চীন বিদ্বেষের আগুনে খাঁটি হবে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক?
প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তিকে দমিয়ে রাখতে অন্যের সঙ্গে আঁতাত করা কয়েক সহস্র বছরের পুরনো ও বহুল আশ্রিত একটি কৌশল। মেসোপটেমিয়া সভ্যতার মূল সৌর্যে পরিণত হওয়ার অভিলাষে এই কৌশলের সফল ব্যবহার করেছিলেন ব্যাবিলন সম্রাজ্যের সম্রাট হাম্মুরাবি।
মেসোপটেমিয়া সভ্যতার পত্তন হয় শ্রেণিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভবের পরপরই। সেই সভ্যতার অধীনে প্রায় প্রতিটি শহরই ছিল একেকটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্র। এসব নগররাষ্ট্রের রাজারা একে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধ-বিগ্রহে মত্ত থাকত। যুদ্ধে জয়ী হলে বিজিত নগরী দখল অথবা ধ্বংস করে দেয়ার চর্চাও ছিল সে সময়।
সেই আমলে ব্যাবিলন বেশ জনপ্রিয় একটি জনপদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আর এই জনপ্রিয়তার মূল কারণ ছিল দজলা ও ফোরাত নদীর (টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস) সহাবস্থানে নগরীটির অবস্থান। ব্যাবিলন মূলত এর ভৌগোলিক অবস্থান ব্যবহার করে ফায়দা লুটেছিল। ধীরে ধীরে ব্যাবিলন পরিণত হয়েছিল মেসোপটেমিয়ার বাণিজ্যিক নগরীতে। পরিণত হয়েছিল একটি শক্তিশালী নগররাষ্ট্রে।
মেসোপটেমিয়ার শাসনব্যবস্থায় যে নামটি নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে, তা হলো ব্যাবিলনের সম্রাট হাম্মুরাবি। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৯২-১৭৫০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৪২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। ব্যাবিলনের ধন-সম্পদের প্রাচুর্য কাজে লাগিয়ে তিনি গড়ে তোলেন বিশাল এক সৈন্যবাহিনী। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের রাজাদের মধ্যে বিদ্যমান কলহ তিনি সুকৌশলে নিজ স্বার্থে কাজে লাগিয়েছিলেন। কূটবুদ্ধিতে হাম্মুরাবির জুড়ি মেলা ছিল ভার। কলহপূর্ণ বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্য থেকে শক্তিশালী রাষ্ট্র বেছে নিয়ে তার সঙ্গে জোট বেঁধে অন্যান্য নগররাষ্ট্র দখল করতেন তিনি। তারপর সুযোগ বুঝে নিজের মিত্রপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বস্ব লুটে নিতেন। এরপর বিরোধিতা করার মতো আর কেউ থাকত না। এভাবে সূক্ষ্ম বুদ্ধি ও নিপাট কৌশলের আশ্রয়ে পুরো মেসোপটেমিয়াকে পদানত করেন সম্রাট হাম্মুরাবি। বিস্তৃত করেন নিজের সম্রাজ্য ও অনুশাসন।
ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তুলে নিজ স্বার্থের জন্য হুমকিস্বরূপ দেশকে পদদলিত করে রাখার এ কৌশল আজও গ্রহণ করতে দেখা যায় কিছু দেশকে। পরাক্রমশালী দেশগুলোর এ শীতল যুদ্ধের ছায়া আজ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বজুড়ে। এক্ষেত্রে সবার আগে যে দেশের নাম উঠে আসে, সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্র। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আর হালের রাশিয়া থেকে শুরু করে চীন, উত্তর কোরিয়া, ইরান, ভেনিজুয়েলা, কিউবার মতো দেশগুলোর সঙ্গে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক রীতিমতো সাপে-নেউলে। অন্যদিকে ভূরাজনৈতিক কূটকৌশলের কারণে ইসরায়েল, জাপান, সৌদি আরব, ব্রিটেনসহ আরো কয়েকটি দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছে মার্কিন প্রশাসন।
মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু-মিত্র খেলা অনেকদিন ধরেই চলছে। এ অঞ্চলে তাদের কূটনৈতিক তত্পরতা এতই প্রভাব বিস্তারকারী যে, সাম্প্রতিক সময়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), বাহরাইন, সুদান ও মরোক্কোর মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশও ওয়াশিংটনের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে অভাবনীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নয়াদিল্লির সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কের উষ্ণতাও কিছুটা বেড়েছে। মূলত নিজেদের শীর্ষ অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে ভারতের শিথিল সম্পর্ককে কাজে লাগাতেই দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে ওয়াশিংটন।
চীনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি এখন অনেকটা একই। তাইওয়ান ও হংকং ইস্যু, উইঘুরের সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন, দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের দখলদারিত্ব, নভেল করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারী আকার ধারণ করার দায়, চীনা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কারণে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরির অভিযোগ, বাণিজ্যযুদ্ধসহ বিভিন্ন বিষয় ঘিরে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে বিবাদ এখন তুঙ্গে। অন্যদিকে গত বছরের মাঝামাঝিতে সীমান্ত বিরোধের জেরে ভারত ও চীন একে অপরের ঘোর শত্রুতে পরিণত হয়েছে। সীমান্তের সেই উত্তেজনার আঁচ লেগেছে কেন্দ্রেও এবং তা এতটাই প্রকট যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাণিজ্যিকভাবেও চীনকে বয়কটের ডাক দিয়েছেন।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কোন্নয়নে আরেকটি বিষয় প্রভাব ফেলতে পারে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও গত কয়েক বছরে এ বন্ধন কিছুটা শিথিল হয়েছে। মূলত ইসলামাবাদের বেইজিং-ঘেঁষা অবস্থানই এর কারণ। ওয়ান বেল্ট উদ্যোগ বাস্তবায়নে পাকিস্তানকে ব্যবহার করছে চীন, যার প্রতিদান হিসেবে ইসলামাবাদকে অর্থনৈতিক ও সামরিক বিভিন্ন সহায়তা দিচ্ছে তারা। চিরশত্রু প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে চীনের এই দহরম-মহরম একেবারেই ভালোভাবে দেখছে না ভারত। আবার চীনকে কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দেয়ায় পাকিস্তানের ওপরও কিছুটা নাখোশ যুক্তরাষ্ট্র। তাই তাদের শিক্ষা দিতে ভারতের সঙ্গে হাত মেলাতেই পারে মার্কিন প্রশাসন।
মোট কথা, চীনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অবস্থান এখন একই সরলরেখায় অবস্থান করছে। ফলে এই অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লি একে অন্যকে পাশে পেতে চাইবে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। সাবেক কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত কৌশলগত ও প্রতিরক্ষামূলক সহযোগিতার সম্পর্ক আরো উষ্ণ হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনও সেই ইঙ্গিতই দিয়ে রেখেছেন। এশিয়াকে ঘিরে নতুন মার্কিন প্রশাসনের কৌশলগত নীতি কেমন হতে পারে, সে বিষয়ে ধারণা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, চীনকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র। এ কারণে বেইজিং ইস্যুতে ওয়াশিংটনের অবস্থান কঠোরই থাকবে। একই সময় ব্লিংকেন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরো উষ্ণ করার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। তিনি বলেন, নয়াদিল্লির সঙ্গে মিত্রতা ওয়াশিংটনের জন্য সবসময়ই লাভজনক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
সাবেক কূটনীতিক অরুণ সিং ২০১৫-১৬ মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার মতে, চীনের তরফ থেকে ভারতকে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে, এবং অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও সামরিক উত্থানের কারণে চীনকে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে, তাতে নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটন একই কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে দুই দেশের জোটবদ্ধভাবে কাজ করার সম্ভাবনাই বেশি।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও থিংক ট্যাংক গেটওয়ে হাউজের সম্মানীয় ফেলো রাজীব ভাটিয়ার মতে, প্রকৃত অর্থে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা দৃশ্যমান হতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে। কারণ চীন ও এশিয়ার বাকি দেশগুলোর বিষয়ে সম্ভাব্য মার্কিন নীতি নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা কাজ করছে এখনও। তবে এ কথা বলে দেয়া যায় যে, ওয়াশিংটন-নয়াদিল্লি কৌশলগত সহযোগিতামূলক সম্পর্কের প্রভাব ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলেও বিস্তৃত হবে। আর গত কয়েক বছরে এ অঞ্চলে চীনের সামরিক প্রভাব দৃশ্যমানভাবে বিস্তার লাভ করেছে।
রাজীব ভাটিয়া যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের উষ্ণতা বাড়ার পেছনে একটি ভালো যুক্তি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ভারত এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে, এ মুহুর্তে চীনই তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। ফলে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটিকে দমিয়ে রাখতে দিল্লিকে অবশ্যই পাশে চাইবে শীর্ষ অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে এশিয়ায় বর্তমানে যে ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে, তাতে প্রভাব বিস্তারের জন্য ভারতেরও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা দরকার।
বারাক ওবামার প্রশাসন ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শীর্ষ প্রতিরক্ষা অংশীদার হিসেবে ঘোষণা করেছিল। সে সময়ে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা বিনিময়ের উদ্যোগও দেখা গিয়েছিল। পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে ভারতকে ‘স্ট্র্যাটেজিক ট্রেড অথরাইজেশন’ ক্যাটাগরিতে রাখার মাধ্যমে এ সম্পর্ককে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ক্যাটাগরিতে কোনো দেশের ঠাঁই হওয়ার অর্থ হলো সেটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ঘনিষ্ট সহযোগী। বাইডেন প্রশাসনের সময়ে প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে দেশ দুটির মধ্যে এই ঘনিষ্ঠতা আরো বাড়বে বলে আশা করাই যায়।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব নিরুপমা মেনন রাও বলেছেন, যতদূর বোঝা যাচ্ছে, নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গভীরতা কয়েক দশক এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তিনি সবসময়ই ভারতের বন্ধু হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। যখন তিনি সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন, তখন থেকেই তিনি ভারতের পাশে ছিলেন।
ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট ও ডেপুটি ডিরেক্টর মাইকেল কুগেলম্যানও একই কথা বলেছেন। তিনিও মনে করেন, বাইডেন ভারতের দীর্ঘমেয়াদি বন্ধু হিসেবেই আবির্ভূত হবেন। তিনি বলেন, বাইডেন ভারতকে বেশ ভালোভাবেই জানেন। তাকে দুই দেশের মধ্যকার অংশীদারিত্বমূলক সম্পর্কের সমর্থক হিসেবেই দেখা হয়।
লেখক: সংবাদকর্মী