English Version
আপডেট : ২১ মার্চ, ২০১৬ ১৫:৪২

নড়াইল হাসপাতালে রোগীদের দূর্ভোগ চরমে

উজ্জ্বল রায়
নড়াইল হাসপাতালে রোগীদের দূর্ভোগ চরমে

ডাক্তার, নার্স, চিকিৎসা সরঞ্জাম, অবকাঠামো সংকটসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত নড়াইল আধুনিক সদর হাসপাতাল। ফলেে এই জেলার রোগীদের দূর্ভোগ এখন সাধারন নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়তই শিকার হতে হচ্ছে এ জেলার দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে।

জানা যায়, সামান্য কিছু সমস্যা নিয়ে নড়াইল আধুনিক সদর হাসপাতালে আসলে রোগীদের পাঠানো হচ্ছে পার্শ্ববর্তী জেলা যশোর, খুলনা, মাগুরা অথবা ঢাকাতে। এতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের দূর্ভোগ হচ্ছে চরম পযায়ে।

সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, আশির দশকের শুরুর দিকে নড়াইল সদর হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা শুরু হয়। জেলার ৩ উপজেলার প্রায় ৮ লাখ ৫০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল সদর হাসপাতালটি ২০০৫ সালের জুলাই মাসে ৫০শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত হয়। এর এক বছর পরে নানা প্রতিকুলতার মধ্যদিয়ে হাসপাতালের বারান্দায়, ওয়ার্ডের ভিতরে গাদাগাদী করে ১০০ শয্যা বসানো হলেও এর বিপরীতে ডাক্তার-কর্মচারী পদায়ন, চিকিৎসা সরঞ্জামসহ  অন্যান্য অনুমোদন আজও হয়নি।

১০০ শয্যার উপযোগী অবকাঠামোর উন্নয়নে ৮ কোটি টাকা প্রাক্কলিত মূল্যে ২০০৬ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া পুরাতন একতলা ভবনের উপর দ্বি-তলা ভবনের নির্মানকাজ ওই বছরের ডিসেম্বরে সম্পন্ন করার কথা থাকলেও ২০১২ সালে এসে তা শেষ হয়।

এদিকে হাসপাতালের নির্ধারিত ১০০ শয্যার সব সুযোগ সুবিধা সরকারীভাবে বরাদ্দ থাকলেও তা কোন কাজেই আসছে না। প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান, ওর্য়াডবয়, আয়াসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী পদ শূন্য রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে শূন্য আছে সিনিয়র সার্জারী কনসালটেন্ট, সিনিয়র মেডিসিন কনসালটেন্ট, এনেসথেসিয়া কনসালটেন্ট, নাক-কান-গলা কনসালটেন্ট, ইউনানী মেডিক্যেল অফিসার, রেডিওলজী কনসালটেন্ট, ৪জন ইমারজেন্সী মেডিক্যেল অফিসার ও ২জন মেডিক্যেল অফিসারের পদ। একজন সিনিয়র কার্ডিওলজী কনসালটেন্ট থাকলেও তিনি আসেন অনিয়মিত। । দু’টি এ্যাম্বুলেন্স, আলট্রাসোনোগ্রাম, কম্পিউটার অকার্যকর হয়ে রয়েছে দীর্ঘদিন যাবত।

ডায়াবেটিসসহ সাধারণ অনেক পরীক্ষায় হয় না এখানে। ১০০ শয্যার বিপরীতে এখানে মোট ৪২জন ডাক্তারের পদ থাকলেও নিয়োগ আছেন মাত্র ১১ জন ডাক্তার। হাতে গোনা দু’একজন বাদে যাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে রয়েছে দায়িত্ব পালনে উদাসীনতাসহ বিভিন্ন অভিযোগ।  নানা প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘ ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে একই জায়গায় অবস্থানকারী এসব ডাক্তার, নার্সরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ভাল চিকিৎসা পেতে ক্লিনিকে যাওয়ার উপদেশ দিয়ে থাকেন। যেখানে চিকিৎসা দেওয়া হয় মোটা অংকের ফিস নিয়ে। হাসপাতালে যথাযথভাবে সময় না দিলেও এদের অনেকেই শহরের একাধিক ক্লিনিকে পালাক্রমে সময় দিয়ে থাকেন। মাঝে মধ্যে এদেরকে জেলার অন্যত্র বদলী হলেও অল্পদিনের ব্যবধানে আবার এখানে ফিরে আসেন। বিভিন্ন সময় হাসপাতালে ভাল ডাক্তারের নিয়োগ হলেও দুই এক মাসের মধ্যেই তাদের বিদায় নিতে হয় অন্যান্যদের রোষানলে পড়ে।

হাসপাতালে নিয়মিত ঘোরাফেরা করেন বিভিন্ন ক্লিনিকের দালাল চক্র। এরা হাসপাতালে আসা রোগীদের বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তির জন্য মোটা অংকের কমিশন পান । হাসপাতালে ডায়াবেটিসসহ অনেক সাধারণ পরীক্ষাই হয়না। অন্যদিকে অভিযোগ আছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর  যোগসাজসে হাসপাতালের ঢ-জধু মেশিন, আলট্রাসোনোগ্রাম, কম্পিউটার মাঝে-মধ্যে অকার্যকর করে রাখা হয়। লোহাগড়া আর কালিয়া স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো ৫০  শয্যায় উন্নীত হলে ও সেখানকার অবস্থা একই রকম বলে স্বীকার করলেন জেলার সিভিল সার্জন ।

আবাসিক মেডিকেল অফিসারের তথ্য অনুযায়ী ১’শ শয্যার হাসাপাতালে বিশেষজ্ঞ সহ  চিকিৎসক থাকার কথা অন্ততঃ ৪২ জন সেখানে আছেন মাত্র ১১ জন। তা ও আবার অনিয়মিত । কোন কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সপ্তাহে ২ দিন মাত্র রোগী দেখেন । এছাড়া ৭৮ জন নার্সের মধ্যে আছে ৫৫ জন, আর টেকনিশিয়ান অ্যাসিসট্যান্ট সহ ৪র্থ শ্রেনীর অন্তত ২০৮ জন কর্মচারীর স্থলে আছে মাত্র ৯২ জন । প্রতিদিন হাজার হাজার লোক জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসলে লাইনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে চিকিৎসা নিতে হয় হতভাগ্য রোগীদের । ৩/৪ ঘন্টা লাইনে দাড়িয়ে ও চিকিৎসা সেবা না পেয়ে ফিরে যাওয়া রোগীর সংখ্যা কম নয় ।

অধিকাংশ ডাক্তারের চেম্বার বন্ধ থাকে বেশীরভাগ সময়ে । আবার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় বেশীর ভাগ রোগীকে স্থানান্তর করে দেয়া হয় যশোর অথবা খুলনার হাসপাতালে ।  হাসপাতালের প্যাথলজিতে কাজ করেন মাত্র ১ জন । পরিচিত রোগী ছাড়া কেউই সেবা পায়না হাসপাতালের প্যাথলজীতে। হাসপাতালে ভর্তি হয়েও বাইরে থেকে পরীক্ষা করে আসা রোগীর সংখ্যাই বেশী। অথচ পরীক্ষা করার জন্য প্রযোজনীয় সকল যন্ত্রপাতি রয়েছে  হাসপাতালে। প্যাথলজী আবার বেলা ১২ টার পরে বন্ধ করে দেয়া হয় । অভিযোগ আছে এই হাসপাতালের টেকনিশিয়ানরাই বাইরের প্যাথলজী গুলোতে কাজ করেন । হাসপাতালের আধুনিক যন্ত্রপাতির প্যাথলজী বেলা ১২টার পরে বন্ধ হয়ে গেলেও ডাক্তার, রোগী আর হাসপালের টেকনিক্যাল কর্মচারীদের উপস্থিতিতে জমজমাট  বিভিন্ন বেসরকারী প্যাথলজী  সেন্টারগুলোতে । রোগীদের অর্থ বাগিয়ে নিয়ে নিজেদের স্বার্থটাই কেবল দেখছেন এসব প্যাথলজীতে কাজ করা সরকারী হাসপাতালের  চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ানরা। ১০০ শয্যার মধ্যে কিছু বেড খালি রাখা হয় ,অসাধু কর্মচারীরা সুযোগ বুঝে দুর থেকে আসা রোগীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বেডে জায়গা করে দেন তাদের ।  প্রতিদিন অন্তত শ’খানেক রোগীকে হাসপাতালের মেঝেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে । হাসপাতালের ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নিয়ম অনুযায়ী ভর্তি হওয়া এ সকল রোগীদের যেন ভোগান্তির শেষ নেই । স্বাস্থ্য সেবার মান নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর হলে ও সরকারী দলের ছত্রছায়ায় কিছু ডাক্তার নিজেদের স্বার্থে নার্স  ও কর্মচারীদের ব্যবহার করে নিজেদের গন্ডি তৈরী করে অসহায় রোগীদের ডাক্তাদের নিজস্ব ক্লিনিকে  টেনে নিচ্ছেন আর জমি বেচে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা, আরএভাবে সর্বশান্ত হচ্ছে গরীব মানুষেরা। 

