প্রশান্তকে বমাল ফেরত আনার উদ্যোগ দুদকের

প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের বিরুদ্ধে ওঠা পাচার করা অর্থ ও তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশনের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, দুদকের মামলায় আদালতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর তাকে ফেরত আনতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলে ‘রেড নোটিস’ পাঠানো হবে। এছাড়া আদালতের অনুমতি পাওয়ার পর কানাডাসহ সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের মাধ্যমে তার পাচার করা অর্থসম্পদ ফিরিয়ে আনতে চায় দুদক। একই সঙ্গে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জব্দের পর রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতে আদালতে আবেদন করা হবে।
প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ২৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত ৮ জানুয়ারি মামলা করেছে দুদক। দুদক কর্মকর্তা ও প্রশান্তের একাধিক ঘনিষ্ঠজন জানিয়েছেন, প্রশান্তের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে থেকে ও শেয়ারবাজারে কারসাজির মাধ্যমে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের তথ্য পেয়েছে দুদক। তার বিরুদ্ধে দুদকে আরও বেশ কয়েকটি অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। প্রশান্ত বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন। সেখানে তার বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানাসহ বেশকিছু তথ্য এসেছে দেশ রূপান্তরের কাছে। জানা গেছে, প্রায়ই তিনি ভারতে আসেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা ও নদীয়ায় বসে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন।
দুদকের অনুসন্ধান তদারকি কর্মকর্তা ও পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছি প্রশান্ত কানাডায় অবস্থান করছেন। অর্থ পাচার আইনের ২৬(ক) ধারা অনুযায়ী কানাডা সরকারের কাছে তথ্য চেয়ে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকুয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানো হবে।’
দুদকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উপপরিচালক বলেন, ‘প্রশান্ত ও তার পাচার করা অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ। আদালতের আদেশ পাওয়ার পর যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ইন্টারপোলে তার বিরুদ্ধে রেড নোটিস ইস্যু করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দুদক ইতিপূর্বে বেশ কয়েক ব্যক্তির পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত এনেছে। অর্থ পাচার আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। এজন্য প্রথমে প্রশান্তের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ আইনি প্রক্রিয়ায় বাজেয়াপ্ত করা হবে। এজন্য বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও সংশ্লিষ্ট দেশি-বিদেশি অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতা নেওয়া হবে।’
কানাডাপ্রবাসী জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী বোখারী দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, প্রশান্তের সঙ্গে কানাডার যোগসূত্র প্রায় ছয় বছর ধরে। তিনি জনৈক প্রীতিশ কুমার হালদার ও সুস্মিতা সাহা মিলে ২০১৪ সালের ৩ জুলাই পিঅ্যান্ডএল হাল হোল্ডিং ইনকরপোরেটেড নামে কানাডায় একটি কোম্পানি খুলেছেন (যার ফাইল নম্বর : ৮৯৪২৯১৯; ঠিকানা : ১৬, ডিনক্রেস্ট রোড, টরন্টো, অন্টারিও এম৯বি ৫ডব্লিউ৪)। পরে প্রীতিশ কানাডার ওই ঠিকানাটি ব্যবহার করে প্রিয়সী সাহার সঙ্গে ২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর হালট্রিপ টেকনোলজি প্রাইভেট লিমিটেড (করপোরেশন আইডেন্টিফিকেশন নম্বর : ইউ৭২৫০১ডব্লিউবি২০১৮পিটিসি২২৮১৯২ ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর : ২২৮১২) ৪ এফআর, এফএল-৪ই, ১৮ মহাজাতি রোড, এলপি-১০০/২৬, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ-৭০০০৭৯, ভারত ঠিকানায় কোম্পানি খোলেন। যদিও সেখানে প্রিয়সীর ঠিকানাটি হচ্ছে : কে এন রায় লেন, কৃষ্ণনগর-১, নদিয়া, পশ্চিমবঙ্গ-৭৪১১০১, ভারত।
কানাডা প্রবাসী ও প্রশান্তের ঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তি দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, ‘চিরকুমার’ প্রশান্তের সঙ্গে ওই নারীদের সম্পর্ক রহস্যজনক। তিনি কানাডার টরন্টো শহরের ১৬, ডেনক্রেন্ট রোডে একটি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন। ওই বাড়িতেই তিনি থাকেন। প্রায়ই তিনি ভারতে যান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন ও দুদকের মামলার এজহারে বলা হয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানিসহ (বিআইএফসি) নামে ৮টি প্রতিষ্ঠান প্রশান্তের দখলে ছিল। প্রশান্ত শেয়ারবাজার লুটপাটকারীদেরও অন্যতম। তিনি শেয়ারবাজারে লেনদেন করতেন নিজের ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমেই। কেএইচবি সিকিউরিটিজ ও হাল ক্যাপিটাল লিমিটেডের মালিকানা ছিল তার। এর বাইরে আরও অন্তত ১০টি ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে শেয়ার কেনাবেচা করতেন প্রশান্ত। তিনি শেয়ার কিনে রাতারাতি তিনটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নেন। ওইসব কোম্পানির পরিচালক পদে বসান কাছের লোকজন। তার এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় কারওয়ান বাজারের ডিএইচ টাওয়ারে। প্রশান্তের নিয়ন্ত্রণে থাকা আরও প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, রহমান কেমিকেলস ও নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড, আজিজ ফাইবার্স জুট মিল। আজিজ জুট মিল শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আজিজ পাইপসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনতে প্রশান্ত বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করেন।
