English Version
আপডেট : ২৫ অক্টোবর, ২০১৭ ১৩:১৫

কুরিয়ার পার্সেলের আড়ালে অস্ত্র ও মাদকের কারবার!

অনলাইন ডেস্ক
কুরিয়ার পার্সেলের আড়ালে অস্ত্র ও মাদকের কারবার!

অবৈধ কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হচ্ছে দেশি-বিদেশি কুরিয়ার সার্ভিসগুলো। নিয়ন্ত্রণহীন এই সার্ভিস এখন অবৈধ পণ্য আনা-নেওয়ার মাধ্যম হিসেবেই ব্যবহার করছে অপরাধীচক্র। র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কড়াকড়ি আরোপের পরও থামছে না ভয়ংকর এই অপরাধীরা। ফলে কুরিয়ার সার্ভিসের পার্সেলে অস্ত্র-মাদক পাচার এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সর্বশেষ গত সোমবার কোকেনের বিকল্প মাদক হিসেবে ব্যবহৃত কিটোমিনের একটি চালান র‌্যাবের হাতে জব্দ হয়েছে। যার দাম প্রায় দুই লাখ টাকা। এই কিটোমিন ইউরোপে কোকেনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ ঘটনায় মাদক চোরাচালানে জড়িত তিন ‘হোতা’কে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানকারী সংশ্লিষ্টরা বিস্মিত হন। এই চালান আনার ক্ষেত্রেও অভিনব কৌশল অবলম্বন করে অপরাধীরা। চালান উদ্ধারের পর বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

পলিথিনের মোড়কে তোয়ালের ভাঁজে রাখা এই কিটোমিন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ইউরোপে পাঠানো হতো। গ্রেফতাররা মীর মঞ্জুর মোর্শেদ, মাহমুদুল হাসান ও হাবিবুল্লাহ খান। গত সোমবার সন্ধ্যায় মিরপুরের পল্লবীর ইস্টার্ন হাউজিংয়ে সাততলা বাড়ির একটি ফ্ল্যাট থেকে তাদের গ্রেফতার করে র‌্যাব-১-এর একটি দল। এ সময় ১৪৫টি বোতলের মধ্যে থাকা ১৪৫০ লিটার জি কিটোমিন, ৩৪টি সাদা তোয়ালে জব্দ করা হয়। প্রতিটি তোয়ালেতে ১০০ গ্রাম জি কিটোমিন স্প্রে করা হয়। তবে স্প্রে করা হতো অভিনব কায়দায়। বাজার থেকে কিটোমিনযুক্ত ইনজেকশন সংগ্রহ করা হতো। বোতল থেকে কিটোমিন স্টিলের হাঁড়িতে ঢেলে জ্বাল দিয়ে আরো ঘন করা হতো। ঠান্ডা হলে এটি স্প্রে করা হতো তোয়ালের ভাঁজে। শুকিয়ে গেলে তোয়ালেগুলো প্যাকেটে রাখা হতো। পরে কুরিয়ার সার্ভিসে করে বিদেশে পাচার করা হতো। বিদেশে নিয়ে আবার তোয়ালে থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে কিটোমিন তরল রূপে এনে বিক্রি করা হতো।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে র‌্যাবের পরিচালক (গণমাধ্যম) কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, গ্রেফতার হওয়া তিনজনের মধ্যে মীর মঞ্জুর মোর্শেদ লন্ডন থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে খামার ব্যবসা করছেন। মাহমুদুল হাসান এলএলবি স্নাতক ডিগ্রিধারী। হাবিবুল্লাহ খান এমবিএ করেছেন। তারা দুজনই একটি ব্যাংকের মার্কেটিং শাখায় কর্মরত। কিন্তু চাকরির আড়ালে মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। মুফতি মাহমুদ খান বলেন, মঞ্জুর মোর্শেদের ভাই মাহাদী মঞ্জুর ১৫ বছর ধরে স্পেনে রয়েছেন। তার সঙ্গে আরামাডো গঞ্জালেস নামে এক স্পেনের নাগরিকের পরিচয় হয়। গঞ্জালেস ও মাহাদী মিলে বাংলাদেশ থেকে কিটোমিন স্পেনে পাচারের পরিকল্পনা করে। কিটোমিন অস্ত্রোপচারের আগে রোগীর শরীরে দেওয়া হয়। তবে মাদক হিসেবে এর চাহিদা রয়েছে। এই কিটোমিন পাচারের জন্য চার মাস আগে এ দেশে আসেন গঞ্জালেস ও মাহাদী। তারা এ দেশের বাজার যাচাই করে তোয়ালেতে করে কিটোমিন পাচারের পদ্ধতি তিনজনকে শিখিয়ে যান। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার ব্যক্তিরা জানান, গত দুই মাসে তোয়ালেতে করে কিটোমিনের চারটি চালান স্পেনে পাঠিয়েছেন তারা।

