English Version
আপডেট : ২৬ আগস্ট, ২০১৭ ১২:২৯

কোরবানির পশু আনতে ঘাটে ঘাটে চাঁদা

অনলাইন ডেস্ক
কোরবানির পশু আনতে ঘাটে ঘাটে চাঁদা

রাত ২টা। মানিকগঞ্জের তরাব্রিজ। হাইওয়ে পুলিশের ইশারায় থামল পশুবোঝাই ট্রাক। হাত বাড়াল পুলিশ। ১০০ টাকা দিতেই ফুঁসে উঠলেন পুলিশ সদস্য। বললেন, ৫০০ লাগবে। বললাম স্যার, এত ট্যাকা দিতে পারমু না, একটু কম নেন। পুলিশ সদস্যের ভাষ্য, লাখ লাখ টাকার গরু বেচবি, ৫০০’ টাকা দিতে পারবি না? পরে অবশ্য ৫০০’ টাকা দিয়েই ঢাকার পথ ধরেন বগুড়ার এক পশু ব্যবসায়ী।

শুক্রবার বেলা ১১টায় রাজধানীর আফতাবনগরের পশুর হাটে বসে এসব জানান ভুক্তভোগী পশু ব্যবসায়ী বাবুল আকন। তিনি জানালেন, দেশের অধিকাংশ মহাসড়কেই প্রতি ১৫-২০ কিলোমিটারে পুলিশকে ১০০ থেকে ২০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। কোথাও কোথাও ৫০০’ টাকাও দেওয়া লাগে। দেশের উত্তর, দক্ষিণ কিংবা পূর্ব-পশ্চিম যে দিকেই যান, টাকা ছাড়া গাড়ি চলে না। রাত-বিরাতে প্রতিঘাটেই চাঁদা দিতে হয়। কোনো ছাড় নেই। অন্যান্য বছরের মতো এবারও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকায় ১০টি গরু নিয়ে আসেন আবদুর রাজ্জাক। তিনি আফতাবনগরের গরুর হাটে বসেছেন। এখন পর্যন্ত তার কোনো গরু বিক্রি হয়নি। তিনি জানান, চাঁপাই থেকে ঢাকায় আসতে অন্তত ১৫টি স্থানে তাকে চাঁদা দিতে হয়েছে। স্থানীয় মাস্তান ও পুলিশ এ চাঁদা নিয়েছে। গরুপ্রতি চাঁদা দিতে হচ্ছে ১০০ থেকে দেড়শ’ টাকা। টাকা না দিলে পশুবোঝাই ট্রাক আটকে রাখা হয়। বাবুল আকন কিংবা রাজ্জাক নয়, ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিয়েই ঢাকায় পশু নিয়ে ঢুকেছেন চুয়াডাঙ্গার পশু ব্যবসায়ী আবদুর রহিমও।

ঈদ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকায় পশুবোঝাই ট্রাক ঢুকতে শুরু করেছে। দেশের দক্ষিণ ও উত্তরবঙ্গ থেকে আসা ট্রাক রাজধানী দিয়ে অন্য জেলাগুলোয়ও যাচ্ছে। পশুর হাটে গরু আনতে সরকার নির্ধারিত কর দেওয়ার পরও পথে পথে চাঁদা দিতে হচ্ছে। ট্রাক থেকে চাঁদা আদায়ের জন্য রাজধানীর প্রবেশমুখেই রয়েছে অর্ধশতাধিক পয়েন্ট। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কোরবানির পশু নিয়ে ঢাকায় ঢুকতে এসব স্থানে চাঁদা পরিশোধ করতে হচ্ছে। একশ্রেণির পুলিশ সদস্য, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিক ও পেশাদার চাঁদাবাজ পশুবোঝাই ট্রাক থেকে চাঁদা তুলছে। ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হচ্ছে পশু ব্যবসায়ীদের। উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকা আসতে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা ও দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় একই পরিমাণ চাঁদা গুনতে হয়।

