সীমান্তে দিনেদুপুরে চলছে মিয়ানমার মুদ্রার অবৈধ বাণিজ্য

রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনারা চালাচ্ছে মুসলিম রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ। আর দলে দলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে। এর প্রভাবে উখিয়া টেকনাফ সীমান্তে মিয়ানমারের মুদ্রা ‘কিয়াত’ হাত বদলে ছড়াছড়ি চলছে। রাষ্ট্রয়াত্ব ব্যাংক, স্থানীয় প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোন উদ্বেগ চোখে পড়ছে না। বাংলাদেশে ঢুকেছে প্রায় ৪ লক্ষাধিক মুসলিম রোহিঙ্গা।
এরমধ্যে অনুপ্রবেশকারী লক্ষাধিক রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্ব ও প্রশাসনের নীরবতার সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে অসাধু কিছু চক্র। ইতিমধ্যে সীমান্ত এলাকায় গড়ে তুলেছে সিন্ডিকেট। সীমান্তবর্তী ঘুমধুম, তুমব্রু, কাঞ্জারপাড়া, হোয়াইক্ষন একাধিক এলাকা ঘুরে দেখা গেছে। এক কথায় বলতে গেলে সীমান্ত এলাকা জুড়ে প্রকাশ্যে মিয়ানমারের মুদ্রা ‘কিয়াত’ এ রমরমা বাণিজ্য চলছে। তারা বৈদেশিক মুদ্রা আইনকে বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখিয়ে অনায়াসে চালিয়ে যাচ্ছে মুদ্রা বিনিময় বাণিজ্য। কোটি কোটি মিয়ানমারের মুদ্রা ‘কিয়াত’ দালাল ও হুন্ডি চক্রকর্তৃক হাত বদল হচ্ছে।
অথচ মুদ্রা বিনিময়ের জন্য সরকারি ভাবে এ পর্যন্ত কোন বুথ খোলা হয়নি। যে কারণে নির্যাতিত রোহিঙ্গা এখানে এসে দালাল সিন্ডিকেটের হাতে ফের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
জানা যায়, ২৪ আগস্টের পর মিয়ানমারের আরকান রাজ্যে সহিংস ঘটনার পর থেকে রাখাইনের মোট ১৭টি টাউনশীপের মধ্যে মংডু, বুচিদং ও আকিয়াবসহ ৩টি মুসলিম অধ্যুষিত টাউনশীপ থেকে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমান উখিয়া, টেকনাফ এবং নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে দলে দলে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন। এখনো তা অব্যাহত রয়েছেন। এখন বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ৫৪ কিলোমিটার সীমান্ত অঘোষিতভাবে উন্মুক্ত রয়েছে। এদের প্রত্যেকের কাছে থাকে কম-বেশী সে দেশের মুদ্রা ‘কিয়াত’ ও স্বর্ণালংকার রয়েছে। ভয়ানক জনপদ থেকে প্রাণ বাঁচাতে অর্ধাহারে-অনাহারে পাহাড়ে জঙ্গলে লুকিয়ে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়ে বহু কষ্টে দলে দলে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের পরেও এরা থাকেন তীব্র ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত। বৃদ্ধ ও শিশুদের অবস্থা তো আরও কাহিল। বাংলাদেশে পা রাখতেই অতি জরুরী হয়ে পড়ে নগদ টাকা। খাবার, শিশু খাদ্য এবং পানির চাহিদা মিটাতে এদেশি টাকার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এ সময়ে যদি ত্রাণসামগ্রী নিয়ে সাহায্যে আসা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সামনে পড়লে তো রক্ষা পাওয়া যায়। নয়তোবা নগদ টাকায় কিনে প্রয়োজন মেটানো ছাড়া কোন উপায় থাকেনা।
তাই পরিবারের চাহিদা মেটাতে কিয়াতের বদলে এদেশি টাকার সংগ্রহ করতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। টাকা বদলকারীরা এ সুযোগে তাদের আখের গোছানোর জন্য সহজ-সরল অশিক্ষিত রোহিঙ্গাদের অপেক্ষাকৃত কম টাকায় হাত বদল করে মোটা অংকের কিয়াত আদায় করছে। মিয়ানমারে কিল্লা মারা থেকে আসা নবি হোসেন (৪৫) বলেন, তিনদিনের অনাহারে ক্লান্ত শিশুদের খাবার ও বয়োবৃদ্ধ অসুস্থ মাতার ওষুধ কেনার জন্য ১ লক্ষ কিয়াত বদল করেছি। নাম না জানা এক টাকা বদলকারী তাকে মাত্র ৫ হাজার টাকা দিয়ে বিদায় করেছেন। এসময় উজর আপত্তি করেও কোন লাভ হয়নি। উক্ত চক্রটি পুলিশের ধমক দিয়ে টাকাগুলো হাতে নিয়ে উদাও হয়ে যায়। এভাবে অসংখ্য রোহিঙ্গা টাকা বদল করে প্রতারণার শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
