যা করেছি মেরুদণ্ড সোজা রেখে করেছি : প্রিয়ঙ্কা চোপড়া

‘কোয়ান্টিকো’র সাফল্যের পর হলিউড নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ততার পরও নিজ দেশের সাফল্যটা ধরে রেখেছেন প্রিয়ঙ্কা চোপড়া। বুঝেছেন, ‘উর্দি’র মাহাত্ম্য! নিজের কাজ, নতুন সিনেমা, নতুন অভিনয় ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষ এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন এবেলা'কে। তারই চুম্বক অংশ দি ঢাকা পোস্টের পাঠকের জন্য তুলে দেওয়া হলো।
‘বাজিরাও...’ তো ‘দিলওয়ালে’কে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল? বছরের শুরুটা আপনার বেশ ভালই গেল তাহলে!
আমি তো ছবির প্রযোজক ছিলাম না। ফলে কে এগিয়েছে, কে পিছিয়েছে এটা আমি ভাল বুঝবও না। ম্যায়নে অপনা কাম কিয়া, ছাপ ছোড়া অওর চলি গয়ি। বাকি সব তো প্রযোজক বুঝবেন। ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক দিকপাল প্রযোজকেরা রয়েছেন। ফলে ও নিয়ে আমার ভেবে লাভ নেই!

কাশীবাঈয়ের চরিত্রে তো অভিনয়টা অনেকখানি নিচু তারে বেঁধেছিলেন, কিন্তু আলোচনা হল সবচেয়ে বেশি! জানতেন এটা হবে? জানতাম তো বটেই। কাশীবাঈ ছবিতে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। গল্পটা বাজিরাও-মস্তানির প্রেমেরই। সেটা ভুলে গেলে চলবে না। কিন্তু কাশীর কথা ইতিহাসই ভুলে গিয়েছিল! সঞ্জয় লীলা বনশালী তাঁকে ফিরিয়ে এনেছেন গল্পে। ছ’বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। বাজিরাও’কে ঘিরেই জীবন কেটেছে। কাশী নরম হলেও দুর্বল ছিলেন না। আমি ভাবিনি, এই পর্যায়ের প্রশংসা পাব। ছবি-মুক্তির পর যেদিন দেশে ফিরলাম, বাড়িটা ফুলে ভরে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল আমার জন্মদিন (হাসি)! কাশীবাঈ একটা মাইলস্টোন আমার কেরিয়ারে। কেরিয়ারের অন্য মাইলস্টোনগুলো কী? (একটুও না ভেবে) ‘অ্যায়েতরাজ’, ‘ফ্যাশন’, ‘বরফি’, ‘মেরি কম’। কিন্তু ‘বাজিরাও...’এর প্রচারে তো নয়ই, মুক্তির সময়ও আপনাকে দেখা গেল না...! মুক্তির পর রণবীর (সিংহ) আর দীপিকাকে একদমই পাওয়া যেত না। আমরা তাই নিজেদের মতো শিডিউল ভাগ করে নিয়েছিলাম। আমি বিদেশের প্রচারটা সামলেছিলাম। ওরা দেশেরটা। মুক্তির পরের সাক্ষাৎকারগুলো আমার করার কথা ছিল। থ্রি অফ আস আর সাচ আ ফরমিডেব্ল টিম! আর ভাবুন, ছবির গল্পটা কত প্রোগ্রেসিভ! সময়ের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে।
সেরা প্রশংসা কার থেকে পেলেন?
প্রতিবারই মিস্টার বচ্চন আমাকে চিঠি লেখেন। কাজ ভাল লাগলেই। আমাকে লেখেন, কিন্তু থাকে আমার মায়ের কাছে। শি হ্যাজ মেড আ কালেকশন অফ দোজ। আর চিঠিতে কী লেখা থাকছে, প্রত্যেকবার তার উপর নির্ভর করে মা আমার পারফরম্যান্সের বিচার করতে বসেন— ‘অমিতজি কি চিট্ঠি আয়ি হ্যায়, ইয়ে পিকচার অচ্ছি হোগি’! আমি তো অমিতজি’কে বলেই দিয়েছি, প্রতিবার চিঠি পাঠাবেন। নাহলে মা ভাববে আমি কাজে ফাঁকি দিচ্ছি (হাসি)! মা কিন্তু আবার ওঁর সামনে গেলে আর কথাই বলতে পারেন না!
শাহিদ কপূরও তো আপনার প্রশংসা করে টুইট করেছিলেন। ওঁর সঙ্গে কথা হয় আপনার?
খুবই ব্যক্তিগত প্রশ্ন এটা। যেটা সামনে আছে, সেটাই সকলে দেখুক। যেটা নেই, সেটা দেখাতে চাই না বলেই নেই।
‘জয় গঙ্গাজল’ নিয়ে কেমন প্রত্যাশা? খুবই জরুরি একটা ছবি। একটা গল্প বলতে বলতে সমাজের অনেকগুলো সমস্যার কথা তুলে ধরবে ছবিটা। কৃষকদের মৃত্যু নিয়ে দেশে এখন সকলে কথা বলছে। খুবই চিন্তার একটা পরিস্থিতি। রাজনীতি আর দুর্নীতির ফাঁসে আটকে সাধারণ মানুষ কীভাবে নাস্তানাবুদ হন, সেটাই প্রকাশ ঝা দেখাতে চেয়েছেন। জেন্ডার ডিবেটও এসেছে ছবিতে। খাকি উর্দি পরে নিলে আর পুরুষ-নারীর বিভাজনটার অস্তিত্ব থাকে না। ছবিতে আমার চরিত্রটা এক জায়গায় বলে, আমি ছেলে না মেয়ে, সেটা দিয়ে আমার বিচার করা উচিত নয়। আমি কাজটা কত ভাল করি, সেটা দিয়ে করা উচিত। গোটা ছবিতে বিনোদনেরও কমতি নেই। ছবিটা নিয়ে আমি খুবই গর্বিত।
এর আগে ফারহান আখতারের ‘ডন’এ ইন্টারপোল অফিসারের ভূমিকায় কাজ করেছেন। সেখান থেকে ‘কিউ’ নিলেন?
নাহ্, বাবার থেকে নিয়েছি। বাবা আর্মি অফিসার ছিলেন। আমি আর বাবা একসঙ্গে বসে নিজেদের জুতো পালিশ করতাম। এটা একটা রিচুয়ালের মতো ছিল। রোজ রাতে। বাবা নিজের ইউনিফর্মটা নিয়ে খুব গর্ব করতেন। সেটা আমাকে একটা শিক্ষা দিয়েছিল। বাবার উর্দির প্লিটগুলো সব সময় নিখুঁত থাকত। আমি দেখতাম, আমার স্কুলের ইউনিফর্মও যেন সে রকম হয়! বাবা বলতেন, পোশাকটা একবার পরে নিলে আমি যেন ‘কর্তব্যে’র প্রতিমূর্তি হয়ে যাই। আমি আর আমার দেশ তখন সমান! শ্যুটিংয়ের পোশাকটা পরে নিলে আমিও বেশ অন্যরকম হয়ে যেতাম! যদিও সেটা নকল (হাসি)! কিন্তু আমার চলাফেরা, কথা বলা অন্য রকম হয়ে যেত!
প্রচুর অ্যাকশনও তো করলেন!
সত্যিই প্রচুর! অনেক চোটও পেয়েছি। ‘কোয়ান্টিকো’র জন্যেও এমনকী! কিন্তু ব্যাপারটা খুবই উপভোগ করি। আর দৃশ্যগুলো নিজেই করি। স্টান্টম্যান তো আর আমার শরীরের ধরন-ধারণ জানবে না। জিনিসটা বিপজ্জনক। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার মতো হলে নিশ্চয়ই করব না। কিন্তু আর্থিকভাবে দেখলেও, স্টান্টম্যান রেখে প্রো়ডিউসারের টাকা নষ্ট করার দরকার বুঝি না। তাছাড়া আমার ভয়ও করে না।
বিদেশে কি ‘জয় গঙ্গাজল’এরও প্রচার করবেন?
আশা করি। ‘কোয়ান্টিকো’র শো বেড়ে গিয়েছিল বলে ‘বাজিরাও...’এর প্রোমোশনে থাকতে পারিনি। ফলে লন্ডন, কানাডা, নিউ ইয়র্কে প্রচারের কাজটা চুটিয়ে করেছিলাম। সাধারণত, ভারত থেকে গিয়ে বিদেশের প্রোমোশনগুলো করতে হয়। আমার ক্ষেত্রে তো সেটা নয়! বাইরেই থাকি। ‘জয় গঙ্গাজল’এর ক্ষেত্রেও তা-ই করব হয়তো।
বাইরে থাকাটা সয়ে গিয়েছে, নাকি দেশের জন্য মন কেমন করে?
