English Version
আপডেট : ২ জানুয়ারি, ২০১৬ ১৭:১২
চিকিৎসাবিজ্ঞানের জয়যাত্রা

ডিম্বাশয় না থাকলেও মা হতে পারবেন

অনলাইন ডেস্ক
ডিম্বাশয় না থাকলেও মা হতে পারবেন

বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় অনেক অসম্ভবই এখন সম্ভবপর হয়ে উঠছে। অন্ধাকার থেকে বেরিয়ে আলোকিত জীবনে ফিরছে মানুষ।  তেমনি অন্ধকারকে জয় করার দুটি গল্প পাঠকদের জন্য দেয়া হল।

প্রথমেই পারমিতার গল্প। ডিম্বাশয়ের ক্যানসারকে জয় করে নতুন জীবনের রাস্তা খুঁজে পেয়েছেন তিনি। দু’টি ডিম্বাশয় বাদ যাওয়ার পরেও মা হলেন আনন্দ উপভোগ করছেন বিজ্ঞানের কল্যাণে। আর অন্যদিকে সোমনাথ পাত্র মেরুদণ্ডের আঘাতের জেরে যৌন ক্ষমতা হারিয়েও মুখ দেখলেন সন্তানের। অত্যাধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জয়যাত্রায় ২০১৬-র শুরুটা নতুন সুরে বেঁধে দিল এঁদের দু’জনের ভবিষ্যৎকেই।

তিন বছর আগে বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা শুরু হয়েছিল কলকাতার পারমিতা চক্রবর্তীর। সেই সময়ে তাঁর ডিম্বাণুর কিছু সমস্যা দেখে চিন্তায় পড়ে যান চিকিৎসকেরা। সমস্যাটা ঠিক কী, তাঁরা কিছুতেই বুঝ উঠতে পারছিলেন না।ক্রমে দেখা যায়, সমস্যা রয়েছে তাঁর ফ্যালোপিয়ান টিউবেও। ল্যাপারোস্কোপি করে দেখা যায়, ডিম্বাশয়ে সিস্ট। অস্ত্রোপচার করে সিস্ট-টি বাদ দেওয়া হয়। বায়োপসি করে জানা যায়, ‘বর্ডার লাইন ক্যানসার’, অর্থাৎ রোগ রয়েছে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়েই।

এর পর টিউমার বোর্ডে রেফার হয় বিষয়টি। দু’তিন মাস অপেক্ষার পরে ফের স্ক্যান করে দেখা যায় ফেরত এসেছে সিস্ট। পারমিতাদেবীর চিকিৎসকেরা তখন রাজারহাটের এক ক্যানসার হাসপাতালে এক জন ক্যানসার শল্য চিকিৎসকের কাছে পাঠান পারমিতাদেবীকে। জয়দীপ ভৌমিক নামে ওই শল্য চিকিৎসক অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন। তবে ল্যাপারোস্কোপি করে নয়, পেট কেটে। অস্ত্রোপচার চলাকালীনই তার নমুনা পাঠানো হয় বায়োপসিতে। চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে বলে ‘ফ্রোজেন সেকশন বায়োপসি’। তাতে দেখা যায়, ‘অ্যাডভান্সড স্টেজ অ্যাগ্রেসিভ ক্যানসার’। অতএব সেই ডিম্বাশয়টি বাদ না দিয়ে উপায় নেই। পাশাপাশি অন্য ডিম্বাশয়টি পরীক্ষা করে দেখা যায় রোগ ছড়িয়েছে সেখানেও। চিকিৎসক সেটিও বাদ দেন। শুরু হয় কেমোথেরাপি। অন্য চিকিৎসাও চলতে থাকে। তার পর অপেক্ষার পালা।

কিন্তু দু’টি ডিম্বাশয় বাদ যাওয়ার পরেও মা হওয়ার আশা ছাড়েননি ৩৫ বছরের পারমিতা। এক দাতার ডিম্বাণুর সাহায্যে এর পর আইভিএফ (ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বা চলতি কথায় টেস্ট টিউব বেবি) পদ্ধতিতে সন্তানের মা হয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, যা হয় হোক, এক বার শেষ চেষ্টা করে দেখতেই হবে। ডাক্তারবাবুরাও সাহস জুগিয়েছেন। তারই ফলটা পেলাম।’’ বছরের শুরুতেই ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান আসে তাঁর কোল জুড়ে।

যে চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসা চলেছে পারমিতার, সেই স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ সুদীপ বসু বলেন, ‘‘অনেকেরই ধারণা, বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা করলে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। এটা সম্পূর্ণ ভুল। এ ক্ষেত্রে এই চিকিৎসাই কিন্তু প্রাণ বাঁচিয়েছে পারমিতার। কারণ বন্ধ্যত্বের চিকিৎসার জন্য উনি এসেছিলেন বলেই রোগটা ধরা পড়ল। সাধারণ ভাবে ডিম্বাশয়ের ক্যানসার ধরা পড়ে অনেক দেরিতে। আর তাই এই রোগে মৃত্যুর হারও খুব বেশি।’’