দুদকে জমা হওয়া অভিযোগ মতে, শেয়ারবাজার থেকে নর্দান জুটের শেয়ার কেনেন প্রশান্ত। সেখানে চেয়ারম্যান করা হয় পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জল কুমার নন্দীকে। আর পরিচালক করা হয় প্রশান্তের খালাত ভাই অমিতাভ অধিকারীকে। কোম্পানিটির পর্ষদে পরিচালক এ দুজনই। বুয়েট থেকে পাস করা অমিতাভ বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের কর্মকর্তা ছিলেন। চাকরি ছেড়ে তিনি প্রশান্তের ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। প্রশান্ত নিজেও বুয়েটে লেখাপড়া করেন।
প্রশান্তের ঘনিষ্ঠ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রশান্ত শেয়ারবাজার থেকে বড় অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করেন নদার্ন জুটমিলের মাধ্যমে। কুষ্টিয়ার বিসিকে অবস্থিত জুটমিলটি ছিল পাকিস্তানের আগা খান কোম্পানির। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মিলটি বন্ধ হয়ে যায়। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে জুটমিলটি প্রায় আড়াই কোটি টাকায় কিনে নেন প্রশান্ত। পরে ভারত থেকে কিছু মেশিনপত্র এনে মিলটি চালু করেন এবং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করেন। উজ্জ্বল কুমার নন্দীকে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও প্রশান্তের ঘনিষ্ঠ অনঙ্গ মোহন রায়কে এমডি করা হয়। নদার্ন জুট মিলের কার্যালয় প্রথমে মতিঝিল ও পরে কারওয়ান বাজারের ডিএইচ টাওয়ারে নেওয়া হয়। জুটমিলটির শেয়ার গ্যাম্বলিং (কারসাজি) করে প্রশান্ত শেয়ারবাজার থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন। অনঙ্গ নদার্নের পাশাপাশি আজিজ ফাইবার্স জুটমিলও দেখাশোনা করতেন।
দুদকের এজাহারে বলা হয়, প্রশান্তের সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান রহমান কেমিক্যালের শেয়ার কেনা হয় প্রশান্ত, অমিতাভ অধিকারীর নামে। এজন্য রহমান কেমিক্যাল, কেএইচবি সিকিউরিটিজের এমডি রাজীব সোম, আনন্দ মোহন রায়, রতন কুমার বিশ্বাস, পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, রেপটাইলস ফার্ম, আর্থস্কোপ লিমিটেড, নিউট্রিক্যাল লিমিটেডের নাম ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে রহমান কেমিক্যালের নামে ৫৩ কোটি টাকা, রেপটাইল ফার্মের নামে ৬০ কোটি টাকা, আর্থস্কোপের নামে ৬০ কোটি টাকা, নিউট্রিক্যালের নামে ৭৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়। রহমান কেমিক্যালের পরিচালক উজ্জ্বল প্রশান্তের ঘনিষ্ঠ ও অমিতাভ তার খালাতো ভাই।
গত ৮ জানুয়ারি দুদকের সহাকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরীর করা মামলা বলা হয়েছে, ‘প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রশান্ত ও তার প্রতিষ্ঠানের নামে কমপক্ষে ২৮৭ কোটি ৩৯ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৫ টাকার সম্পদ পাওয়া গেছে। অথচ পুরো চাকরি জীবনে প্রশান্ত বেতন-ভাতাসহ বৈধ পথে আয় করেছেন সর্বোচ্চ ১২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ফলে দুদক তার বিরুদ্ধে ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৫ টাকার অবৈধ সম্পদ থাকার অভিযোগ আনে। এছাড়া প্রশান্ত ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে ১ হাজার ৬৩৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা করেছেন, যা বিভিন্ন সময় তুলে নিয়েছেন। এর মধ্যে প্রশান্তের নামে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে ২৪০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, তার মা লীলাবতী হালদারের ব্যাংক হিসাবে ১৬০ কোটি টাকা এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে আরও ১২৩৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা জমা হয়। এসব টাকা তুলে নিয়ে প্রশান্ত কানাডা ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন বলে কমিশনের স্থির বিশ্বাস জন্মেছে। এছাড়া ভালুকার হাতীবেড় ও উথুরা মৌজায় ৯টি দলিলে ৫৮৯ শতাংশ জমি নিজ নামে কিনেছেন প্রশান্ত। যার দলিলমূল্য ১ কোটি ৩৪ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভালুকা উপজেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে শালবনের ভেতর উথুরা ইউনিয়নের হাতীবেড় গ্রামে প্রশান্ত রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড নামে কুমিরের খামার গড়ে তুলেছেন। রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড ও পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনালের রাজীব সৌম ও তার স্ত্রী শিমু রায়ের নামে ৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকার বিনিয়োগ আছে সেখানে। ২১ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত খামারটিতে এখনো কুমির আছে এবং সেটি দেখাশোনা করেন আরিফ হোসেন নামে প্রশান্তের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি।