কবিতার আসর পরিণত হলো বধ্যভূমিতে!

কবিতা পড়বেন বলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে সমবেত হয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তখন হাজার তিনেক শিক্ষার্থী। বিশেষ এই দিনে এসেছেন আরও প্রায় ৬০০ অতিথি। যার নামে এই বিশ্ববিদ্যালয়, সেই বাচা খান বা খান আবদুল গফফর খানের মৃত্যুবার্ষিকী ছিল গতকাল ২০ ডিসেম্বর। শান্তির দূত-কে কবিতার পঙতিতে স্মরণ করাই ছিল লক্ষ্য। কিন্তু ছন্দের ভাষা হারিয়ে গেল বন্দুকের গর্জনে।
কুয়াশায় ঢাকা চার দিক। সেই সুযোগে ইউনিভার্সিটির পিছনের নিচু দেওয়াল টপকে ঢুকে পড়ে কিছু জঙ্গি। হাতে রাশিয়ান কালাশনিকভ। পরনে স্থানীয় আর পাঁচ জনের মতোই সাধারণ পোশাক। বয়স ১৮ থেকে ২৫-এর মধ্যে। ঢুকেই এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে জঙ্গিরা। কয়েক জন যায় হোস্টেলের দিকে। রেজিস্ট্রারের অফিসে তাণ্ডব চালিয়ে হানা দেয় রসায়ন বিভাগে। ছাত্রদের বাঁচাতে নিজের বন্দুক উঁচিয়ে রুখে দাঁড়ান রসায়নের শিক্ষক সৈয়দ হামিদ হুসেন। সেই ফাঁকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হন কয়েক জন ছাত্র। কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে পারেননি প্রফেসর হামিদ।
বেঁচে যাওয়া এক ছাত্র বলছিলেন, সকালে অনেকেই তখনও বিছানা ছেড়ে ওঠেনি। বিস্ফোরণ আর গুলির শব্দে দরজা বন্ধ করেই কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম। কতক্ষণ যে ও ভাবে কাটিয়েছি, জানি না! শেষে সেনাবাহিনী এসে আমাদের উদ্ধার করে।
ঠিক ১৩ মাস ৪ দিন আগে ২০১৪-র ১৬ ডিসেম্বর পেশোয়ারের সেনা-স্কুলে ১৩৩টি শিশুর শরীর প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল নিষ্ঠুর নৃশংস জঙ্গিরা। বন্দুকের নল ফের কেড়ে নিল এক ঝাঁক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আবার সেই পেশোয়ারেই ঘটল বুধবার ঘটল এই নৃশংস অমানবিক হত্যযজ্ঞ।জঙ্গি হামলার খবরটা প্রথম ছড়িয়ে পড়ে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে। একটু পরেই পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে সেনা ও পুলিশের বিশাল বাহিনী। জঙ্গি নিধন কোন পথে এগোচ্ছে, কিছু পর টুইটারে সেই খবর সরাসরি জানাতে শুরু করেন পাক সেনার মুখপাত্র আসিম বাজওয়া। দুপুর পৌনে একটার দিকে তিনি জানান খতম হয়েছে চার জঙ্গিই। প্রায় সাড়ে তিনটে নাগাদ সেনা সূত্রে বলা হয়, জঙ্গিমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। সরকারি হিসেবে নিহত ৪ জঙ্গি-সহ ২৪। এঁদের মধ্যে ১৮ জন শিক্ষার্থী, এক জন শিক্ষক ও এক জন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মী। আহতের সংখ্যা ১১।
পেশোয়ারের সেনা স্কুলে হামলাতে জড়িত ছিল তেহরিক ই তালিবান (টিটিপি)। গতকাল সেনা অভিযানের সময়ই হামলার দায় স্বীকার করে টিটিপি-র গিদার গোষ্ঠী। তাদের নেতা উমর মনসুর নিজের ফেসবুক পেজে লেখে, চার জঙ্গিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছে তারা। কিন্তু কিছু ক্ষণের মধ্যেই টিটিপির মুখপাত্র মহম্মদ খোরসানি পাল্টা দাবি করে বসে, এটা তাদের কাজ নয়। খোরসানির মন্তব্য, এই কাজ শরিয়ত-বিরোধী। এর পরেই ফেসবুকে নিজের স্ট্যাটাস রিমুভ করে দেয় মনসুর। পরে অবশ্য বিকেলের দিকে সংবাদ সংস্থাকে ফোন করে মনসুর জানায়, লেখা মুছে দিলেও আগের বক্তব্য থেকে সরছে না।
জঙ্গিদের সংখ্যা নিয়েও বিতর্ক আছে। মনসুর ৪ জঙ্গির কথা বললেও প্রত্যক্ষদর্শীরা কেউ কেউ জানিয়েছেন, অন্তত দশ জন জঙ্গী সেই কিলিং মিশনে ছিল। তবে কি বাকিদের বাঁচাতেই কি মনসুর ৪ জঙ্গির কথা বলেছিল? নিহত জঙ্গিদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া দুটি মোবাইলে আফগানিস্তান থেকে কল এসেছিল।
এই হামলা প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের কর্তৃত্বের উপরে আঘাত বলেও মনে করছেন কূটনীতিকরা। তার আমলেই দেশের মাটিতে একের পর এক জঙ্গি হামলা হয়ে চলেছে। কয়েকদিন আগে ভারতের পঠানকোটে হামলার পিছনেও পাক জঙ্গিদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল। নওয়াজ তখন বলেছিলেন, জঙ্গি নিধনে তার সরকার দায়বদ্ধ। পঠানকোটে হামলা পর নওয়াজ ফোন করেছিলেন নরেন্দ্র মোদীকে। বুধবার নরেন্দ্র মোদী তাকে ফোন করে কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন। জানিয়েছেন সমবেদনা। নওয়াজ এ দিন ছিলেন জুরিখে। জঙ্গি কার্যকলাপ বরদাস্ত করা হবে না বলে বার বার বক্তব্য দিলেও পাকিস্তানে আসলে যে কিছুই বদলায়নি, এতগুলি নিরীহ প্রাণের বিনিময়ে সেটা আবারো প্রমাণ হয়ে গেল। ১৮টি ছাত্রের স্বপ্ন, আর কবিতা হারিয়ে গেল বুলেটের বৃষ্টিতে!