প্রতিবারের মতো এবারও কোরবানির পশুকে ঘিরে বেপরোয়া চাঁদাবাজরা। ফলে ঢাকামুখী পশু ব্যবসায়ীদের ঘাটে ঘাটে গুনতে হচ্ছে চাঁদা। মহাসড়ক থেকে ফুটপাত, লঞ্চঘাট, ফেরিঘাট, বাস টার্মিনালসহ সর্বত্রই চলছে নীরব চাঁদাবাজি। অন্যদিকে, চাঁদাবাজদের প্রতিরোধে মাঠে নেমেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তৎপর পুলিশও! জানা গেছে, চাঁদাবাজি বন্ধে পুলিশ সদর দফতর বিশেষ নির্দেশনাও দিয়েছে মাঠ পুলিশকে। কিন্তু মাঠ পুলিশ সেই নির্দেশনা আমলেই নিচ্ছে না।

পশু ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ট্রাক চালকদের অভিযোগ, পুলিশ ও তাদের সোর্সরাই ট্রাক আটকে চাঁদা আদায় করে। টাকা না দিলে ট্রাক ঢাকায় প্রবেশ করতে দেয় না। মাওয়া বা আরিচা ঘাট এলে ফেরির সিরিয়াল পেতেই দিতে হয় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকায় আসতে আড়িয়াল খাঁ, ফরিদপুরের ভাঙা, হাসারা, নিমতলী, কালীগঞ্জ নতুন রাস্তা ও পদ্মার দুপারে টাকা গুনতে হয়। এ ছাড়া রাজধানীতে প্রবেশের সময় বাবুবাজার, পোস্তগোলা ও সাভারে পুলিশের সোর্সদের টোকেন নিতে হয়। উত্তরবঙ্গ থেকে ট্রাক নিয়ে ঢাকায় ঢুকতে গাজীপুর চৌরাস্তা, বাইপাইল, আশুলিয়ায় হাইওয়ে পুলিশ ও সার্জেন্টরা ওঁৎপেতে থাকে।

অভিযোগ রয়েছে, যদি কোনো ব্যবসায়ী চাঁদার টাকা দিতে রাজি না হন তাহলে তাকে ট্রাকসহ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওই চেকপোস্টেই আটক করে রাখা হয়। পরে গরুর স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে চাহিদা মতো চাঁদার টাকা পরিশোধ করেন ব্যবসায়ীরা। শুধু মহাসড়কেই নয়, রাজধানীর পশুর হাটে ঢুকতেও ব্যবসায়ীদের চাঁদা গুনতে হচ্ছে। ময়লা পরিষ্কারের নামে, ঈদ বখশিশের কথা বলে হাট ইজারাদারদের লোকজন অতিরিক্ত টাকা আদায় করে থাকেন। পশু পরিবহনে চাঁদাবাজি চলে ধাপে ধাপে।