 

পরের ঘটনাটি হাওড়ার রামরাজাতলার বাসিন্দা সোমনাথ পাত্রের। বছর কয়েক আগে পাড়ার দুর্গাপুজোর ভাসানের সময় ট্রাক থেকে দড়ি ছিঁড়ে দুর্গা প্রতিমা পড়ে গিয়েছিল তাঁর পিঠে। মেরুদণ্ডে গুরুতর আঘাত লাগে। প্রথমে কলকাতায় অস্ত্রোপচার, তার পরে দিল্লির ইন্ডিয়ান স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি সেন্টারে দীর্ঘ চিকিৎসার পরে কলকাতায় ফেরেন তিনি। প্রাণে বেঁচে গেলেও আর পুরো স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব হয়নি সোমনাথের। মেরুদণ্ডের আঘাত আরও অনেক কিছুর সঙ্গে কেড়ে নিয়েছিল তাঁর যৌন সহবাসের ক্ষমতাও। কিন্তু সে সব উপেক্ষা করেই প্রেমিকা পিয়ালি বিয়ে করেন সোমনাথকে। কিন্তু সন্তান? ২৮ বছরের সোমনাথ আর ২৬-এর পিয়ালির চিকিৎসা শুরু হয় বন্ধ্যত্ব চিকিৎসক গৌতম খাস্তগীরের তত্ত্বাবধানে। প্রথমে ছুঁচ ফুটিয়ে সোমনাথের শুক্রাশয় থেকে শুক্রাণু বার করা হয়। সংগ্রহ করা হয় পিয়ালির ডিম্বাণুও। তার পর মাইক্রোস্কোপের নীচে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ডিম্বাণু-শুক্রাণুর মিলন ঘটানো হয়। ভ্রূণ তৈরি করে পরে তা প্রতিস্থাপন করা হয় পিয়ালির জরায়ুতে। চিকিৎসকদের মতে, এ-ও বিশেষ এক ধরনের টেস্ট টিউব বেবি।

চিকিৎসকের দাবি, ‘‘আগে এই ধরনের চিকিৎসা নাগালে না থাকায় একটা দুর্ঘটনা মানুষের গোটা জীবনটাই বদলে দিত। এখন সেই অসহায়ত্ব আমরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। চিকিৎসক হিসেবে সেটাই বড় প্রাপ্তি।’’

খুশি উপচে পড়ছে সোমনাথ-পিয়ালির চোখেমুখেও। বছরের প্রথম দিনে মেয়েকে কোলে পেয়ে তাঁরা জানালেন, মনে হচ্ছে জীবনের সবটুকু আনন্দ তাঁরা একসঙ্গেই পেয়ে গেলেন।

এই দুই ঘটনাকে এক ঝলক আশার আলো বলে মনে করছেন অন্য চিকিৎসকেরাও। তাঁদের মতে, সন্তান না হওয়াকে জীবনের ‘অভিশাপ’ বলে এখনও মনে করেন অনেকেই। সেই সংস্কার কাটিয়ে ইদানীং বিকল্প পদ্ধতিতে সন্তান পাওয়ার পথে এগোচ্ছেন বহু দম্পতি। স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক রত্নাবলি চক্রবর্তীর বক্তব্য, অন্য অঙ্গে ক্যানসার হলে অনেক সময় ডিম্বাশয় থেকে টিস্যু তুলে হিমায়িত করে রেখে দেওয়া হয়। পরে দরকার হলে সেই টিস্যু থেকেই গর্ভধারণের চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু ডিম্বাশয়ে ক্যানসার হলে তো সেই সুযোগ থাকে না। সে ক্ষেত্রে ডিম্বাশয়টাই বাদ দিয়ে অন্যের ডিম্বাণু ধার করে টেস্ট টিউব বেবি হতে পারে। আর যেখানে স্বামী যৌন ক্ষমতা হারাচ্ছেন, সেখানে টেস্টিকুলার স্পার্ম অ্যাসপিরেশন এবং ইনট্রা সাইটোপ্লাজমিক স্পার্ম ইঞ্জেকশন-এর সাহায্যে সন্তানের জন্ম দেওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘‘চিকিৎসা বিজ্ঞান এখন অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। ‘না’ বলে প্রায় কিছুই নেই। সাধারণ মানুষ সাহস করে এগিয়েআসছেন। ডাক্তাররাও চেষ্টা করে যাচ্ছেন সাধ্যমতো।’’

 

সূত্র : আনন্দবাজার