English Version
আপডেট : ৩ জানুয়ারি, ২০১৬ ১৫:৩৯

ফোন ট্র্যাকিং: ঠেকানো গেল বড়মাপের সহিংসতা

অনলাইন ডেস্ক
ফোন ট্র্যাকিং: ঠেকানো গেল বড়মাপের সহিংসতা
সেনা অভিযান এবং ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া পাক জঙ্গিদের গুলি।

বাক্যালাপ মাত্র ৪০ সেকেন্ডের। চোস্ত পঞ্জাবিতে বলা কথাটা শুনেই সন্দেহ করেছিল ভারতীয় গোয়েন্দারা। এক পাশ থেকে ছেলে বলছে, ‘ম্যায় কুরবানি দেনে যা রহা হুঁ’ (আমি নিজেকে কুরবানি দিতে যাচ্ছি)। অপর দিক থেকে ঠান্ডা গলায় মা বললেন, ‘পহলে খা লো, ফির যো করনে গিয়া ওহ করো’ (আগে খেয়ে নাও তারপর যা করার তা করো)। এটুকু শুনেই নড়েচড়ে বসে পঞ্জাব প্রশাসন। খবর যায় দিল্লিতে। সতর্ক করা হয় সব পক্ষকে।

এই সতর্কতার কারনেই পাঠানকোট বিমানঘাঁটিতে বড়ধরনের জঙ্গি হামলা ঠেকানো গেছে বলে দাবি ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রের। শনিবার ভোর রাত থেকে মোট ১৬ ঘণ্টার সেনা-জঙ্গী লড়াইয়ে চার জঙ্গি নিহত হয়। প্রাণ যায় তিন নিরাপত্তাকর্মীরও। সেটাও তো আর কম ক্ষতি নয়। তবে আগাম খবর পেয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় জঙ্গিদের বিমানঘাঁটির সেনাদের খাবার জায়গাতে আটকে ফেলা গিয়েছিল বলে সেনা সূত্রের দাবি।

ঘটনার শুরু হয়েছিল বৃহস্পতিবার শেষ রাত থেকে। পাঞ্জাব সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সুপার সালবিন্দর সিং কে তার মহীন্দ্রা এমইউভি গাড়ি-সহ অপহরণ করে সেনাবাহিনীর পোশাক পরা জঙ্গীরা। পরে সালবিন্দর ও তাঁর বন্ধু রাজেশ বর্মাকে গাড়ি থেকে ফেলে দিয়ে গাড়ি ও মোবাইলফোন নিয়ে পালায় তারা। গাড়ির তৃতীয় যাত্রী সালবিন্দরের রাঁধুনি মদনলাল এখনও নিখোঁজ। পুলিশ সুপারের অপহরণের খবর জানাজানি হওয়ার পরই তার দু’টি মোবাইল ফোন ট্র্যাক করতে শুরু করে গোয়েন্দারা। শুক্রবার গভীর রাতে একটি নাম্বার থেকে পাকিস্তানের নম্বরে ফোন করা শুরু হয়। প্রথম ফোনটিই এক জঙ্গি তার মাকে করে। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সালবিন্দরের মোবাইলে ফোন করেন তার দেহরক্ষী কুলবিন্দর। সেই ফোন রিসিভ করে এক জঙ্গি। সে সালাম দেয়ার পর কুলবিন্দর জানতে চান, এসপি সাহেব কোথায়? তার পরেই ফোন কেটে দেওয়া হয়। মোবাইল ট্র্যাক করে এইসব কথাবার্তা শোনার পর যুদ্ধকালীন তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। সরাসরি ঘটনার উপরে নজর রাখতে শুরু করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। জঙ্গিদের সম্ভাব্য লক্ষ্যগুলি চিহ্নিত করে নিরাপত্তা বাড়ানোর কাজে নামে সেনাবাহিনী। পাঠানকোট ছাড়াও নিরাপত্তা বাড়ানো হয় চণ্ডীগড়, হালওয়ারা ও অম্বালার বিমানঘাঁটিতে। সতর্ক করে দেওয়া হয় হিমাচল প্রদেশ এবং দিল্লিকেও। তবে পাঠানকোট বিমানঘাঁটিই সবচেয়ে ঝুঁকিপুর্ণ বলে মনে করেছিলেন অজিত ডোভাল। ফলে, রাতেই সেখানে পৌঁছে যায় এনএসজি এবং সেনাবাহিনীর বিশাল বহর। ইতোমধ্যে সালবিন্দরের ফোনে আড়ি পেতে আরও কয়েকটি কথোপকথন রেকর্ড করেন গোয়েন্দারা। শুক্রবার রাত সাড়ে বারোটা থেকে আড়াইটার মধ্যে পাকিস্তানে থাকা নিয়ন্ত্রণকারীকে ফোনে এক জঙ্গি জানায়, ‘‘আমরা পৌঁছে গিয়েছি। এ বার কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়ব।’’ হামলার নিয়ন্ত্রণকারী খুশি হয়ে বলে, ‘‘কী হচ্ছে আমাদের জানাতে থাকো।’’ জঙ্গিরা যে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছে, তা বুঝতে পারেন গোয়েন্দারা। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও তারা ঠিক কোথায় যাচ্ছে, তা বুঝতে পারছিলেন না তাঁরা।

