ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে টাকা হাতিয়ে তালাক

মডেল ও অভিনেত্রী রোমানা ইসলাম স্বর্ণা (৪১) ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করেন কামরুল হাসান (৪৫) নামে এক সৌদি প্রবাসী ব্যবসায়ীকে। এরপর থেকেই পালটে যেতে থাকে তার জীবনযাপন।
চলাফেরায় আসে চাকচিক্য। আর এসব হয় কামরুলের থেকে হাতিয়ে নেওয়া টাকা দিয়ে। বিয়ের আগে ও পরে ওই প্রবাসীর কাছ থেকে মডেল রোমানা হাতিয়ে নেন প্রায় দুই কোটি টাকা।
ফ্ল্যাট ও গাড়ি ক্রয় এবং ব্যবসার কথা বলে দফায় দফায় নেওয়া অর্থ আত্মসাৎ শেষে ওই প্রবাসীকে তালাক দেন এই অভিনেত্রী।
রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে ‘ভালো যোগাযোগ’-এর ক্ষমতা দেখিয়ে হুমকি দেন কামরুল হাসানকে। সর্বশেষ আইনের দ্বারস্থ হলে গ্রেফতার হন রোমানা।
এরপর থেকে তার বিরুদ্ধে এমন অসংখ্য অভিযোগ আসা শুরু হয়েছে পুলিশের কাছে। এ ঘটনায় দায়ের মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ যুগান্তরকে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে আটক করা হয়েছে।
ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয়ের পর স্বর্ণা, তার মা, ছেলে, ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রী প্রবাসী কামরুলের কাছ থেকে টাকা নেওয়া শুরু করে।
সে যখন বিদেশ থেকে আসে তখন এই প্রতারক চক্র বাসায় নিয়ে উলঙ্গ করে তার ছবি তোলে। আর টাকা না দিলে সেই ছবি ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়।
প্রবাসীর কষ্টার্জিত টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় চক্রটিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরপর থেকে স্বর্ণার আরও প্রতারণার খবর আসছে। আমরা অভিযোগগুলো গুরুত্বসহকারে তদন্ত করছি।
পুলিশ ও ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৮ সালে সৌদি প্রবাসী কামরুল হাসানের সঙ্গে স্বর্ণার পরিচয় হয়। পরে ফেসবুকে কথোপকথন। এরপর থেকেই টাকা চাওয়া শুরু করে সে।
শুরুতে চলচ্চিত্র ও নাট্যজগতের রুগ্ণ দশার কথা বলে অর্থনৈতিক অসহায়ত্ব দেখিয়ে টাকা চায়। এরপর প্রশাসনের ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে দেবে বলে টাকা চায়।
অর্থ চায় সন্তানকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকার অভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করতে পারছে না-এমন মানবিক কারণ দেখিয়ে। উবারে গাড়ি দিয়ে অর্জিত অর্থ দিয়ে সংসার চালানোর কথা বলেও চাওয়া হয় অর্থ।
২০১৮ সালের নভেম্বরে ইউসিবিএল ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখায় রোমানার হিসাবে প্রথমে আড়াই লাখ এবং পরে আট লাখ টাকা পাঠান প্রবাসী। কামরুলের প্রবাসী বন্ধু রিপন চৌকিদারের ডেমরার বাসা থেকে নেন ১২ লাখ টাকা।
এই টাকা নিয়ে কেনেন গাড়ি। এরপর ফ্ল্যাট ব্যবসার কথা বলে স্বর্ণা এক কোটি টাকা চায়। এরপর সে কামরুলের বন্ধু যাত্রাবাড়ীর ফার্নিচার ব্যবসায়ী উজ্জ্বল শরীফের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা, মামা তোফায়েল আহম্মেদ বাবুল গোমস্তার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা নেয়।
ইউসিবিএল ধানমন্ডি শাখায় রোমানা ও তার মা আশরাফী আক্তার শেইলীর হিসাবে দফায় দফায় সর্বনিু এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত সাতবার নেন।
