, পুরান ঢাকার সতীশ সরকার লেন, দীননাথ সেন রোড, গেন্ডারিয়া এবং পাশের ধূপখোলায় পানির তীব্র সঙ্কট চলছে। এসব এলাকায় ওয়াসার লাইনে তিন-চার দিন ধরে পানি আসে না বললেই চলে। কোনো কোনো জায়গায় আবার ওয়াসার পানির লাইনে দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত বিরতিতে খোঁড়াখুঁড়ি চলায় নোংরা-দুর্গন্ধযুক্ত পানি আসছে। এসব এলাকার লোকজন দফায় দফায় পানির সঙ্কটের কথা ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে জানালেও সেই সঙ্কট থেকে মুক্তি মিলছে না। স্থানীয়রা জানান, পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার, পাটুয়াটুলী, পানিটোলা, রাজার দেউড়ি, সদরঘাট ও আশপাশের এলাকায় বাসিন্দারা বাসাবাড়িতে যৎসামান্য পানি পেলেও সেই পানি সুপেয় তো নয়ই, বরং থালাবাসন-কাপড় ধোয়া কিংবা গোসলেরও অনুপযোগী। রামপুরা, বনশ্রী এলাকায় ওয়াসার পানিতে উৎকট দুর্গন্ধ। অন্যদিকে, ওয়াসার পানির পাম্প থেকেও টাকা ছাড়া পানি পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়াসহ নানা কারণে নগরবাসী এ দুর্ভোগে পড়েছে। তবে ভারী বর্ষণ শুরু হলে পানি সঙ্কট কেটে যাবে। এ নিয়ে যাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা কিংবা নাশকতার ঘটনা না ঘটে এজন্য আগেভাগেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা চাওয়া হয়েছে। বিশেষ করে পানির পাম্প ও ওয়াসা কার্যালয় সুরক্ষিত রাখার তাগিদ রয়েছে। এ ছাড়াও যেসব এলাকায় পানি সঙ্কট হবে সংশ্লিষ্ট জোনের দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে বিষয়টি দ্রুত থানা পুলিশকে অবহিত করে আগাম নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য অনুরোধ করতে বলা হয়েছে। এদিকে একই ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করে দায়িত্বশীল একটি গোয়েন্দা সংস্থা সরকারকে সতর্ক করেছে। মাঠ পর্যায়ের সরেজমিন অনুসন্ধানি ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পানি সঙ্কট নিয়ে সৃষ্ট জনক্ষোভকে পুঁজি করে একাধিক চক্র নাশকতা চালানোর ছক অাঁটছে। নিম্নবৃত্ত ও শ্রমিকশ্রেণির জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি ভাড়াটে পিকেটারদেরও তারা জোগাড়ের চেষ্টা চালাচ্ছে। এ চক্রের বেশ ক’জন হোতার নামও তারা হাতে পেয়েছে। গোয়েন্দা ওই প্রতিবেদনে পানি সঙ্কট নিরসনে সরকারের সক্রিয় ভূমিকা রাখার পাশাপাশি এ নিয়ে যাতে কেউ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া পানি সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে যারা জনগণকে উসকে দেয়ার চেষ্টা করছে তাদের তালিকা তৈরির পাশাপাশি এর নেপথ্য হোতাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে। এদিকে পানি সঙ্কটে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী শনিবার দুপুরে রাজধানীর মেরুল বাড্ডা সড়ক অবরোধ করে। দুপুর পৌনে ১২টা থেকে প্রায় আধা ঘণ্টা তারা রাস্তায় অবস্থান নিলে গোটা এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তা আরো বেগতিক রূপ নেয়। তবে পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে পানি সরবরাহ করায় এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপে এলাকাবাসী অবরোধ তুলে নেয়। এলাকাবাসী জানান, এই এলাকায় অনেক দিন ধরে পানির সমস্যা চলছে। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ কোনো সমাধান করছে না। তাই তারা বাধ্য হয়ে সড়ক অবরোধ করেছে। এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে আরো কঠোর কর্মসূচি নেয়া হবে বলেও হুমকি দেন তারা। স্থানীয় বাসিন্দা মরিয়ম বিবি জানান, গত ছয়দিন ধরে ওয়াসার লাইনে ঠিকমতো পানি পাচ্ছেন না। মাঝরাতে সামান্য পানি এলেও তা কর্দমাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত। যা পান করা দূরে থাক গোসলেরও অনুপযোগী। তাই কয়েকদিন ধরে ছেলে মেয়েদের দিয়ে পাম্প থেকে পানি সংগ্রহ করে জীবন চালাচ্ছেন। পানি সঙ্কটের কারণে প্রচ- গরমের মধ্যেও গত দু’দিন গোসল করতে পারেননি বলেও জানান মরিয়ম বিবি। এর আগে গত ৯ এপ্রিল শনিবার ওয়াসার বিশুদ্ধ পানির দাবিতে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ মিছিল করে সিদ্ধিরগঞ্জের এলাকাবাসী। এ সময় রাস্তার দু’ধারে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর অভিযোগ, ওয়াসার লাইনে সরবরাহ হওয়া ময়লা পানি পান করে প্রতিদিনই বিপুল নারী, পুরুষ ও শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। বিভিন্নস্থানে ওয়াসার ফেটে যাওয়া পাইপ দিয়ে ময়লা পানি প্রবেশ করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ করেন সিদ্ধিরগঞ্জবাসী। এর আগে ২ এপ্রিল রাজধানীর পল্লবীতে বিক্ষোভ করেন স্থানীয় একটি বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দারা। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মিরপুরের ১১ নাম্বার সেকশনের সি-বস্নকের এমসিসি ক্যাম্পের বাসিন্দারা এভিনিউ-৫-এর পানির পাম্পের সামনে অবস্থান করে বিক্ষোভ করেন। পরে গাড়িতে করে ক্যাম্পে পানি সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি পেয়ে তারা ক্যাম্পে ফিরে যান। ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান, এমসিসি ক্যাম্পে পাঁচদিন ধরে পানি নেই। তাই বাধ্য হয়ে বিক্ষোভ করেছেন। পানি সঙ্কটে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী চলতি মাসের শুরুতে মগবাজার এলাকাতেও দু’দফা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এর এক পর্যায়ে তারা রাস্তা অবরোধের পরিকল্পনা করলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আশ্বাসে তারা ঘরে ফিরে যায়। তবে ওইসব এলাকায় এখনো পানি সঙ্কট কাটেনি বরং আগের চেয়ে অবস্থা আরো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্থানীয়রা। এ নিয়ে শিগগিরই আন্দোলনে নামবে বলেও হুমকি দেন তারা। মগবাজার এলাকার গৃহবধূ মনোয়ারা বেগম বলেন, তিনদিন ধরে কলে পানি নেই। গোসল করা বন্ধ হয়ে গেছে, অজু করার পানিও নেই। দোকান থেকে পানি কিনে এনে ভাত রান্না করতে হচ্ছে। এভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকলে ওয়াসার দায়িত্বটা কি? মধুবাগের বাসিন্দা শেফালী বেগম বলেন, ‘পানি সঙ্কট দেখা দেয়ায় পরিস্থিতি অনেক কষ্টকর হয়ে উঠেছে। এতদিন ওয়াসার দুর্গন্ধযুক্ত পানি পেতাম। এখন তাও পাচ্ছি না।’ ‘ওয়াসার লাইনে পানির চাপ খুবই কম। একটু একটু করে যা আসে তাতে ঘরের কাজই শেষ করা যায় না’_ জানান মগবাজারের ব্যবসায়ী আবুল হোসেন। ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ জানায়, রাজধানীতে ওয়াসার পক্ষ থেকে যে পানি সরবরাহ করা হয় তা অন্য সময়ের চাহিদা পূরণ করলেও গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রায়ই দেখা দেয় সঙ্কট। রাজধানীর পানি সরবরাহে ওয়াসার তিনটি পানি শোধনাগার রয়েছে। এর পাশাপাশি রয়েছে ৭৩০টি গভীর নলকূপ। সব মিলিয়ে প্রতিদিন ২৪৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করে ওয়াসা। ওয়াসার কর্মকর্তাদের মতে, নগরবাসীর চাহিদার তুলনায় তারা বেশি পানি উৎপাদন করছেন। তবে পাইপলাইনের ত্রুটির কারণে অনেক এলাকায় পানি পৌঁছে না। যান্ত্রিক কারণে কখনো কখনো পানি উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে। পানির লাইন সংস্কারকাজের জন্যও সরবরাহে বিঘ্ন হয়। তবে যে কারণেই পানি সরবরাহে বিঘ্ন হোক না কেন গ্রীষ্মের দাবদাহের সময় পানি সঙ্কট হলে তা কেউ মানতে চান না। ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান পানি সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, ওয়াসার ৭১৫টি গভীর নলকূপের পাম্পের মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ১৪টি বন্ধ থাকে। এজন্য রাজধানীর প্রায় দুই লাখ মানুষ পানি পায় না। তিনি জানান, যান্ত্রিক ত্রুটি, রক্ষণাবেক্ষণের কাজ, পানির স্তর নেমে যাওয়াসহ নানা কারণে প্রতিদিন ওয়াসার ১৪টি পাম্প বন্ধ থাকে। একটি পাম্প থেকে ১৫ হাজার মানুষ পানি পায়। সেই হিসাবে প্রায় দুই লাখ লোক পানি পায় না। তবে এবার শুকনো মৌসুমে ঢাকায় পানির বড় কোনো সঙ্কট হবে না। এমডি বলেন, এখন মগবাজার, যাত্রাবাড়ী, রামপুরাসহ কিছু পকেট এলাকায় (রাস্তার প্রান্তসীমায়) সাময়িক সমস্যা হচ্ছে। এই সমস্যাও যাতে না থাকে, তার জন্য তারা বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সমস্যা মোকাবিলায় ১০টি নতুন পাম্প বসানো হচ্ছে এবং ১৫টি প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সময় পানির পাম্প চালু রাখতে ওয়াসার ৪৫৮টি জেনারেটর প্রস্তুত আছে। ২২১টি দ্বৈত (ডুয়েল) বিদ্যুৎ সংযোগযুক্ত পানির পাম্পও রয়েছে। অলিগলিতে পানি সরবরাহের জন্য ১৬টি ট্রাক্টর রয়েছে। রয়েছে ৩৬টি পানির গাড়ি। চলতি বছরের মধ্যেই ঢাকার বস্তিগুলোর অবৈধ পানির সংযোগ বৈধ করা হবে বলে জানান তিনি।