ভোর সাড়ে তিনটের সময়ে পাঠানকোট বিমানঘাঁটির ‘থার্মাল ইমেজিং সিস্টেমে’ জঙ্গিদের গতিবিধি ধরা পড়ে। পেছন দিকের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ঘাঁটিতে ঢোকার চেষ্টা করছিল তারা। কাঁটাতার দেওয়া পাঁচিল টপকাতে গিয়ে নিহত হয় প্রথম জঙ্গি। বাকিরা দেওয়াল টপকে আশ্রয় নেয় পাশের খাবার জায়গায়। অর্থাৎ লঙ্গরে। সেখানেই শুরু হয় গুলির লড়াই। মূল লড়াইটা চলে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। জঙ্গিদের গুলিতে নিহত হন বিমানবাহিনীর এক গরুড় কমান্ডোসহ তিন জওয়ান।

এর পর শুরু হয় কম্বিং অপারেশন। বেলা বারোটা নাগাদ আবারো গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। সেনাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আরও জঙ্গি লুকিয়ে রয়েছে। শুরু হয় দ্বিতীয় দফা লড়াই। সেটা চলে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। এরপর স্বরাস্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং টুইট করে অভিযানের সমাপ্তির কথা ঘোষণা করেন।

প্রাথমিক ভাবে গোয়েন্দারা মনে করছেন, এই হামলার পিছনে রয়েছে মাসুদ আজহারের জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মহম্মদের। ১৯৯৯ সালে নেপাল থেকে অপহরণ করে কান্দাহারে নিয়ে যাওয়া ভারতীয় বিমান আইসি-৮১৪-র যাত্রীদের বিনিময়ে মাসুদ আজহারকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার। দু’বছর পরে আজহারের পরিকল্পনায় হামলা চালানো হয় ভারতীয় সংসদে। এ বার তার গোষ্ঠীর জঙ্গিরা কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ পাঠানকোট ঘাঁটিতে থাকা মিগ-২১ বাইসন বিমান ও এমআই-২৫ কপ্টার নষ্ট করতে চেয়েছিল বলে বিমানবাহিনী সূত্রের দাবি। তবে এখনো পর্যন্ত কোন জঙ্গি গোষ্ঠী হামলার দায় নেয়নি। গোয়েন্দারা হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করলেও নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে সরকারি ভাবে কোন অভিযোগ করা হয়নি। ইসলামাবাদও ঘটনার নিন্দা করে বলেছে, ‘‘সম্প্রতি দু’দেশের মধ্যে যে সম্প্রীতির আবহাওয়া তৈরি হয়েছে, তা ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর পাকিস্তান।’’ 

সূত্র : আনন্দবাজার