দেড় হাজার কোটি টাকা অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে দুদক

জীবন বীমা খাতের ১৭টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দেড় হাজার কোটি টাকার অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ) এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে এরই মধ্যে কমিশনে প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে দুদকের অনুসন্ধান দল।
ব্যবস্থাপনার নামে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের অভিযোগ পাওয়ার পর উপপরিচালক মো. জালাল উদ্দিনের নেতৃত্বে দুদকের দুই সদস্যের একটি দল গত বছরের ২১ জুন অনুসন্ধান শুরু করে। এর অংশ হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় অভিযুক্ত কোম্পানিগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), প্রধান হিসাব কর্মকর্তা, কোম্পানি সচিব ও বিপণন প্রধানদের।
জিজ্ঞাসাবাদে ব্যবস্থাপনার নামে অবৈধভাবে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের প্রমাণ পান অনুসন্ধান কর্মকর্তারা।
অনুসন্ধান তদারককারী কর্মকর্তা ও দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, কোম্পানিগুলো যে অতিরিক্ত ব্যয় করেছে, আমাদের অনুসন্ধানে তা প্রমাণিত হয়েছে। অনুসন্ধান দলের প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেয়া হয়েছে। কমিশন আমাদের যে নির্দেশনা দেবে, সে অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অতিরিক্ত ব্যয় প্রমাণ হলেও এর দায় নিতে চাইছেন না কোম্পানির পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীরা। একে অপরের ওপর দায় চাপাচ্ছেন তারা। প্রধান নির্বাহীরা বলছেন, জীবন বীমা কোম্পানির ব্যয়সহ যাবতীয় এজেন্ডা অনুমোদন হয় পরিচালনা পর্ষদ থেকে। শেয়ারহোল্ডারদের পক্ষে এসব বিষয়ে অনুমোদন দেন কোম্পানির পরিচালকরা। পর্ষদের অনুমোদন ছাড়া অতিরিক্ত ব্যয়ের সুযোগ নেই এমডি বা সিইওদের।
বীমা কোম্পানির প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের প্রেসিডেন্ট ও পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সিইও বিএম ইউসুফ আলী এ প্রসঙ্গে বলেন, এটা কোনোভাবেই অতিরিক্ত ব্যয় নয়। শুরু থেকে বীমা কোম্পানিগুলো এভাবে চলে আসছে। আর অতিরিক্ত ব্যয় যদি হয়েও থাকে, সেজন্য প্রধান নির্বাহীরা এককভাবে দায়ী নন। কারণ কোম্পানির যাবতীয় ব্যয়ে পরিচালনা পর্ষদ, শেয়ারহোল্ডার ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন রয়েছে। তাহলে এ ব্যয় অবৈধ হয় কীভাবে? তার পরও যদি এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়, তাহলে প্রধান নির্বাহী, পরিচালনা পর্ষদ ও সংশ্লিষ্ট সবার ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য হতে হবে।
অতিরিক্ত ব্যয়ের বিষয়ে প্রধান নির্বাহীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও কোম্পানির চেয়ারম্যান বা পরিচালনা পর্ষদের কাউকে ডাকা হয়নি দুদকে। অতিরিক্ত ব্যয়ের ক্ষেত্রে তাদের কোনো দায় নেই বলে দাবি চেয়ারম্যান-পরিচালকদের।
বীমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) চেয়ারম্যান শেখ কবীর হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রধান নির্বাহীরা এজেন্ডা তৈরি করেন। পরিচালনা পর্ষদ তাতে অনুমোদন দেয়। একটি প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় দায় এর প্রধান নির্বাহীকেই বহন করতে হয়।
অতিরিক্ত ব্যয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, এখনো ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নীতিমালা তৈরি হয়নি। তাই কোম্পানিগুলো যে ব্যয় দেখিয়েছে, তাকে মোটেও অবৈধ বা অতিরিক্ত বলা যায় না।
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৫৮ সালের ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের বিধি অনুযায়ী চলছে জীবন বীমা কোম্পানিগুলো। স্বাভাবিকভাবে ওই সময়ের সঙ্গে বর্তমান সময়ের মিল না থাকলেও জীবন বীমা কোম্পানিগুলো যে ব্যয় দেখিয়েছে, তা অবাস্তব। তাই এ বিষয়ে কমিশনের পরামর্শ প্রয়োজন।