সরেজমিনে সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ২টা পর্যন্ত হাসপাতালে অবস্থান করে দেখা গেছে, চিকিৎসা সেবা নিতে এসে রোগীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন। গরমে তাঁদের নাভিশ্বাস অবস্থা। অপেক্ষা করতে গিয়ে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সকাল নয়টায় এসেছেন লক্ষ্মীপাশার গোপীনাথপুরের চায়না বেগম (৪০)। তাঁর সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয় সাড়ে ১২টায়।

তিনি বলেন, ‘প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা আগে টিকিট কেটে বসে আছি। ভিড়ের কারণে এখনো অপক্ষো করতে হচ্ছে।’ মল্লিকপুর গ্রামের সাহেরা বেগম তাঁর অসুস্থ ছেলে সাকিবকে (৯) নিয়ে বসে আছেন। অসুস্থু সাকিবকে মেঝেতে শুইয়ে দিয়েছেন। তিনি সাড়ে ১২টায় জানান, সকাল ১০টা থেকে এখানে বসে আছেন। ডাক্তার দেখাতে সিরিয়াল পাননি। এভাবে দিঘলিয়ার রহিমা বেগম (৬৭), পারমল্লিকপুরের সাবানা (৩৫), ঈশানগাতীর সাজেদা (৩০), রামপুররার সাবিনা (২৮), ইতনার মুক্তা খানমসহ (১৯) দুপুর সাড়ে ১২টায় অন্তত ৩৫০ জন রোগী চিকিৎসা নিতে বসে আছেন। 

নড়াইল সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) মুন্সী আসাদুজ্জামান  রোগী দূর্ভোগের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, হাসপাতালে ৪২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও মাত্র ১১ জন ডাক্তারের পক্ষে ১০০ শয্যার চিকিৎসা সেবা প্রদান দুরূহ হয়ে পড়েছে। কর্মরত চিকিৎসকদের মধ্যে কয়েকজন অন্যত্র বদলীর জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন। একজন ডাক্তারকে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে হয়।

দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত ডিউটি করার ফলে তাঁরা হাঁপিয়ে উঠেছেন। এ অবস্থায় এখানে এসে ডাক্তাররা থাকতে চায়না। আর এ ডাক্তার স্বল্পতার কারনে জরুরী বিভাগে রোগী আসলে তাদেরকে চিকিৎসা না দিয়ে বলা হয় এখানে হবেনা তাড়াতাড়ি যশোর বা খুলনা নিয়ে যান। সচেতন মানুষ মনে করেন ডাক্তারদের সেবা দেবার মানসিকতা গড়ে না উঠলে কোনদিনও সাধারন মানুষের কাছে চিকিৎসা সেবা সহজ হবে না। নড়াইলের সচেতন মানুষ দাবী দ্রূত এই হাসপাতলের প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিয়ে নড়াইলের  জনগনের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা হোক ।