রাচিদং লামারপাড়া গ্রাম থেকে আসা নুর আহম্মদ বলেন, ঘরবাড়ি, লালিত গবাদিপশুসহ বাড়ির নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ফেলে নাড়ি কাটা প্রিয় মাতৃভূমি ত্যাগ করে জীবন বাঁচাতে চলে আসার সময় সকলেই কাছে প্রচুর স্বর্ণালংকার এবং নগদ মিয়ানমারের মুদ্রা ‘কিয়াত’ ছিল। নতুন পরিচয়হীন মাটিতে পা দিয়ে অতি প্রয়োজনের তাগিদে মুদ্রা বিনিময় করার সুযোগ নেই। এপারে এসে ৫৪ কিলোমিটার সীমান্ত জুড়ে কোথাও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় বুথ চালু করা হয়নি। এর সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে পুরানো রোহিঙ্গাসহ স্থানীয় কতিপয় দালাল সিন্ডিকেট ও হুন্ডি ব্যবসায়ী চক্র।
জানা যায়, দলে দলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের প্রথম দিকে ১ লক্ষ মিয়ানমারের মুদ্রা ‘কিয়াত’ এর বিনিময় দেয়া হয়েছে বাংলাদেশি ২ হাজার টাকা। বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় এবং নিত্য নতুন সুবিধাবাদী দালাল সিন্ডিকেট অত্যন্ত লাভজনক এ ব্যবসায় নেমে পড়ার কারণে এখন বিনিময় দর কিছুটা উর্ধ্বমুখী। সরেজমিনে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে জানা গেছে, বর্তমানে ১ লক্ষ মিয়ানমারের মুদ্রা ‘কিয়াত’ এর বদলে ৪ হাজার ৩০০ টাকা দেয়া হচ্ছে। মিয়ানমারে বর্তমানে ৫০ কিয়াত, ১০০ কিয়াত, ২০০ কিয়াত, ৫০০ কিয়াত, ১ হাজার কিয়াত, ৫ হাজার কিয়াত, ১০ হাজার কিয়াত চালু রয়েছে। ৫০ কিয়াতের নিচে মুদ্রা নেই। পয়সাও এখন অচল।
এ বিষয়ে টেকনাফের একটি বেসরকারি ব্যাংকের ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম শাহিদ বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা বিনিময় হার অনুসারে বাংলাদেশি ১ টাকার সমমান মিয়ানমারের ১৬ থেকে ১৭ কিয়াত। বাংলাদেশি টাকা ও মিয়ানমারের কিয়াতের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ এর সুযোগ দালাল সিন্ডিকেট টাকা হাত বদল করে আঙ্গুল ফুলে রাতারাতি কলাগাছ বনে যাচ্ছে।
তাছাড়া সীমান্ত এলাকার স্বর্ণকারদের পোয়াবারো অবস্থা চলছে। প্রয়োজনের তাগিদে হাজার হাজার রোহিঙ্গা দায়ে পড়ে তাদের ব্যবহৃত স্বর্ণালংকার নিরুপায় হয়ে বিক্রি করে দিচ্ছেন। দুর্বলতার এ সুযোগে স্বর্ণালংকার ভাল মানের নয়, ভেজাল ইত্যাদি তালবাহানা করে স্বর্ণকাররা নাম মাত্র মূল্যে কিনে নিচ্ছেন। স্থানীয় প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা নিয়ে এত বেশী ব্যস্ত, এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় এবং সুযোগ নেই বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাইনুদ্দিন সাংবাদিকদের তার মতামত ব্যাক্ত করছেন। ক্ষেত্র বিষেশে এলাকার কিছু কিছু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রোহিঙ্গাদের সাথে অভিনব প্রতারণার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের অর্থকড়ি স্বর্ণালংকার, গবাদিপশু হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। উখিয়া থানার ওসি মো. আবুল খায়ের বলেন, রোহিঙ্গা জিম্মি করে তাদের সহায় সম্পদ আত্মসাতের অভিযোগে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। উক্ত মামলায় ৪ থেকে ৫ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সীমান্ত অতিক্রম দলে দলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের প্রেক্ষিতে মুদ্রা বিনিময়ের জন্য বিশেষ বিবেচনায় বুথ স্থাপন বা অন্য কোন ব্যবস্থা আছে কি-না জানতে চাইলে রাষ্ট্রয়াত্ব বাংলাদেশ সোনালী ব্যাংক টেকনাফ শাখার ব্যবস্থাপক মো. ওসমান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ সম্পর্কিত কোন নির্দেশনা আসেনি। তাছাড়া প্রচলিত নিয়ম অনুসারে মিয়ানমারের মুদ্রা ‘কিয়াত’ স্থানীয় কোন ব্যাংকেই বিনিময় করার সুযোগ নেই’।