দেশে ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে ১ কোটি ৭৫ লাখ লোক

বর্তমানে বাংলাদেশে ১ কোটি ৭৫ লাখ ২০ হাজার মানুষ ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ১৩ জেলায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি। প্রতি বছর এ রোগে অসুস্থতা এবং মৃত্যুর প্রায় ৯৮ শতাংশ এই ১৩ জেলায় হয়ে থাকে।
জেলাগুলো রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও কুড়িগ্রাম।
এক্ষেত্রে ম্যালেরিয়ার উচ্চপ্রবণ এলাকা পার্বত্য অঞ্চলের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা। মধ্যপ্রবণ কক্সবাজার এবং বাকি নয়টি জেলা নিম্নপ্রবণ জেলা। তাছাড়া ম্যালেরিয়া প্রবণ উপজেলা রয়েছে ৭১টি।
২০১৭ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে বিশ্বে ৯১টি ম্যালেরিয়া প্রবণ দেশ রয়েছে। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত সর্বমোট রোগীর সংখ্যা ২১৬ মিলিয়ন। তবে ২০১০ সালের তুলনায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমেছে ১৮ শতাংশ। এই সময়ে বিশ্বে ম্যালেরিয়াজনিত মৃত্যুর সংখ্যা ৪ লাখ ৪৫ হাজার। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১ দশমিক ৪ মিলিয়ন, ঝুঁকিতে ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন এবং ম্যালেরিয়াজনিত মৃত্যু সংখ্যা ৫৫৭ জন। একই সময়ে বাংলাদেশে মোট আক্রান্ত হয়েছিল ২৯ হাজার ২৪৭ জন। এর মধ্যে উচ্চপ্রবণ এলাকায় ছিল ৯৩ শতাংশ। মৃত্যুবরণ করেছে ১৩ জন। আর স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবমতে ২০১৮ সালে এ পর্যন্ত ৪৫৬ জন আক্রান্ত হয়ে ছয়জন মৃত্যুবরণ করেছে।
এদিকে ২০৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়ামুক্ত বাংলাদেশের ভিশন নিয়ে কাজ করছে ‘জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচি’। এর মধ্যে রয়েছে ২০২১ সালের মধ্যে ১৩টি ম্যালেরিয়া প্রবণ জেলার মধ্যে ৮টি জেলায় ম্যালেরিয়া সংক্রমণ রোধ করা। জেলাগুলোর প্রতি হাজারে বার্ষিক সংক্রমণের হার ১ দশমিক ৫৮ থেকে কমিয়ে ০ দশমিক ৪৬ এর নিচে নামিয়ে আনা। একই সময়ের মধ্যে অবশিষ্ট ৫১টি জেলাকে ম্যালেরিয়া মুক্ত করা। ম্যালেরিয়ামুক্ত জেলাসমূহে ম্যালেরিয়া পুনঃসংক্রমণ প্রতিরোধ। এবং দেশে প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপেরামের (মারাত্মক ম্যালেরিয়ার জীবাণু) আবির্ভাব প্রতিহত করা।
ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মকৌশল সম্পর্কে জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. এমএম আক্তারুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান, ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সমন্বিত বাহক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম (আইভিএম) বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সচেতনতা বাড়াতে মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে উঠান বৈঠক, গোলটেবিল বৈঠক, সমাজের ধর্মীয় নেতারাসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে ম্যালেরিয়া বিষয়ক ওরিয়েন্টেশন সভা, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, পোস্টার, লিফলেট বিতরণসহ বিবিধ কর্মসূচি।
নির্মূল কর্মকৌশল সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, ম্যালেরিয়া আক্রান্তের বিষয়ে তদন্ত ও তার চারপাশের ৬০ ঘর পর্যন্ত এ রোগীর অনুসন্ধান করা হচ্ছে। হটস্পট এলাকা বা গ্রাম শনাক্ত করে ওই সব এলাকায় বিশেষ মশারি বিতরণ করা হয়। সারা বছর ধরেই এ প্রক্রিয়া চলমান রাখা। তাছাড়া সব জেলার সিভিল সার্জন, উপজেলার স্বাস্থ্য ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের, হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, ল্যাব-টেকনিশিয়ান, পরিসংখ্যানবিদ সহ সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে আমাদের ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী ওষুধ নেই।
ম্যালেরিয়া কর্মসূচির প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে এই সরকারি কর্মকর্তা বলেন, প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছে পার্শ্ববর্তী বা সীমান্তবর্তী দেশসমূহে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ এবং আন্তঃসীমান্ত চলাচলকারীদের মধ্যে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের প্রবণতা। ম্যালেরিয়াবাহক মশার আচরণগত পরিবর্তন ও তথ্যের সীমাবদ্ধতা। জনগণের ম্যালেরিয়া সম্পর্কিত ভীতি কমে যাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তন।
একই বিষয়ে ব্রাকের কমিউনিকেবল ডিজিসেস ও ওয়াশ কর্মসূচির প্রধান ডা. এম মোক্তাদির কবির বাংলানিউজকে জানান, ভারত-মিয়ানমারের সহযোগিতা ছাড়া ম্যালেরিয়া নির্মূল সম্ভব না। কারণ মশার কোনো বর্ডার নেই। আর দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে দক্ষ জনবলের ঘাটতি রয়েছে। কর্মী ও চিকিৎসকরা সেখানে থাকতে চায় না। এক্ষেত্রে তাদের সুযোগ-সুবিধা আরো বাড়াতে হবে।
সামগ্রিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বাংলানিউজকে বলেন, ২০১৭ সালে এদেশে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ-নির্মূল কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। তবে আমরা বেশ কিছু হাসপাতালে ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর খবর পাই না। এগুলো আমাদের জানা ও প্রতিবেদন করা জরুরি। তাছাড়া আমাদের এই মুহুর্তে কিছু কিছু এলাকার জন্য নৌ অ্যাম্বুলেন্সও দরকার। তবে আমরা আমাদের চলমান প্রকল্পগুলোতে ব্যাপক সফলতা লাভ করছি।