আফগান সংকট ও তার সম্ভাব্য সমাধান

দীর্ঘ ২০ বছর আফগানিস্তানে অবস্থান শেষে চুক্তি অনুযায়ী তল্পিতল্পা গুটিয়ে ফিরে যাচ্ছে ন্যাটোর বিশাল সেনাবহর। ন্যাটোর বিদায়ে তালেবানরা আফগানিস্তানের দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠছে। তারা প্রতিদিনই নতুন কোনো অঞ্চলে আফগান বাহিনীকে (আফগান ন্যাশনাল আর্মি) হটিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে। গাড়িবোমা, ড্রোন হামলা, আত্মঘাতী হামলা এবং গোলাবর্ষণের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে ফের। এর দরুন আফগান পরিস্থিতি পুনরায় উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বলা চলে প্রায় গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে আফগানিস্তান। এমন পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক মহলে দারুণ উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ধারাভাষ্যকাররা আফগানিস্তানের ব্যাপারে সতর্ক করছেন বার বার। এর সঙ্গে ন্যাটো এবং মার্কিন বাহিনীর ব্যর্থতাও প্রচার করছেন জোর গলায়। কারণ তারা চলমান সংকটের কোনো স্থায়ী সমাধান দিয়ে যেতে পারেননি। অথচ বাইডেন প্রশাসনের সদিচ্ছায় সমাধান আসার সম্ভাবনা ছিল। ২০০১ সালে (৯/১১) ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ারে হামলার জন্য আল-কায়েদাকে দায়ী করে তৎকালীন তালেবান শাসিত আফগানিস্তান আক্রমণ করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী। যার নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন এন্ডিউরিং ফ্রিডম’। যুদ্ধের এক পর্যায়ে তালেবান সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়। ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। হামিদ কারজাইকে প্রেসিডেন্ট বানিয়ে সন্ত্রাস নির্মূলে যুদ্ধ করে ন্যাটো বাহিনী। কারজাই পুতুল সরকার হিসেবে দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন; কিন্তু জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেননি। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সালে বারাক ওবামা তার ‘কোট অব দ্য ইউনিয়ন’ ভাষণে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির অনুরোধে তা বিলম্ব করেন। ২০২০ সালে কাতারের দোহায় ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে তালেবানের চুক্তি হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী জো বাইডেন আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। সবশেষে আমেরিকান এবং ন্যাটো বাহিনীর সদস্যরা আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি ছেড়ে গেছে। ন্যাটোর সেনারা আফগানিস্তান ছেড়ে গেলে আফগানিস্তানে শান্তি আসার কথা ছিল। কিন্তু আদতে সেই শান্তি অধরাই থেকে যাচ্ছে। ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান ছাড়তে না ছাড়তেই তালেবানদের বেপরোয়া হয়ে ওঠা এবং বর্তমান প্রশাসনের ভুল পদক্ষেপ আপতত শান্তির প্রত্যাশা উড়িয়ে দিচ্ছে।
আমেরিকা এবং ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তানকে কাদের হাতে তুলে দিয়ে গেল? মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কথা অনুযায়ী আশরাফ ঘানির নেতৃত্বাধীন আফগান প্রশাসনের হাতে। কিন্তু বাস্তবে ঘানি প্রশাসন তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে প্রশাসন টিকিয়ে রাখতে পারবে কি না সে প্রশ্ন থেকেই যায়। তালেবানরা মনে করে সেনা প্রত্যাহারের চুক্তি যেহেতু তাদের সঙ্গে হয়েছিল এবং ২০০১ সালে মোল্লা ওমর সরকারকে হটিয়ে পুতুল সরকার বসানো হয়েছিল, তাই তারা নিজেদের আফগানিস্তানের হর্তাকর্তা দাবি করছে। এ জন্য ক্ষমতালিপ্সু তালেবানরা প্রশাসনকে ঘায়েল করে ক্ষমতায় বসতে চাচ্ছে। আল-জাজিরার খবর অনুযায়ী ইতোমধ্যে তারা ১৪০টিরও অধিক (এক-তৃতীয়াংশ) জেলা দখলে নিয়েছে। রাজধানী কাবুলের দখল নিতেও মরিয়া তারা। তাই দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ কান্দাহারে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ লিপ্ত হয়েছে। কারণ রাজধানী কাবুলের সঙ্গে এর সংযোগ রয়েছে। সোভিয়েত এবং ন্যাটো বাহিনীর ব্যবহার করা বাগরাম ঘাঁটি ইতোমধ্যে আফগান প্রশাসন দখলে নিয়েছে। এটা প্রশাসনের জন্য ইতিবাচক হলেও আফগানিস্তানে তালেবানদের পুনরুত্থান আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে সর্বত্র। কয়েকদিনে তালেবানরা যুদ্ধ ছাড়াই উত্তর-পূর্ব বাদাখশান রাজ্য এবং কান্দাহারের কিছু অঞ্চল দখলে নিয়েছে। আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন তালেবানদের হাতে যুদ্ধ সরঞ্জাম তুলে দিয়েছে এবং ১৬০০-এর অধিক আফগান সেনা পালিয়ে সীমান্ত পার হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ তাজিকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। এ খবর ঘানি প্রশাসন এবং মিত্র দেশগুলোর জন্য মোটেই সুখকর নয়।
আফগানিস্তান রাষ্ট্রটির ললাটে গণতান্ত্রিক পরিবেশে স্থিতিশীলতা এখনো ধরা দেয়নি। ১৯১৯ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে চলতে থাকে রাজতন্ত্র। ১৯৩৩ সাল থেকে টানা ৪০ বছর আফগানিস্তান শাসন করেন জহির শাহ। মুহাম্মদ দাউদ খান ১৯৭৩ সালে বাদশাহ মুহাম্মদ জহির শাহকে উৎখাতের মাধ্যমে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করেন এবং আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। কিন্তু তার শাসন দীর্ঘায়িত হয়নি। ১৯৭৮ সালে পিপল’স ডেমোক্রেটিক পার্টি অব আফগানিস্তানের (পিডিপিএ) নেতৃত্বে সংঘটিত সাওর বিপ্লবের সময় তিনি নিহত হন। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান আক্রমণ করে সোভিয়েত সরকার। বাবরাক কারমাল রাশিয়ার পুতুল সরকারে পরিণত হন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চ হয়ে ওঠে দেশটি। হেন দৃশ্য দেখে আমেরিকাও বসে থাকেনি। আমেরিকা রুশদের হটাতে রুশবিরোধী মুজাহিদিনদের সহযোগিতা করে। মার্কিন মিত্র পাকিস্তানও এ ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা পালন করে। চাপের মুখে ১৯৮৯ সালে রুশ বাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগ করে। সোভিয়েতরা যাওয়ার পরেও যেমন অস্থিতিশীলতা আর অন্তর্কোন্দল লেগে ছিল, ২০২১-এ মার্কিন এবং ন্যাটো বাহিনী চলে যাওয়ার পরেও আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একই ঘটনা ঘটতে চলেছে। ১৯৯২ সালে রাশিয়ার আরেক পুতুল সরকার মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহকে হটিয়ে মুজাহিদরা ক্ষমতা নিয়েছিল। বোরহানউদ্দিন রব্বানি প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ১৯৯৪-এর দিকে তালেবানদের উত্থান হয়। পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সহায়তায় ১৯৯৬-এ তারা ক্ষমতা দখল করে। সেই তালেবানরাই এখন ক্ষমতা নেওয়ার জন্য লড়াই করছে। আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা ফেরাতে বিশ্বনেতাদের কূটনৈতিক তৎপরতা এখনই শুরু করতে হবে। হোয়াইট হাউস যখন সেনা প্রত্যাহারের অনড় ঘোষণা দেয় তখন প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি এবং বিরোধী নেতা আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহ বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। নিরাপত্তার জন্য সেনা রাখার অনুরোধ করলে জো বাইডেন কিছু সেনা রাখার কথা বলেন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব আফগান প্রশাসনকেই নিতে বলেন। কিন্তু এর প্রত্যুত্তরে তালেবানরাও হামলার হুমকি দিয়েছে।
এখন প্রেসিডেন্ট ঘানি এবং বিরোধী নেতা আব্দুল্লাহ তালেবানদের সঙ্গে আলোচনায় বসলে সবার জন্য ইতিবাচক হতো। যুক্তরাষ্ট্র তার বিদায় মুহূর্তে তালেবান এবং আফগান প্রশাসনের সঙ্গে একটি চুক্তির প্রস্তাব রাখলেও বিশৃঙ্খলা, গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা থাকত না। কারণ তালেবানকে আফগানিস্তানের রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়া প্রায় অসম্ভব। বাদ দিতে গেলে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। যদিও তারা রক্ষণশীল নীতিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তথা ইসলামী আমিরাত প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তবুও তাদেরও আফগানদের একাংশ সমর্থন করে। তাই তাদের এড়িয়ে আফগানিস্তানে অস্থিরতা দূর করা যাবে না। বাইডেন প্রশাসন ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা কিংবা কোয়ালিশন সরকার গঠন করে দিলে আফগানরা শান্তির আশা করতে পারত। ওয়াশিংটন কাবুল সম্পর্কও আরো উষ্ণ থাকত। আফগানিস্তান নিয়ে চলমান ভূরাজনীতি দেশটিতে অস্থিতিশীলতার জন্য অনেকাংশে দায়ী।
পাকিস্তান চায় আফগানিস্তানে পাক-সমর্থিত সরকার থাকুক। বিভিন্ন সময় তালেবানসহ বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে অস্ত্র, অর্থ এবং আশ্রয় দিয়ে আসছে। এ জন্য পাকিস্তানেও তালেবানদের তৎপরতা লক্ষণীয়। প্রতিবেশী দেশে তালেবানদের মতো সশস্ত্র সংগঠন ক্ষমতায় থাকলে ভারতের হুমকি মোকাবিলা সহজ হবে। এ জন্য সীমান্তে যুক্তরাষ্ট্রকে ঘাঁটি স্থাপনের বিষয়ে সরাসরি নাকচ করেছেন ইমরান খান। আবার ভারত আফগান প্রশাসনকে সমর্থন করছে পাকিস্তানকে চাপে রাখতে। ইরানও চায় তাদের অনুকূলে থাকুক আফগান সরকার। ভূরাজনৈতিক খেলা আর পরাশক্তিগুলোর স্বার্থান্বেষী পদক্ষেপের কারণে চার দশক ধরে আফগানিস্তানে অশান্তির দাবানল জ্বলছে। দ্রুত শান্তি ফেরানোর উদ্যোগ না নিলে নিকট ভবিষ্যতেও শান্তির আশা করা যায় না। এমন ভূরাজনৈতিক প্রভাব এবং সমাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদী শক্তির হস্তক্ষেপে আফগান সংকট তীব্রতর হয়েছে বিগত কয়েক দশক ধরে। মার্কিন এবং ন্যাটো সেনাদের চলে যাওয়ায় তা স্পষ্ট হয়েছে দিবালোকের মতো।
এখন আফগানিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এই সংকটের রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন। রাজনৈতিক সমস্যায় সেনা সমাধান (মিলিটারি অ্যাকশন) কাজ করবে না বরং তাতে যুদ্ধ আর প্রাণহানি বাড়বে। তাই রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমেই এই সমস্যা সমাধান করতে হবে। তালেবানকে বাদ দিয়ে নয়, বরং তাদের সঙ্গে নিয়ে, আলোচনার মাধ্যমে আফগান সংকটের সমাধান জরুরি। আফগান সরকার এবং আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দকে রাজনৈতিক পদক্ষেপের কথাই ভাবতে হবে। কিন্তু তালেবানরা অস্ত্র শক্তিতে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ক্ষমতায় গেলে কঠিন সময় পার করবে আফগানরা। সুতরাং বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার, সুশাসন আর গণতন্ত্রের বিজয় নিশ্চিত করতে হলে এখনই আফগান সংকট নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে বিশ্বনেতৃত্বকে।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়