English Version
আপডেট : ২৩ জুলাই, ২০১৬ ১৩:০৭

দর্শক অভাবে বন্ধ রাজশাহীর ৯০% হল

উজ্জ্বল রায়
দর্শক অভাবে বন্ধ রাজশাহীর ৯০% হল

জেলার সব শ্রেনীর মানুষের এক সময় বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল সিনেমা হল। একটু অবসর সময় পেলেই মানুষ ছুটে যেত সিনেমা হলে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে হাতে পেতো কাঙ্খিত টিকিট। আর এ সকল সিনেমা হলগুলো ঘিরে জমজমাট ব্যবসা করে জীবিকা চালাত পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ। এদের মধ্যে অনেকের একমাত্র উপার্জনের মাধ্যম ছিল এ হলগুলো নিয়ে। কিন্তু আজ বাস্তবতা হচ্ছে ভিন্ন। দর্শক শূন্যতায় এখন সেই সকল ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল বন্ধ।

রাজবাড়ীর ৫ উপজেলায় মোট বিশ সিনেমা হল রয়েছে। এর মধ্যে পাংশা ৪টি, কালুখালী ২টি, বালিয়াকান্দি ৬টি, গোয়ালন্দ ৩টি ও রাজবাড়ী সদর উপজেলায় ৫টি রয়েছে। এসব সিনেমা হলের মধ্যে এখন ১৮টি সিনেমা হলই বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে রাজবাড়ীর সদরে বসুন্ধরা ও সাধনা নামে ২টি সিনেমা হল থাকলেও তা চলছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে। চালু এই দুটি সিনেমা হল দর্শকের অভাবে যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছে কেউ কেউ।  

ভিনদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসনে আর তথ্য প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের ফলে আজ দেশীয় সংস্কৃতি হুমকির মুখে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, ১৫/১৬ বছর আগেও সিনেমা হলগুলোতে নতুন সিনেমা প্রদর্শনী শুরু হলে প্রথম ৪/৫ দিন ধারণ মতার চেয়েও অতিরিক্ত দর্শকের সমাগম ঘটতো। বর্তমানে ভারতীয় সিনেমা ও স্যাটেলাইটের আগ্রাসনে এবং ঘরে ঘরে ভারতীয় টিভি সিরিয়ালের দর্শকরা হলমুখো হতে চাচ্ছে না। আবার মানসম্মত ও শিণীয় সিনেমা তৈরি না হওয়াকেও দায়ী করছেন অনেকে।

গোয়ালন্দের বন্ধ হয়ে যাওয়া মোনালিসা সিনেমা হলের মালিক প্রকৌশলী মো. মজিবুর রহমান জানান, অবুঝ মন সিনেমাটি প্রদর্শন করার পর সেই সময় এক টানা বিরতীহীনভাবে ১৭ দিন দর্শকরা উপভোগ করেছে সিনেমাটি। এখন চায়ের দোকানে বসে দিবারাত্রি বিনা খরচে ২৪ ঘণ্টায় সিনেমা ও ভারতীয় সিরিয়াল দেখতে পারায় দর্শকরা এখন আর হলে আসছে না।

বালিয়াকান্দির প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বন্ধ হয়ে যাওয়া এক সময়ের জনপ্রিয় মধুমতি সিনেমা হলের মালিক ও সদর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মো. নায়েব আলী শেখ জানান, মানসম্মত সিনেমার অভাব আর ক্রমাগত লোকসানের কারণে হলটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি।

পাংশা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের স্নাতকের শির্থী রায়হান, বাবু ও সবুজ জানান, একটু বিনোদনের জন্য আমরা দল ধরে বন্ধুরা সিনেমা হলে যেতাম। বর্তমানে হলগুলোতে উন্নতমানের আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সিনেমা হলের পরিবেশ যুগপোযোগী না হওয়ায় এখন আর আমরা হলে যাই না। তাছাড়া অনেক হলের সিটে ছারপোকার উপদ্রব এবং অশ্লীল ছবি চালানোর কারণে আমরা হলে ছবি দেখতে যাই না।

উত্তরবঙ্গের জনপ্রিয় সিনেমা হল গাইবান্ধার নুপুর, গোবিন্দগঞ্জের হিরক, জয়পুরহাটের আনন্দ, পলাশবাড়ীর সাথীসহ অসংখ্য সিনেমা হলের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের দায়িত্বে থাকা বর্তমানে বালিয়াকান্দি উপজেলা প্রেসকাবের সভাপতি রঘুনন্দন সিকদার তার অভিজ্ঞতার আলোকে জানান, সিনেমা হলগুলো বন্ধ হওয়ার পিছনে ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেলের অবাধ বিচরণ এবং ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনের ফলে বাংলাদেশ চলচিত্র নির্মাতারা বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। ফলে তারা পিছিয়ে পড়ছে। নগ্ন ছবি প্রদর্শনের কারণে পারিবারিকভাবেই সিনেমা হলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দর্শকরা।

তাছাড়া হলগুলোর অব্যবস্থাপনার কারণে আজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কালের বিবর্তন ও কিছু স্বার্থন্বেষী মহলের কলকাঠিতেই আজ হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙালি ও বাংলাদেশের সংস্কৃতির ঐতিহ্য সেই সোনালি দিনগুলো।

রাজবাড়ী জেলার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নির্মল সাংস্কৃতিক একাডেমির অধ্য উত্তম কুমার গোস্বামী ও ঋষা শিল্পীগোষ্ঠীর পরিচালক গোলাম মোর্তবা রিজু জানান, আশির দশকে আমরা টাকা চুরি করে বাড়ি থেকে পালিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। এখন বিনোদনের মাধ্যম চলে এসেছে মানুষের হাতের মুঠোয়। মোবাইল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে দাঁড়ালেই বিনা খরচে সিনেমা দেখা যায়। তাছাড়া সিনেমা হলগুলোতে এখন যে ছবিগুলো প্রদর্শন করা হয় তা পরিবারের সঙ্গে বসে দেখা যায় না। তারা আশা ব্যক্ত করেন শিণীয় এবং মানসম্মত সিনেমা তৈরি করা হলে হলগুলো আবারও দর্শকে ভরে যাবে, ফিরে পাবে পুরনো রূপ।