তোমরা যারা পাকিস্তানকে সাপোর্ট কর; পাকিস্তানী লন পড়..

কয়েকদিন আগের কথা। রাস্তায় হঠাৎ এক স্কুলফ্রেন্ডের সাথে দেখা। প্রায় ১০ বছর পর দেখা, দাড়ি রেখেছে, একেবারে চেনাই যায় না। জোর করে বাসায় ধরে নিয়ে গেলো। আন্টি তো আমাকে দেখে অনেক খুশি, কতদিন পর দেখা। ড্রইংরুম পার হয়ে ওর রুমে ঢুকতেই চোখে পড়ল শহীদ আফ্রিদি আর সাইদ আজমলের বিশাল দুইটা পোস্টার, দেয়ালে ঝুলতেছে। একটা ধাক্কা লাগলো।


ঠিক সেই মুহূর্তে ওর ছোট বোন ঘরে ঢুকলো। ঢুকেই কোনোদিকে না তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে ভাইয়ের কাছে যেয়ে বলল, ভাইয়া, টাকা দে।
—কেন?
—লন কিনবো। কালকে মার্কেটে পাকিস্তানি লন দেখে আসছি, নতুন আসছে। আম্মুকে টাকা দিতেছে না। দে না ভাইয়া, প্লিজ…
হঠাৎ তার আমার উপর চোখ পড়লো। থতমত খেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো, তারপর চিনতে পারলো। জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছো জেসমিন?
—এই তো ভাইয়া ভালো। আপনি কেমন আছেন?
—ভালো। আচ্ছা জেসমিন, তোমার বয়স তো এইবার ১৬ হইলো, তাই না?
—(একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে) ইয়ে মানে, হ্যা।
—ওদের বয়সও ছিলো তোমার মতোই। এই ১৫-১৬ হবে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে টাঙ্গাইল থেকে পাকিস্তানি সেনারা যখন পালিয়ে গেলো, তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা ঘাঁটিতে মুক্তিযোদ্ধারা বেশকিছু বাংকার দেখতে পায়। একজন মুক্তিযোদ্ধা একটা বাংকারে নেমে মেয়েগুলোকে দেখতে পান। কারো গায়ে এক টুকরো কাপড় নেই, পাকিস্তানি পশুগুলোর কামড় আর আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত পুরো শরীর, নিথর পড়ে আছে। দ্রুত উপরে উঠে সেই মুক্তিযোদ্ধা চাদর আর শার্ট খুলে আনলেন বাকিদের গা থেকে, ঢেকে দিলেন মেয়েগুলোর শরীর। তাদের তুলে আনার সময় হঠাৎ তার চোখে পড়লো ঘরের কোনায় কি যেন স্তুপ হয়ে আছে। কাছে গিয়ে স্থির হয়ে গেলেন তিনি। চার-পাঁচটা মেয়ে, একটা স্তুপের মতো, স্তনগুলো খুবলে তুলে নেওয়া হয়েছে, দু পায়ের ফাঁক দিয়ে রক্তের স্রোত এসে জমাট বেঁধে গেছে। একপাশে আরেকজনের বুক পর্যন্ত টান দিয়ে ফেড়ে ফেলা হয়েছে, পাশে একটা বেয়নেট, জমাট রক্তে কালো হয়ে গেছে রঙটা।
—(আমার বন্ধু হঠাৎ আমাকে থামিয়ে দিলো) তুই এইসব কইথেকে জানলি? — মেয়েগুলোকে ট্রিটমেন্টের জন্য রেডক্রস টিমের কাছে হ্যান্ডওভার করার সময় এক ব্রিটিশ সাংবাদিক জানতে চাইছিলেন, তখন ওই মুক্তিযোদ্ধা তাকে এই ঘটনাটা জানান। পরবর্তী সময়ে এই মানুষটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন, তিনি নাকি সবসময় সবখানে ওই পাঁচটা মেয়ের লাশ দেখতে পেতেন।

বন্ধু কি যেনো বলতে চাইলো, হাত তুলে থামালাম। আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেছে তখন… —চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বধ্যভূমির জাস্ট একটা গর্ত থেকেই পাওয়া গেছে ১১০০ মাথার খুলি, সেখানে এরকম গর্ত ছিলো অসংখ্য। মুক্তিযুদ্ধের পর এক পাকিস্তানি টর্চার সেল থেকে পাওয়া গেছে একড্রাম চোখ, বাঙ্গালিদের চোখ। এই মানুষগুলোরে কারা মারছিলো জানিস? পাকিস্তানি সেনারা মারছিরো। কেন মারছিলো জানিস? পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার অজুহাতে, পাকিস্তানের জন্য। তুই যাদের মুসলমান ভাই বলে বুকে টেনে নিতেছিস, তারাও ওই পাকিস্তানের জন্যই খেলে, পাকিস্তানের জন্য গর্ববোধ করে। তাই আমি পাকিস্তান সমর্থন করি না। কেননা পাকিস্তান সমর্থন করলে তোর বোনের মত মিষ্টি চেহারার ওই নিষ্পাপ মেয়েগুলোর সাথে বেঈমানি করা হবে, পাহাড়তলি বধ্যভূমির মতো এরকম হাজারো বধ্যভূমির অসংখ্য শহীদের সাথে বেঈমানি করা হবে, তাদের তাজা রক্তের সাথে বেইমানি করা হবে। তুই বেঈমান হতে পারিস, আমি না। বিদায়…

আজকে আধুনিক প্রজন্মের আপডেটেড ছেলেপেলে খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেশাতে মানা করে, আফ্রিদি আর আজমল তাদের মুসলমান ভাই। প্রজন্ম ভুলে যায় রাহেলা বেগমের কথা, ২৫শে মার্চের সেই বিভীষিকার রাতে পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে বাঁচতে খাটের নিচে লুকিয়েছিলো, ১৫ দিনের দুধের বাচ্চাটাকে প্রচণ্ড আতংকে নিজের অজান্তেই শক্ত করে চেপে ধরেছিলো বুকের মধ্যে, একটু পর দেখে, দম আটকে বাচ্চাটা মারা গেছে। এরপর রাহেলা পাগল হয়ে গিয়েছিলো, সবসময় একটা পুতুল কোলের ভেতর সাবধানে লুকিয়ে রাখতো, আপনমনে বিড়বিড় করতো, খোকন সোনা চাঁদের কনা…
প্রজন্ম, কি ভয়ংকর আতংকিত হলে একটা দুধের বাচ্চা এইভাবে মায়ের কোলে মারা যায়, চিন্তা করতে পারো? কত নিকৃষ্ট অমানুষ হলে মায়ের কোল থেকে বাচ্চাকে টান দিয়ে নিয়ে দেয়ালে আছড়ে ফেলে মাকে ধর্ষণ করতে পারে ওরা, কল্পনা করতে পারো? কতটা নৃশংস বর্বর হলে এক রাতের মধ্যে ৫০ হাজার মানুষকে ইসলামের নামে মেরে ফেলা যায়, একবার ভাবো তো? এইগুলো রূপকথা না প্রজন্ম, এইগুলো তোমার জন্মইতিহাস। একটা শুয়োরও তার জন্ম ইতিহাস অস্বীকার করতে পারে না, তুমি কিভাবে অস্বীকার করো? কিভাবে পাকিস্তান সমর্থন করো? কিভাবে?
উৎসর্গ : যেসব বাংলাদেশী খেলা দেখতে গিয়ে পাকিস্তানের জন্য হাততালি দেয়, তাদের সমর্থন করে, তাদের উদ্দেশে…