বাড়ির জন্য মন কেমন করে। আমেরিকায় থাকাটা কেমন যেন হস্টেলে থাকার মতো! ঘরের গন্ধ, শব্দ, সবকিছুই আলাদা। এসব ব্যাপারে আমি ভীষণ ‘দেশি’! তাই যেখানেই যাই না কেন, সঙ্গে রাঁধুনি নিয়ে যাই। রোজ রাতে ভারতীয় খাবারই খেতে হয় আমাকে। রবিবার করে ডিম-পরোটা চাই! কে করে দেবে! ‘কোয়ান্টিকো’র টিমটাও দুর্দান্ত! গত বছর দিওয়ালিতে সেট’এ ওরা ডান্সার আর ঢোল নিয়ে চলে এসেছিল। দিয়া এঁকেছিল। সে কী কাণ্ড! ওরা যে আমাদের সংস্কৃতিটা দারুণ বুঝে প্ল্যান করেছিল, তা কিন্তু নয়। শুধু আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যই এত কিছু! আমি আবার ক্রিসমাসে একটা
র্যাপ-আপ পার্টি দিয়েছিলাম। ব্যাপারটা অনেকটা কালচারাল এক্সচেঞ্জের মতো!
সঞ্জয় লীলা বনশালীর পরের ছবিও নাকি আপনি করছেন?
তিন-চারটে ছবি নিয়ে ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। উনি কোনটা আগে করবেন, আমি কোনটা আদৌ করব— এসব নিয়ে অনেক আলোচনা বাকি। উনি আগে ঠিক করুন। আসলে সময়টা এখন এতই কম আমার হাতে। আপাতত ছ’টা ছবির প্রস্তাব রয়েছে। শর্টলিস্ট করা বাকি এখনও। বেশ কঠিন ব্যাপারটা।
অভিনয় করার সময় প্রতিটা চরিত্রে ‘প্রিয়ঙ্কা চোপড়া’ নিজে কতটা থাকেন?
(হাসি) প্রিয়ঙ্কাকে অভিনয় করার সময় দূর করে দিই একদম! আমার কাছে চরিত্রের ব্যক্তিত্ব তখন গুরুত্ব পায় বেশি। কখনও ফিল্ম স্কুলে যাইনি, অভিনয়ের তালিমও নিইনি। আমার প্রসেসটাই আলাদা। ছবি করতে করতেই অভিনয়টা এসে যায়। ফলে আলাদা করে কোনও দৃশ্য নিয়ে যে প্রস্তুতি নিতে হয়, এমন না। প্রচণ্ড ভাবি প্রত্যেকটা চরিত্র নিয়ে। তারপর তার ব্যক্তিত্ব কেমন হতে পারে, সেটাও ভাবনায় রাখি। কস্টিউম পরে সংলাপ বলতে গিয়ে আমাকে ভাবতে হয় না, প্রতিটা দৃশ্য কীভাবে করব।
বলিউডের অন্যতম ‘সেল্ফ মেড’ নায়িকা আপনি। গর্ব হয়? সত্যিই যা করেছি, নিজের মেরুদণ্ড সোজা রেখে করেছি। সেটা ভুল হোক বা ঠিক। কখনওই বলতে পারব না, যে এখনও পর্যন্ত আমার প্রতিটা সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল। প্রচুর গুবলেট করেছি তো বটেই! কিন্তু সেটাও আমারই দায়। ছবির লেখকদের উপর আসলে আমি সবচেয়ে বেশি ভরসা করি। ওঁদের লেখা গল্প থেকেই তো গোটা ছবিটা দাঁড়ায়। ফলে একটা ছবি যখন তৈরি হয়ে যায় আর লোকে বলে, প্রিয়ঙ্কাই এই চরিত্রটা করতে পারত, গর্ব তো হবেই! বিউটি প্যাজেন্ট থেকে নায়িকা— মনে হয় একটা ধারণা ভাঙতে পেরেছেন, যাঁরা মডেলিং করেন তাঁরা অভিনয় করতে পারেন না? আই থিঙ্ক ইট ইজ আ ফ্রেজ দ্যাট পিপ্ল শু়ড থ্রো আউট অফ দ্য উইন্ডো নাউ! ইন্ডাস্ট্রিতে এখন অনেকে আছেন, যাঁরা প্রথম জীবনে মডেল ছিলেন, পরে অভিনেত্রী হয়েছেন। জুহি চাওলা ছিলেন, ঐশ্বর্যা...সুস্মিতা তো বটেই। লারা দত্তকে ভুলে গেলে চলবে না। তারপর ক্যাটরিনা তো আছেই। অনেক মেয়েই শুরুটা মডেলিং দিয়ে করেন। পরবর্তী জীবনে অভিনয়টাকে কেরিয়ার বানালেও অনেকে র্যাম্পের আকর্ষণ এড়াতে পারেন না। কিন্তু সেটা নিয়ে তো কারও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অভিনয় ব্যাপারটাই খুব ইন্ডিভিজুয়াল। হয় তোমার ওটা আসে, না হয় আসে না!