English Version
আপডেট : ৩০ এপ্রিল, ২০১৮ ১২:৩০

বজ্রপাত ভয়ঙ্কর

অনলাইন ডেস্ক
বজ্রপাত ভয়ঙ্কর

গত কয়েক বছরে দেশে বজ্রপাত ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করছে। বছর বছর বাড়ছে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা। জলবায়ু বিশষেজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীতে সূর্যের তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়ায় বজ্রপাতের হার বেড়েছে ১২ শতাংশ।

বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বজ্রপাত বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি বায়ুদূষণও বাড়িয়ে তুলছে বজ্রপাতের মতো ভয়ঙ্কর দুর্যোগ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাতাসে কার্বনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বজ্রপাতের ঘটনা বাড়ছে আর মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বজ্রপাতের শিকার হচ্ছেন কৃষকসহ পরিবারের কর্মক্ষম মানুষটা।     ফলে এর প্রভাব পড়ছেও মারাত্মক। গতকাল রোববার সারা দেশে বজ্রপাতে মারা গেছেন অন্তত ১৭ জন। এর আগে ২০১৬ সালে পরপর দুদিন বজ্রপাতে ৮১ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। এরপর সরকারের তরফ থেকে বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়। থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতা থেকে বজ্রপাত প্রতিরোধে ১০ লাখ তালগাছ রোপণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু তালগাছ রোপণ ও সেগুলো বড় হওয়ার বিষয়টা দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় অনেকটাই প্রাকৃতিক এ দুর্যোগ মোকাবেলায় কোনো ধরনের প্রস্তুতি নেই বললেই চলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাঠের কৃষক, গৃহবধূ কিংবা বিভিন্ন কাজে ঘরের বাইরে বের হওয়া মানুষ শিকার হচ্ছেন বজ্রপাতের। ফলে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে জনমনে।  আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, দিন দিন আবহাওয়া বিরূপ হয়ে উঠছে। আগের চেয়ে বৃষ্টির মৌসুমে দাবদাহ, তীব্র বাতাস, ঘূর্ণিঝড়, নিম্নচাপ, অস্বাভাবিক বৃষ্টি, ঝড় ও কালবৈশাখী বেড়ে গেছে। বৃষ্টির মৌসুম শুরু হতে না হতে চলতি মাসেই ৩৫ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে বৃষ্টিপাত। শুধু এপ্রিল মাসেই বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ১০ হাজার মিলিমিটার। স্বাভাবিক সময়ে এ বৃষ্টির পরিমাণ থাকে ৪ হাজার ৫৩ মিলিমিটার। গত বছরের চাইতে ১৪ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সঙ্গে বজ্রপাতও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। তীব্র হয়েছে কালবৈশাখীর তাণ্ডবও।  একটি পরিসংখ্যানে জানা গেছে, গত ৮ বছরে দুই হাজারের মতো প্রাণ ঝরে গেছে বজ্রপাতে। উত্তরবঙ্গ এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা বিশেষ করে হাওরে বজ্রপাতে মৃত্যুহার বেশি। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে সরকার ও সংশ্লিষ্টদেরও। বজ্রপাত ঠেকাতে ইতোমধ্যে সরকারের তরফ থেকে তালগাছ রোপণের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। তার পাশাপাশি বজ্রপাত থেকে বাঁচতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা কর্মসূচির দিকেও জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।  আবহাওয়াবিদদের অনেকে বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কালবৈশাখী, অতিবৃষ্টি বা বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে না। এটা জলবায়ু বৈচিত্র্যেরই অংশ। ২০-৩০ বছর পরপর এটা ঘটে। অনেকে বলছেন, বাতাসে উচ্চচাপবলয় শক্তিশালী হলে কালবৈশাখী কম হয়। কিন্তু এবার উচ্চচাপবলয় দুর্বল হওয়ায় পূবালি-পশ্চিমা লঘুচাপের সংমিশ্রণের কারণে বর্ষণ বেশি হচ্ছে। বজ্রপাতও বেড়েছে। তবে এ কথা মানতে নারাজ জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বজ্রপাতের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন এবং বায়ুদূষণের সম্পর্ক প্রমাণিত। দীর্ঘদিনের গবেষণায় বিশ্বের তাবড় গবেষকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এটি প্রমাণ করেছেন, বজ্রপাত এখন একটি বড় ধরনের দুর্যোগ এবং এটা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। জলবায়ু পরিবর্তন দুটি প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ত্বরান্বিত করছে-প্রথমটি, বজ্রপাত এবং দ্বিতীয়টি, দাবানল। পরিবেশে বর্তমানে যে পরিমাণ কার্বন বিদ্যমান সেটা যদি কোনোভাবে দ্বিগুণ হয়ে যায় তা হলে বজ্রপাতের পরিমাণ বেড়ে যাবে প্রায় ৩২ ভাগ। আর মৃত্যুর হারও বেড়ে যাবে সমানুপাতে। ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের সদস্য সচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গওহার নঈম ওয়ারা খোলা কাগজকে বলেন, গত কয়েক বছরে ঢাকার বাতাসে কার্বনের পরিমাণ বেড়েছে ৪ শতাংশের বেশি। তিনি তার গবেষণা তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে সংরক্ষিত হিসেবে বজ্রপাতে ক্রমাগত মৃত্যুহার বৃদ্ধির বিষয়টি আশঙ্কাজনক। গণমাধ্যমে আসা তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৫ সালে দেশে ৯৯ জনের মৃত্যুর খবর নথিভুক্ত করা হয়। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫১। আর গত বছর মৃত্যু হয়েছে ২৬২ জনের। তিনি বলেন, প্রকৃত অবস্থা আরও ভয়াবহ। গওহার বলেন, বজ্রপাতে মারা যাচ্ছেন বেশি দরিদ্র পরিবারের কর্মক্ষম মানুষ। ফাঁকা মাঠে কৃষিকাজ, মাছ ধরা বা নৌকায় করে যাতায়াতের সময় বজ্রপাতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন তারা। এদের বেশিরভাগই পুরুষ।