একইভাবে বড় অঙ্কের অর্থ নিতে থাকেন ছোট ভাই নাহিদ হাসানার রেমির ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ও সিটি ব্যাংকের উত্তরা শাখার হিসাবে। এভাবে ফ্ল্যাট কেনা বাবদ নেন ৬৬ লাখ আট হাজার টাকা।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, কামরুলের টাকায় কেনা গাড়ি দেখতে তাকে একদিন বাসায় ডাকেন রোমানা।
এরপর ব্ল্যাকমেইল করে নাশতার সঙ্গে চেতনানাশক মিশিয়ে উলঙ্গ ও অর্ধ-উলঙ্গ ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করে ছবি তোলে রোমানা ও তার পরিবারের সদস্যরা।
ধর্ষণ মামলার হুমকি ও সামাজিক মর্যাদা নষ্টের ভয় দেখিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয় প্রবাসী কামরুলকে। স্ট্যাম্পে নেওয়া হয় স্বাক্ষর। নিকাহনামায় নিজেকে বিধবা হিসাবে উল্লেখ করে রোমানা।
ভুক্তভোগী জানান, বিয়ের পর তার জীবনটা বিষিয়ে ওঠে। ১০ লাখ টাকা দেনমোহরের পাশাপাশি নেওয়া হয় ৩৩ ভরি স্বর্ণ।
এরপর তার চাহিদা বাড়তেই থাকে। কেনেন চার লাখ টাকা মূল্যের একটি ঘড়ি, দুটি নতুন মডেলের আইফোনসহ বিভিন্ন পণ্য।
কামরুল হাসান জানান, ২০১৯ সালের মার্চে বিয়ে করেন তারা। বিয়ের পর কামরুল সৌদি আরব চলে যান। সম্প্রতি তিনি দেশে আসেন। স্বর্ণাকে ফোন করলে সে রিসিভ করছিল না।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার দিকে স্বর্ণার বাসায় যান তিনি। তখন সে বাসায় ফেরেনি। রাত ২টা ৪০ মিনিটে বাসায় ফিরলে স্বর্ণা জানিয়ে দেয়, তাকে অনেক আগেই সে তালাক দিয়েছে।
এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে হত্যার হুমকি দেওয়া হয় তাকে। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার স্বর্ণার বিরুদ্ধে কামরুল মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন।
সন্ধ্যায় লালমাটিয়া ডি-ব্লক-এর একটি বাসা থেকে স্বণাকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে রোমানার আরও দুটি বিয়ে হয়েছে বলে জানান তিনি।
সর্বমোট এক কোটি ৪৮ লাখ ৬০ হাজার টাকার হিসাবের বাইরেও স্বর্ণা তার থেকে অর্থ নেয় বলে জানান এই প্রবাসী।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্বর্ণা অভিনীত একটি সিনেমা মুক্তি পায়। এ ছাড়া তিনি নাটক করেন এবং একাধিক বিজ্ঞাপনে মডেল হয়েছেন। এর পাশাপাশি তিনি এই প্রতারণায় জড়িয়েছেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এ চক্রের সঙ্গে রোমানার পরিবারের বাইরে আরও দুটি নাম আসে। জনৈক রিজভী ও সিহাব বিভিন্নভাবে রোমানা স্বর্ণাকে সহযোগিতা করত বলে জানা গেছে। তবে এদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
জেলগেটে একদিন জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ : এদিকে অভিনেত্রী রোমানা ইসলাম স্বর্ণাসহ তিনজনকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম মাহমুদা আক্তার শুক্রবার এ আদেশ দেন। হত্যাচেষ্টা, প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের এ মামলায় অপর দুই আসামি হলেন স্বর্ণার মা আশরাফী আক্তার শেলী ও আন্নাফি ইউসুফ ওরফে আনান।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার ইনস্পেক্টর দুলাল হোসেন আসামিদের আদালতে হাজির করে প্রত্যেকের পাঁচ দিন করে রিমান্ড আবেদন করেন।
আদালত রিমান্ড ও জামিনের আবেদন নাকচ করে আসামিদের একদিন করে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন।