চরম বিপর্যয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প

প্রথম প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্কের পর থেকেই রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। এবার নর্দমায় পড়লেন। সেখান থেকে কাদা মেখে হলেও উঠে দাঁড়াতে পারবেন—এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ।
ট্রাম্পের ২০০৫ সালের একটি ভিডিও গত শুক্রবার প্রকাশ করে ওয়াশিংটন পোস্ট। যেখানে নারীদের সম্পর্কে অত্যন্ত আপত্তিকর ও অশ্লীল মন্তব্য করেছেন তিনি। এই ভিডিওতে ট্রাম্পকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনি যদি তারকা হন, তাহলে তাদের (নারী) সঙ্গে যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন। তারা আপত্তি করবে না।’ এই ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে ক্ষমা চান ট্রাম্প। নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকে এটিই ছিল ট্রাম্পের প্রথম ক্ষমা প্রার্থনা।
এমন একটি সময় এই ভিডিও প্রকাশ করা হলো, যার মাত্র দুই দিনের মাথায় দ্বিতীয় প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্ক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর জন্য এই ভিডিওকে ‘বোমা’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। দল এটাকে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ‘নকআউট পাঞ্চ’ বিবেচনা না করলেও শীর্ষ নেতারা তীব্র ভাষায় সমালোচনা শুরু করেছেন।
মাত্র তিন মিনিটের এই ভিডিওটি ধারণ করা হয় ‘অ্যাকসেস হলিউড’ নামের একটি অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে। সে সময় ট্রাম্পের সঙ্গে ছিলেন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক বিলি বুশ নামের এক টিভি ব্যক্তিত্ব। ভিডিওতে ট্রাম্পকে ন্যান্সি ও’ডেল নামের এক নারী সাংবাদিকের সঙ্গে একটি আসবাবের দোকানে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ঘটনা বর্ণনা দিতে শোনা যায়। তিনি স্বীকার করেন, বিষয়টি চেষ্টা পর্যন্তই সীমিত ছিল। এরপর অভিনেত্রী আরিয়ানা জুকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারেও কদর্যভাবে আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। এই অভিনেত্রীর পায়ের প্রশংসাও করেন। বলেন, এসব নারীকে পটানোর কৌশল তাঁর জানা। পুরো ভিডিওটি ছিল চলন্ত বাসের ভেতর কথোপকথন আকারে ধারণ করা। এরপর তাঁরা নেমে আসেন। ‘ডেইজ অব আওয়ার লাইফ’ নামের একটি ধারাবাহিক নাটকের স্টুডিওতে তাঁদের একটি অনুষ্ঠান ধারণের কথা ছিল।
ভিডিও প্রকাশের পর পরই ক্ষমা চেয়ে দেড় মিনিটের আরেকটি ভিডিও প্রকাশ করে ট্রাম্প শিবির। এতে ট্রাম্প বলেন, ‘আমাকে যাঁরা চেনেন তাঁরা জানেন আমি এমন নই। তবে ওভাবে কথা বলা ভুল ছিল। আমি ক্ষমা চাইছি।’ এই ভিডিওতে তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং তাঁর স্ত্রী ও ডেমোক্রেটিক দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনেরও তীব্র সামালোচনা করেন। ট্রাম্প বলেন, ‘বিল ক্লিনটন হলেন প্রকৃত নারী নিপীড়নকারী। আর বিলের নিপীড়নের শিকার নারীদের অপদস্থ করেছেন হিলারি। আগামী দিনগুলোতে আমরা এ নিয়ে আরো কথা বলব। আগামী রবিবার বিতর্কের সময় আপনাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে।’
নারীদের অপদস্থ করার ঘটনা ট্রাম্পের অবশ্য এটিই প্রথম নয়। প্রচারের শুরু থেকেই তাদের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করার অভিযোগ রয়েছে। তিনি কখনো সেগুলো অস্বীকারও করেননি। বরং একবার এ-ও বলেছেন, নেহায়েতই বিনোদন দেওয়ার জন্য কথাগুলো বলেছিলেন তিনি। তবে এবারের ভিডিওটি সেই সব বিতর্ককে ছাপিয়ে গেছে।
দ্বিতীয় বিতর্কের মাত্র দুই দিন আগে ভিডিও প্রকাশ পেলে। যুক্তরাষ্ট্রের সময় আজ রবিবার (বাংলাদেশ সময় সোমবার সকাল ৭টা) এই বিতর্ক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। প্রথম বিতর্কে হিলারির কাছে পরাজিত হওয়ার পর এবারেরটি ট্রাম্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ট্রাম্পের ভিডিও দলের মধ্যেও তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। রিপাবলিকান দলের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের স্পিকার পল রায়ানের গতকাল এক অনুষ্ঠানে ট্রাম্পের সঙ্গে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। ভিডিও প্রকাশের পর তিনি আর ওই অনুষ্ঠানে যাননি। এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘ওই ভিডিও দেখার পর নিজেকে অসুস্থ মনে হচ্ছে। নারীরা শ্রদ্ধার, ভালোবাসার। তাদের বস্তু হিসেবে বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই। ট্রাম্পকে বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে হবে। তাঁকে এমন কিছু করতে হবে যেন মানুষ বুঝতে পারে নারীদের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল।’
ট্রাম্পের রানিংমেট মাইক পেন্স এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে দলের বহু শীর্ষ নেতা ট্রাম্পের মন্তব্যে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে সমালোচনা করেছেন। তাঁকে প্রার্থিতা ছেড়ে দেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
তবে দলগতভাবে তেমন কোনো অবস্থান গ্রহণ করেনি রিপাবলিকান পার্টি। বরং দলের একটি অংশ মনে করছে, যা হলো তা ট্রাম্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে নিঃসন্দেহে। তবে এটি ‘নকআউট’ পাঞ্চ নয়। অর্থাত্ নির্বাচনের আর মাত্র এক মাসেরও কম সময় হাতে রেখে প্রার্থী পরিবর্তনের কথা ভাবছে না তারা। দলের নিবন্ধিত ভোটারদের ওপর করা এক জরিপে দেখা গেছে, ৫৪ শতাংশ মনে করে, ট্রাম্পকে এক্ষুনি বাতিল না করলেও চলে। ৪৬ শতাংশ মনে করে, ট্রাম্পকে সরিয়ে দেওয়া উচিত।
হিলারি শিবির থেকে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়েছে মাত্র দেড় ছত্রের এক টুইট বার্তায়, ‘ভয়াবহ। এই লোককে কোনোভাবেই আমরা প্রেসিডেন্টের আসনে বসাতে পারি না।’
তবে এ ধরনের ভয়াবহ মন্তব্য করার পর ক্ষমা চাইলেই কি সব কিছুর নিষ্পত্তি হয়ে যায়? ট্রাম্প শিবিরের দাবি, বর্ণিল জীবন যাপন করে এসেছেন তাদের প্রার্থী। তিনি রাজনীতিক নন। কিন্তু জানেন দেশ সুশাসিত হচ্ছে না। আর ভুলগুলো খুঁজে তা শুধরে নেওয়ার মতো প্রতিভা ও যোগ্যতা তাঁর আছে। আর এ কারণেই নির্বাচনে নেমেছেন তিনি। কাজেই রাজনৈতিকভাবে তিনি পূর্ণ বা যথাযথ হবেন না। তাঁর এক সহযোগী কোরে লেওয়ানডস্কি বলেছেন, ‘আমরা ছুটির দিনের শিক্ষক বাছতে বসিনি। আমরা নেতা নির্বাচন করতে চাই। আর এমন একটি ভিডিওর কারণে ট্রাম্প বাতিল হয়ে যান না। এটি তাঁর যোগ্যতা পরিমাপকও নয়।’
কিন্তু সাধারণ নারী ভোটাররা বিষয়টিকে এভাবে দেখছে না। সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে এমনই একজন ভোটার বলেন, ট্রাম্পের আজই প্রার্থিতা ছেড়ে দেওয়া উচিত। আমরা প্রথমে নির্ধারণ করি প্রার্থী মানুষ হিসেবে কেমন। সেই ধাপেই তিনি ব্যর্থ। তাঁর নীতি কী, পরিকল্পনা কী সেই বিবেচনাগুলো আসে আরো পরে।’
এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন ভার্জিনিয়ার এক শীর্ষ রিপাবলিকান নেতা। তিনি বলেন, ‘আমার একটি ১৫ বছর বয়সের কিশোরী মেয়ে আছে। তাকে আমি ভোটের দিন কী করে বলব, আমি ট্রাম্পকে ভোট দিতে যাচ্ছি। যা ঘটেছে তা ঠিক হয়নি। আমার মনে হয়, এসব (ট্রাম্পের নির্বাচন) এখানেই শেষ।’ সূত্র : বিবিসি, সিএনএন, পলিটিকো, এনবিসি, ফক্স, ওয়াশিংটন পোস্ট।