১৭ জীবন বীমা কোম্পানির বিরুদ্ধে দেড় হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রমাণ পেলেও এ ব্যাপারে সরাসরি আইনগত পদক্ষেপ নিতে পারছে না দুদক। কারণ দুদক আইনে সরকারি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কমিশনের সরাসরি আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা থাকলেও বেসরকারি বীমা কোম্পানিগুলো তাদের (দুদক) তফসিলভুক্ত অপরাধের মধ্যে নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতারণা ও জালিয়াতির অপরাধগুলো দুদকের তফসিলে রাখা হলেও বীমা কোম্পানিকে রাখা হয়নি। বীমা খাতকে দুদকের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার কাজ চলছে। এটি সম্পন্ন হলে বীমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে কমিশন। এ কারণে আইডিআরএর মাধ্যমে অভিযুক্ত বীমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
দুদকের এ ধরনের সুপারিশ এখনো পাননি বলে জানান আইডিআরএর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গকুল চাঁদ দাস। তিনি বলেন, দুদক এখনো আমাদের কিছু জানায়নি। তাছাড়া এটা দুদকের বিষয়ও নয়। বীমা কোম্পানিগুলো যদি অতিরিক্ত ব্যয় করে থাকে, তাহলে আমাদের আইন অনুযায়ী অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।
দুদকে জমা পড়া অভিযোগ অনুযায়ী, পুরনো ১৭টি জীবন বীমা কোম্পানি ২০০৯-১৫ সাল পর্যন্ত ব্যবস্থাপনার নামে অবৈধভাবে অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। কোম্পানিগুলো হলো— পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স, জীবন বীমা করপোরেশন, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ, পদ্মা ইসলামী লাইফ, গোল্ডেন লাইফ, সন্ধানী লাইফ, প্রগতি লাইফ, সানফ্লাওয়ার লাইফ, সানলাইফ, প্রাইম ইসলামী লাইফ, মেঘনা লাইফ, ডেল্টা লাইফ, রূপালী লাইফ, হোমল্যান্ড লাইফ, প্রোগ্রেসিভ লাইফ, বায়রা লাইফ ও ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স।
তবে আইডিআরএর হিসাব অনুযায়ী, জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের পরিমাণ দুদকের হিসাবের চেয়েও বেশি।
আইডিআরএর তথ্য অনুযায়ী, অবৈধ ব্যয়ে উপরের দিকে থাকা সাতটি কোম্পানিই অবৈধভাবে ব্যয় করেছে মোট ১ হাজার ৩৯৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এ তালিকায় সবার উপরে রয়েছে পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের নাম। কোম্পানিটি একাই অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ২৯৩ কোটি টাকা। এছাড়া জীবন বীমা করপোরেশন অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ২৭৬ কোটি, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ২০০ কোটি, পদ্মা ইসলামী লাইফ প্রায় ১৬৬ কোটি, গোল্ডেন লাইফ ১৬৫ কোটি, সন্ধানী লাইফ ১৫৫ কোটি ও প্রগতি লাইফ প্রায় ১৪৭ কোটি টাকা।
অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে সানফ্লাওয়ার লাইফ অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ৯১ কোটি, সানলাইফ ৯০ কোটি, প্রাইম ইসলামী লাইফ ৭৪ কোটি, মেঘনা লাইফ ৬৯ কোটি, ডেল্টা লাইফ ৫৫ কোটি, রূপালী লাইফ ৫০ কোটি, হোমল্যান্ড লাইফ ৪৮ কোটি, প্রোগ্রেসিভ লাইফ প্রায় ৪৩ কোটি, বায়রা লাইফ ৩৮ কোটি ও ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স ২১ কোটি টাকা অবৈধ ব্যয় করেছে।
উল্লেখ্য, ২০১০-এ নতুন বীমা আইন পাস হলেও জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয়-সংক্রান্ত কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এখনো প্রণয়ন করা হয়নি। এ অবস্থায় ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ক্ষেত্রে ১৯৫৮ সালের বিধি মানতে হচ্ছে কোম্পানিগুলোকে। ওই বিধি অনুযায়ী, একটি জীবন বীমা কোম্পানি প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ৯০ শতাংশ ও নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা বাবদ ব্যয় করতে পারে।