এদিকে চলতি বছরের ১৯ মে কাতার এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে কানাডা থেকে চারটি কার্টনে করে আসা ১৩৬ কেজি ওজনের ব্যথানাশক ওষুধের কাঁচামাল জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর (সিআইআইডি)। ‘টিএনটি কুরিয়ারের’ এ চালানটি ঢাকার ঠিকানায় আসে। আর গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পান্থপথের হোটেল ওলিও ড্রিম হ্যাভেন থেকে ৮ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এদের মধ্যে একই পরিবারের চারজন, বাকি দুজন হোটেল কর্মকর্তা-কর্মচারী। র‌্যাব জানায়, ইয়াবার চালানটি চট্টগ্রাম থেকে কুরিয়ারের মাধ্যমে ঢাকায় আনা হয়। চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে নিরাপদভাবে মাদক চোরাচালানের কারবার করে আসছিল।

সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাচার ও অবৈধ লেনদেনে বাড়তি নজরদারি আরোপের ফলে হুন্ডি ব্যবসায়ীরাও বিকল্প পথ হিসেবে কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করছে। এর মাধ্যমে তারা দেশের ভেতর ও বাইরে অর্থ স্থানান্তর করছে বেআইনিভাবে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের গণপরিবহনসহ নানা মাধ্যম ব্যবহার করে এই চক্রটি হুন্ডি কারবার চালিয়ে যাচ্ছে।

দেশে প্রায় ৪০টি কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানি রয়েছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে এদের শাখা। প্রায় সব শাখার মাধ্যমেই তারা টাকা স্থানান্তর করে। এ প্রক্রিয়ায় শুধু একটি মোবাইল ফোন নাম্বারের ভিত্তিতে টাকা স্থানান্তর হয়ে যায়। ফলে লেনদেনের কোনো রেকর্ড থাকে না। যে কারণে অপরাধী চক্রটি টাকা স্থানান্তরের জন্য এই পথটি বেছে নিয়েছে। চোরাচালানের জন্য পার্সেলকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অপরাধচক্র। এক পণ্যের আড়ালে নিষিদ্ধ পণ্য প্যাকেট করে তা গন্তব্যে পাঠিয়ে থাকে। বিশেষ করে জাল ডলার, ইউরো, রুপি, হেরোইন, কোকেন, আফিম, ইয়াবা জাতীয় মাদক ছাড়াও গানপাউডার এবং নাশকতার কাজে ব্যবহার করা পার্সেল পাঠাতে অপরাধীরা সক্রিয় রয়েছে।

এ বিষয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, কুরিয়ার সার্ভিসে মাদক চোরাচালানিরা আন্তর্জাতিক মাফিয়াচক্রে জড়িত। এরা ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে। একই সঙ্গে কুরিয়ারের অসাধু কর্মীদের সঙ্গেও তাদের থাকে যোগসূত্র। এ কারণে তারা গোপনে পার্সেল গ্রহণ ও পার্সেল পাঠিয়ে থাকে। যোগসূত্রের কারণে কুরিয়ারের কর্মীরা পার্সেল স্ক্যানিং করে না, যা গুরুতর অপরাধ। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় দেশি ও বিদেশি নাগরিককে এ সংক্রান্ত অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকেও কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে অবৈধ বা নিষিদ্ধ পণ্য চোরাচালান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এমন একাধিক চক্রকে চিহ্নিত করা গেছে। যাদের ধরতে অভিযান চলছে।

সাত কুরিয়ার সার্ভিসে নজরদারি : কুরিয়ার সার্ভিসের সেবার ওপর নজরদারি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যেকোনো পার্সেল পাঠানোর আগে প্রেরণকারী ও প্রাপকের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি রাখার নতুন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কুরিয়ার সার্ভিসে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছে ডিএমপি। পুলিশের এই নির্দেশনার অনুলিপি কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ বলছে, ভুয়া ঠিকানা দিয়ে বেনামি চিঠি চালাচালি ছাড়াও কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে জঙ্গি অর্থায়ন, মানি লন্ডারিং ও অবৈধ পণ্য পরিবহনের অভিযোগ রয়েছে। দেশীয় কোনো কুরিয়ার সার্ভিসে স্ক্যান করে পণ্য পরিবহন না করায় অপরাধীরা এর সুযোগ নিচ্ছে। এমন বাস্তবতায় এখনই কঠোর সতর্কতামূলক পদক্ষেপ না নেওয়া হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

এদিকে বিদেশি সাতটি কুরিয়ার সার্ভিসের ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে গোয়েন্দারা। আন্তর্জাতিক সাতটি কুরিয়ার সার্ভিস হচ্ছে-অ্যারামেক্স ইন্টারন্যাশনাল, ডিএইচএল, টিএনটি এক্সপ্রেস ওয়ার্ল্ডওয়াইড, ইউপিএস, ফেডএক্স, স্কাইনেট ওয়ার্ল্ডওয়াইড এক্সপ্রেস ও বিএইআই এক্সপ্রেসের বিশেষ কিছু শাখায় গোপনে সোর্সও নিয়োগ করেছেন গোয়েন্দারা। এসব কুরিয়ারকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে আন্তর্জাতিক মাফিয়াচক্র। এমনকি ইন্টারপোলের পক্ষেও এর আগে কয়েকটি কুরিয়ারের পার্সেলের ওপর নজরদারি করতে মেইল বার্তা ঢাকার কাছে পাঠিয়েছিল। ওই সময় বড় দাগে হেরোইন চালান আটক করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

পাচারের বড় কয়েকটি ঘটনা : কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদক পাচারের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট বিভিন্ন সময় সেগুলো জব্দ করেছে। শুধু দেশীয় কুরিয়ার সার্ভিস নয়, বিদেশি কুরিয়ারের মাধ্যমেও আন্তর্জাতিক চোরাচালানচক্রের সদস্যরা মাদক পাচার করছে। চলতি বছরের ২২ এপ্রিল হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদেশ থেকে কুরিয়ারে আসা সাড়ে ৭০০ গ্রাম কোকেন জব্দ করা হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যালয় থেকে বিদেশি পিস্তল, ১৬ রাউন্ড গুলি ও দুটি ম্যাগাজিন উদ্ধার করে পুলিশ। ফলের কার্টনে ভরে এগুলো পাচারের চেষ্টা চলছিল। সাভারে কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যালয় থেকে বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন ও দুই রাউন্ড গুলিসহ একজনকে গ্রেফতার করা হয়।

চলতি বছর মাহবুবুর রহমান নামে নব্য জেএমবির সারোয়ার-তামিম গ্রুপের এক সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। বগুড়ায় একটি কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরির সুবাদে ওই অঞ্চলে জঙ্গিদের কাছে নানা ধরনের কুরিয়ারে পার্সেল পাঠাত সে। গত ১ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে নারায়ণগঞ্জে কুরিয়ার সার্ভিসে আনা ফ্রিজ থেকে চার হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। চলতি বছর নব্য জেএমবির সারোয়ার-তামিম গ্রুপের এক সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। সে বগুড়ায় একটি কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি করত। ওই অঞ্চলে জঙ্গিদের কাছে নির্বিঘেœ নানা ধরনের ‘গোপন পার্সেল’ পাঠাত সে।

২০১৬ সালে শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো সার্ভিস এলাকা থেকে ডিএইচএলের মাধ্যমে আসা ইলেকট্রনিক সামগ্রীর ভেতর থেকে ৭০ লাখ টাকার মূল্যের ১২টি স্বর্ণের বার ও ২১টি চেইন উদ্ধার করা হয়। রাজধানীর বায়তুল মোকাররমের নিউ খান ইলেকট্রনিক্স নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে থাইল্যান্ড থেকে চালানটি আসে। ২০১৫ সালের ২৮ নভেম্বর এস এ পরিবহনের চট্টগ্রামের কাঠের আলমারির নিচে ফলস প্যানেলে কৌশলে লুকিয়ে রাখা এক লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে র‌্যাব। কুরিয়ারে তা পাচারের চেষ্টা করছিল চোরাকারবারিরা। ২০১৪ সালে রাজধানীর মতিঝিলে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে অভিযান চালিয়ে মাল্টিমিডিয়া সাউন্ড বক্সের আড়ালে স্কচটেপে মোড়ানো পাঁচ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। ২০১৩ সালে ধানমন্ডিতে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ১৩ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ একজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ২০১৩ সালের ১৯ জুন রাজধানীর রামপুরা শাখার আন্তর্জাতিক কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান ডিএইচএলে অভিযান চালিয়ে ১৩০০ গ্রাম হেরোইনসহ একটি চালান জব্দ করে র‌্যাব।

২০০৮ সালের ৬ ডিসেম্বর ডিএইচএল কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে কানাডায় একটি পার্সেলে দুই কেজি হেরোইন পাঠানো হয়েছিল, যা হংকং কাস্টমস গোয়েন্দারা উদ্ধার করে। ওই পার্সেলটি উদ্ধারে সহায়তা করেছিল ইন্টারপোল। একই বছরের ১৭ জুন লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্ট একটি টি-শার্টের প্যাকেট থেকে আধা কেজি হেরোইন জব্দ করা হয়।