English Version
আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ১৬:২৭

তিন এলাকার মাদকে বিষাক্ত মিরপুর

সম্প্রতি ডিএনসি ও পুলিশ ঝিলপার বস্তিতে অভিযান চালায়। এভাবেই রেড ক্রস দিয়ে বস্তির ২৫টি ঘরকে মাদক কারবারিদের আখড়া বলে শনাক্ত করা হয়
অনলাইন ডেস্ক
তিন এলাকার মাদকে বিষাক্ত মিরপুর

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন রহমতউল্লাহ। পরিবার নিয়ে থাকেন রাজধানীর মিরপুরের ১১ নম্বর সেকশনের বি-ব্লকে। তাঁর ছেলে আকাশ মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। এলাকার পরিবেশ সম্পর্কে রহমতউল্লাহর কাছে জানতে চাইলে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘ছেলেটারে নিয়া খুব চিন্তায় আছি। চারদিকে মাদক। ছোট বাচ্চারাও খাচ্ছে। বিক্রি করছে। অলিগলি সবখানে...।’

রহমতউল্লাহর মতো মিরপুরের আরো কয়েকজন অভিভাবক নিজেদের সন্তান নিয়ে একইভাবে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করলেন। কারণ একটাই—মাদক। মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে মাদক বাণিজ্যের অভিযোগ ও আলামত মিলেছে। অর্ধশতাধিক এলাকায় ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য বিক্রি চলছে। তবে সবচেয়ে বেশি ছড়াচ্ছে পল্লবীর কয়েকটি স্পট, রূপনগরের চলন্তিকা ঝিলপার এবং মিল্লাত ক্যাম্প এলাকা থেকে। পুলিশ, র‌্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) অভিযানে মাঝেমধ্যে দু-চারজন মাদক বিক্রেতা ধরা পড়লেও শীর্ষ কারবারিরা রয়েছে অধরা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মাদক স্পটে হানা দিয়ে শীর্ষ কারবারিদের ধরার চেষ্টা করছেন তাঁরা। অনেক কারবারিকে ধরা হলেও তারা জামিনে ছাড়া পেয়ে একই অপকর্ম করে চলেছে।

ডিএনসির ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলের উপপরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা বলেন, ‘মিরপুরে আমাদের নজরদারি আছে। সম্প্রতি চলন্তিকা বস্তিতে অভিযান চালিয়ে নাজুর আখড়া ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সেসহ শীর্ষ কারবারিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘মাদক কারবার সাধারণত গোপনে চলে। আর আলামত (মাদক) ছাড়া না ধরতে পারলে মামলা করা যায় না। এ কারণে তথ্য পেলে আমরা গোয়েন্দা নজরদারি করি। যে কেউ আমাদের কাছে পরিচয় গোপন করে এ কারবারিদের অবস্থান জানাতে পারেন। এতে কাজ করা সহজ হবে।’

সূত্র জানায়, রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প থেকে শুরু করে আমিনবাজার পর্যন্ত ইয়াবার নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন ইশতিয়াক নামে এক কারবারি। মিরপুরে তার বড় সহযোগী কাল্লু। মিরপুর-১১ (পল্লবী)-এর বি-ব্লকের কাল্লু গোটা এলাকায় ইয়াবা ছড়িয়ে দিচ্ছে। মিল্লাত ক্যাম্পের বড় ডিলার রুস্তম। বি-ব্লকের ২২ নম্বর লাইনের খলিল সরদারের ছেলে রুস্তম ফেনসিডিল ও ইয়াবার চেয়ে বেশি হেরোইন বিক্রি করে। একই এলাকায় ইসলামের স্ত্রী জমিলা, কলিমের স্ত্রী কালি, রুস্তমের ভাই আক্তার, মাহাবুবের স্ত্রী গোলাপী, আলী আহমেদের ছেলে সেলিম মাদক কারবারে জড়িত।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, মিল্লাত ক্যাম্পের বি-ব্লকের ২২ নম্বর লাইনে পরিচিত মাদক ক্রেতাদের দেখলে এগিয়ে আসে বিক্রেতারা। অনেক সময় ক্যাম্পের বাইরে বিক্রি করে। দুপুর ও সন্ধ্যার পর ফেনসিডিল ও ইয়াবা সেবনের দৃশ্য দেখা যায়। পুলিশ সেখানে গেলেও কারবারিদের বাসায় হানা দেয় না। পুলিশকে ম্যানেজ করে এই কারবার চলে বলেও দাবি করেন স্থানীয়রা।

এলাকাবাসী অভিযোগ করেছে, পল্লবীতে প্রকাশ্যে মাদক সেবন দেখা যায় প্রতিদিনই। মাদকের কারণে এলাকায় বৃদ্ধি পাচ্ছে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা। বিশেষ করে উঠতি বয়সী তরুণ ও যুবকদের নিয়ে চিন্তিত তাদের অভিভাবকরা।

স্থানীয় সূত্র জানায়, পল্লবীর বাউনিয়াবাদ এ-ব্লক থেকে সি-ব্লক পর্যন্ত, লালমাটিয়া বেইলি ব্রিজ, বাউনিয়াবাদ বাজার মাঠ, বাউনিয়াবাদ মহিলা মাদরাসার পেছন, বেড়িবাঁধ, কালসি কলাবাগান, কালসি কবরস্থানের পাশসহ প্রায় ২০টি স্পটে মাদকের ব্যবসা চলছে। স্পটগুলো আলাদাভাবে পরিচালনা করে ফরিদ, আলাউদ্দিন, আওয়াল, কামাল, আমির, রুস্তম, শাহ আলম, ইউসুফসহ কয়েকজন। আরো আছে পাখি, তার স্বামী বাবুল ও পুলিশ সোর্স মনির। অভিযোগ রয়েছে, খলিলুর রহমান নামের একজন স্পটগুলোর নিয়ন্ত্রক। 

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র মতে, কয়েকটি এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে মাদক বিক্রি করে কারবারিরা। এদের মধ্যে মিরপুর মাজার রোডের রাজা, কসাইটুলী বাগডাসার নাসির উদ্দীন, মিয়াবাড়ি হাজি রোড বস্তির মেহেরুন, মিরপুর-২ নম্বর সেকশনে ববি, মাজার রোডে রাজা, কাজীপাড়ায় হারুন মোল্লা, বাদশা মিয়া, বাবুল মিয়া, আল-আমিন, মাহমুদুর রহমান রিপন ওরফে ফেন্সি রিপন, পল্লবী সাংবাদিক কলোনির কালু, গুড্ডু, ছানা, বাদল, মুসলিম বাজার ঢালের নুরু, চলন্তিকা ক্লাব এলাকায় তপন, গিয়াসউদ্দিন, রূপনগর শিয়ালবাড়ির পারভেজ, পারভিন, হারুন, নানা ভাই, রাজু ও তার মা নাজমা ওরফে নাজু, আবু সাঈদ, সুমনও সক্রিয় রয়েছে। তাদের বেশির ভাগই ইয়াবার কারবারি।

মিরপুর এলাকার সবচেয়ে বড় মাদকের হাট বলা হয় চলন্তিকা ঝিলপার বস্তিকে। শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী নজরুল ওরফে নজু সর্দার তার দ্বিতল টিনের ঘরটিকে ইয়াবা ও হেরোইন সেবনের আখড়া বানিয়েছে। তার দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরা খাতুন ও বেয়ান ফেলানী স্পটের নিয়ন্ত্রক। নজুর নিজস্ব সিন্ডিকেট ছাড়াও অন্তত অর্ধ শত পুরুষ ও নারী ওই বস্তিতে মাদক ব্যবসায় জড়িত। বিক্রেতাদের মধ্যে আছে সোহেল, নাজিমুদ্দীন, ভাণ্ডারী, ফরিদ, আলম, ভাগ্না রনি, ফারুক সর্দার, শাহাদাৎ, রাসেল, সাজু, সুমন, জসিম, নাছির, মুসলীম, রিপন, জাকির ও সুমন।

সূত্রে জানা যায়, ১১ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি ডিএনসি ও পুলিশ ঝিলপার বস্তিতে অভিযান চালায়। সে অভিযানে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাসহ রাজনৈতিক নেতারাও ছিলেন। অভিযানে ৫০০ পুরিয়া হেরোইনসহ সোহেলকে গ্রেপ্তার করা হলেও নাজুসহ তালিকাভুক্ত অন্য কারবারিরা রয়েছে অধরা। বস্তির ২৫টি ঘরকে মাদক কারবারিদের আখড়া বলে শনাক্ত করা হয়। কয়েকটি ভেঙেও ফেলা হয়েছে। তবে রূপনগর ও চলন্তিকা এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, কারবারিরা এখন আশপাশে সরে গিয়ে মাদক বিক্রি করছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষায় আছে তারা।

রূপনগর থানার ওসি সৈয়দ সহিদ আলম বলেন, ‘দুই বছরে এই বস্তির বিরুদ্ধে আমরা ৮৩টি মামলা করেছি। আসামিরা জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। সম্প্রতি বড় অভিযান চালানো হয়েছে। মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’

 

সুত্র - কালেখন্ত

সুত্র - কালেখন্ত