শুধু হাটে ঢুকতেই নয়, পশুর হাট থেকে গরু কিনে অন্যত্র নিতেও পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। তাই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করেন ট্রাকচালকরা। পশু পরিবহনে চাঁদাবাজির বিরূপ প্রভাবও বহুমুখী। হাটে পশুর দাম বেশি হওয়া মানে বিক্রি কমে যাওয়া। বিক্রি কম মানে হাটসংশ্লিষ্ট অন্যদের আয়ও কমতির দিকে থাকবে। আর দাম চড়ার কারণে যদি বাজারে তোলা সব পশু বিক্রি না হয়, তাহলে ফিরতি পথের খরচ তো আছেই, চাঁদার বোঝাও পশু ব্যবসায়ীদের বহন করতে হয়। পশুর হাটে কেবল বিক্রেতা নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হন ক্রেতারাও।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসতে প্রতিটি মহাসড়কে পুলিশের কমপক্ষে ১৫-২০টি চাঁদা তোলার ঘাট (পয়েন্ট) রয়েছে। ঘাটভেদে চাঁদার পরিমাণ ৫০ থেকে ৫০০ টাকা। চাঁদা না দিলে চালককে অকথ্য ভাষায় গালাগাল ও মারধর করা হয়। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান মহাসড়ক ঢাকা-আরিচা রোডে প্রতিদিন বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির কয়েক হাজার যানবাহন যাতায়াত করে থাকে। এ পয়েন্টটি পরিবহন চাঁদাবাজির অন্যতম বড় স্পট। এক একটি ঘাটেই প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদা উঠছে। প্রকাশ্যে আদায় করা হচ্ছে চাঁদা। গাড়ির চালকরাও তা দিয়ে চলেছেন। যেন এটিই নিয়ম। কোরবানির ঈদে পশুবোঝাই ট্রাকে চাঁদার রেট একটু বেশি।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, এবারের কোরবানি ঈদে যাতে কোনো ধরনের চাঁদাবাজি না হয় সেদিক নজর দিতে পুলিশ-র‌্যাবকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ ও শাসক দলের কেউ যদি চাঁদাবাজিতে লিপ্ত থাকার প্রমাণ মিলে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতার করাসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চাঁদাবাজদের রুখতে ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে রয়েছেন। প্রতিটি হাটে গোয়েন্দা নজরদারিও আছে।

ট্রাক-ট্রলারে আসছে গরু: দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রাক ও ট্রলারে করে রাজধানীতে আসছে কোরবানির পশু। এবার সবচেয়ে বেশি গরু-ছাগল-মহিষ আসছে দিনাজপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, জয়পুরহাট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, যশোর, সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রাম থেকে। দিনের তুলনায় রাতেই বেশি ঢুকছে ট্রাকভর্তি গরু। গতকাল আফতাবনগরের পশুর হাটে গিয়ে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত দেশি গরুই বেশি। পাবনার বেপারি রমজান মিয়া বলেছেন, ঢাকায় গরু নিয়ে আসতে ট্রাকভাড়াসহ খরচ অনেক বেশি। তাই গরুর দাম বেশি হবে। সিরাজগঞ্জের বেপারি আহমেদ শরীফ বলেন, গেল বছর বেশি লাভ করতে পারিনি। এবার বেশি দামে বিক্রি করব। কারণ একটি গরু বড় করতে অনেক খরচ; অনেক কষ্ট।

মিয়ানমার-ভারত থেকে আসছে গরু: ভারত থেকে গরু আমদানি বন্ধ থাকলেও চোরাই পথে ঠিকই গরু আসছে। সাতক্ষীরাসহ কয়েকটি সীমান্ত দিয়ে এসব ভারতীয় গরু বাংলাদেশে ঢুকছে। এ ছাড়া মিয়ানমারের গরু আসছে কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্ত দিয়ে। মিয়ানমারের গরু দেখতে অনেকটা দেশি গরুর মতো। কিন্তু দাম দেশি গরুর চেয়ে কম। কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বৈধভাবেই গরু আমদানি করা হচ্ছে। এ ছাড়া বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন চোরাই পথ দিয়ে ঢুকছে মিয়ানমারের গরু।

হাটে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা: এবার রাজধানীতে মোট ২২টি পশুর হাট বসেছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ১০টি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ১২টি হাট বসেছে। হাটগুলোর নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে নেওয়া হয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নিরাপত্তায় বসানো হয়েছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। টহল দিচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। আছে অস্থায়ী কন্ট্রোল রুম, ওয়াচ টাওয়ার, জাল টাকা শনাক্তকরণ মেশিন ও অতিরিক্ত অর্থ পরিবহনে বিশেষ মানি এসকর্ট সুবিধা। জাল টাকার বিস্তার ও লেনদেন ঠেকাতে পশুর হাটগুলোয় সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন আছে। সান্ধ্যকালীন ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ বহনে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের সহযোগিতা দেওয়া হবে।