 

একদিনে ১৭ জনের প্রাণহানি

সারা দেশে বজ্রপাতে অন্তত ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। পৃথক এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ১৩ জন। গতকাল রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঝড়বৃষ্টিতে তাদের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে সিরাজগঞ্জে বাবা-ছেলেসহ পাঁচ, মাগুরায় চার, নোয়াখালী ও নওগাঁয় দুই এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, গাজীপুর, সুনামগঞ্জ ও রাঙ্গামাটিতে একজনের মৃত্যু হয়।  খোলা কাগজের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জের তিন উপজেলায় বজ্রপাতে বাবা-ছেলেসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেলার শাহজাদপুর, কাজীপুর ও কামারখন্দ উপজেলায় এসব বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- কাজীপুর উপজেলার ডিগ্রি তেকানী গ্রামের পারেশ মণ্ডলের ছেলে শামছুল মণ্ডল (৫৫) ও শামছুল মণ্ডলের ছেলে আরমান (১৪), শাহজাদপুর পৌর এলাকার ছয়আনিপাড়া মহল্লার ফারুক হাসানের ছেলে নাবিল হোসেন (১৭), রাশেদুল হাসানের ছেলে পলিং হোসেন (১৬) এবং কামারখন্দের পেস্তক কুড়াগ্রামের আহের মণ্ডলের ছেলে কাদের হোসেন (৩৭)। কাজীপুরের তেকানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হারুনার রশিদ জানান, সকালে ডিগ্রি তেকানী চরে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাদাম তুলছিলেন শামছুল। এ সময় বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত হলে দুজনেই ঝলসে যান। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে কাজীপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পথে উভয়েই মারা যান। অন্যদিকে দুপুরে শাহজাদপুর উপজেলা ভূমি অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় বজ্রপাতে নাবিল ও পলিং নামে দুই কলেজছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কামারখন্দ উপজেলার পেস্তককুড়া গ্রামের একটি ধানক্ষেতে বজ্রপাতে কাদের হোসেন (৩৭) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি ওই গ্রামের আহের মণ্ডলের ছেলে। মাগুরা : সদরের অক্কুরপাড়া ও রায়গ্রাম এবং শালিখা উপজেলার বুনাগাতী ও বাকলবাড়িয়া গ্রামে বজ্রপাতে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এরা হলেন- অক্কুরপাড়ার ভ্যানচালক শামীম, রায় গ্রামের আব্দুর রশিদের ছেলে আলম, জয়পুরহাটের মনপুরা এলাকার আলম মিয়ার ছেলে মেহেদী এবং বাকলবাড়িয়া গ্রামের শক্তিপদ বিশ্বাসের ছেলে প্রল্লাদ বিশ্বাস। মাগুরা সদর থানার এসআই আশ্রাফ হোসেন জানান, ঝড়বৃষ্টির সময় ভ্যানচালক শামীম মাগুরা থেকে শ্রীপুরের দিকে যাচ্ছিলেন। পথে বজ্রপাতে তার মৃত্যু হয়। আর মাগুরা থেকে বাড়ি ফেরার পথে রায়গ্রামে বজ্রপাতের শিকার হন আলম। শালিখার বুনাগাতী এলাকায় মোবাইল ফোন টাওয়ারে কাজ করার সময় বজ্রপাতের শিকার হন মেহেদী। এ ছাড়া প্রল্লাদ বিশ্বাস মাঠে ধানক্ষেতে কাজ করার সময় বজ্রপাতের শিকার হন। নোয়াখালী : জেলার পৌর এলাকার লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামে ও সেনবাগ উপজেলায় বজ্রপাতে স্কুলছাত্রসহ দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামে বজ্রপাতে নোয়াখালী জিলা স্কুলের দিবা-ক শাখার ৫ম শ্রেণির এক ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। তার নাম ইকবাল হাসনাত পিয়াল। সে ওই গ্রামের মো. সোহেল রানা জগলু ও পারভিন আক্তারের বড় ছেলে। এ ছাড়া সেনবাগ উপজেলার নবীপুর ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে ধানকাটার সময় বজ্রপাতে শাহীন নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আব্বাস ও মনির হোসেন নামে দুজন। আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় ধানকাটার সময় বজ্রপাতে আব্দুর রহিম নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় আরও দুইজন আহত হন। গতকাল সকালে উপজেলার মোগড়া ইউনিয়নের দরুইন গ্রামের বাগানবাড়ি এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত শ্রমিক শ্রীমঙ্গল জেলার বাসিন্দা ছিলেন। এদিকে বজ্রপাতে শ্রমিক হতাহতের খবর পেয়ে জমির মালিক তাজুল ইসলাম হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তাকেসহ আহত দুই শ্রমিককে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নওগাঁ : নওগাঁয় বজ্রপাতে স্কুলছাত্র ও এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, গতকাল বিকাল ৩টার দিকে নওগাঁর পোরশা উপজেলায় বজ্রপাতে মুক্তার হোসেন (১৪) নামে এক স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। মুক্তার হোসেন উপজেলার বালিয়াচান্দা গ্রামের ফাইজ উদ্দিনের ছেলে। পোরশা থানার ওসি রকিবুল ইসলাম জানান, মুক্তার হোসেন বালিয়াচান্দা উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। দুপুরে বাড়ির পাশে মাঠে গরু আনতে গেলে হঠাৎ তার ওপর বজ্রপাত হয়। পরে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এ ছাড়া জেলার সাপাহারে বজ্রপাতে সোনাভান (২৪) নামে এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহতরা হলেন- সোনাভানের স্বামী রুবেল হোসেন (২৮), সালেহা বিবি (৪২) ও শিশু রাজু (১২)। আহতদের সাপাহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। গাজীপুর : জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার মাটিকাটা এলাকায় বজ্রপাতে জাফরুল ইসলাম (২০) নামে পোশাক কারখানার এক চেকম্যানের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় নারীসহ পাঁচ শ্রমিক আহত হয়েছেন।  সুনামগঞ্জ : জেলার সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামে বজ্রপাতে লিটন মিয়া (৩০) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। কৃষক লিটন সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিয়ার ছেলে।  রাঙ্গামাটি : রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির মুসলিম ব্লক এলাকায় রান্নাঘরে বজ্রপাতে এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দুপুর ১টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। তার নাম মানছুরা বেগম।