English Version
আপডেট : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ১৮:০০

‘আমি তথ্য প্রমাণ ছাড়াই খুনী’

অনলাইন ডেস্ক
‘আমি তথ্য প্রমাণ ছাড়াই খুনী’

 নিউজ ডেস্ক: পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক লেগেই আছে। সম্প্রতি ঘটনাটির তদন্ত নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কয়েকটি সংবাদ মাধ্যম। ওইসব প্রতিবেদনে বাবুল আক্তার নিজেই স্ত্রী হত্যায় জড়িত থাকতে পারে বলে বিভিন্ন তথ্য উঠে আসে। এমনকি মিতু হত্যার পর শ্বশুর-শাশুড়ি বাবুল আক্তারের পক্ষে কথা বলে আসলেও এখন বলছেন ভিন্ন কথা। যা নিয়ে ইতোমধ্যে চাঞ্চল্য শুরু হয়েছে। বিষয়টি যখন সবার মুখে মুখে, ঠিক সে সময়েই মুখ খুললেন বাবুল আক্তার। তিনি ২৭ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে তার স্ত্রী মিতু হত্যা ও তাদের একান্ত পারিবারিক কথাগুলো তুলে ধরেছেন। বিডি২৪লাইভের পাঠকদের জন্য বাবুল আক্তারের দেয়া সেই স্ট্যাটাসটি পুরোপুরি তুলে ধরা হলো-

বাবুল আক্তারের দেয়া সেই স্ট্যাটাস

সবাই বিচারক আর আমি তথ্য প্রমাণ ছাড়াই খুনী।

অনেকের অনেক জানতে চাওয়া আমার কাছে। আমি কথা বলার জন্য মানসিকভাবে কতটা প্রস্তুত তা নিয়ে কারও বিকার নেই। তবে আমার নিরুত্তর থাকার সুযোগটুকু কাজে লাগিয়ে মনের মত কাহিনী ফাঁদতে ফাঁদতে পরকীয়া থেকে খুন পর্যন্ত গল্প লেখা শেষ করে ফেলেছেন অনেকে। আমার কোন মাথাব্যথা নেই এসব নিয়ে, আমি আমার মা হারা সন্তানদুটোকে নিয়েই ব্যস্ত এখন। তাছাড়া প্রমাণের দায়িত্ব যারা অভিযোগ করেন তাদের। তবে আমার পরিবার পরিজন এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের কথা ভেবে কিছু কথা না বললেই নয়।

শেষ থেকেই শুরু করি। ঐ শেষটা, যেখান থেকে আমার আর আমার সন্তানদের সব গ্লানির শুরু।

বাচ্চা দুটো হয়েছে তাদের মায়ের মত। ছিমছাম সাজানো ঘর ছেড়ে ঢাকায় বাবার বাড়ি বেড়াতে আসলে মিতু চট্টগ্রামে নিজের বাসায় ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠতো। ছেলেমেয়ে দুটোও কিছুদিনের মধ্যেই নানার বাড়ি ছাড়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। কিন্তু সন্তান আমার হলেও তাদের উপর নানা-নানীর অধিকারটুকু আমি বিলীন করতে চাইনি। ভেসে যাওয়ার দিনগুলোতে তারা (আমার শ্বশুরপক্ষ) আমায় আর আমি তাদের আকড়ে ছিলাম। তাই ছেলেমেয়ে নিয়ে দূরে সরে গিয়ে আমি অকৃতজ্ঞ হতে চাইনি। যত কষ্ট আর অস্বস্তিই হোক বাচ্চাদের নানা-নানীর কথা ভেবে আমি তাদের ঘরেই ছিলাম, কৃতজ্ঞ ছিলাম।

আমরা বাসায় ক্যাবল লাইন রাখা মোটেও পছন্দ করতাম না শুধুমাত্র ছেলেমেয়ে অরুচিকর অভ্যাস বন্দী হবে বলে। আর মিতু মারা যাওয়ার পর থেকে নানার বাড়িতে তার বাচ্চাদের দিন শুরু হত স্টার জলসা দিয়ে, শেষও হত স্টার জলসা দিয়ে। যে মিতুর দিন শুরু হত নামায দিয়ে তার সন্তানেরা সকাল সাতটায় জেগে টিভিতে সিরিয়াল দেখে দেখে বেলা এগারটায় নাশতা খেতে পেত। আমরা এধরনের খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত ছিলাম না। ছেলে শাকসবজি খেতে পছন্দ করলেও মাসে দুই-একবারের বেশী তা খাওয়া হত না। অন্যের বাড়িতে বাচ্চার ক্ষুদা আর স্বাস্থ্যের তাগাদা দেওয়ার সুযোগ আমার ছিল না। তবুও আমি চুপ ছিলাম, কৃতজ্ঞ ছিলাম।

আমার ছেলেটার চোখের সামনে তার মা খুন হয়েছে। নিয়মিত কাউন্সিলিং করিয়েছি তাকে। কাউন্সিলরের একটাই কথা কোন অবস্থাতেই ছেলের সামনে তার মায়ের মৃত্যু সংক্রান্ত কোন কথা বলা বা তাকে এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করা যাবে না। ছয়টা মাস আমি চব্বিশ ঘণ্টা ছেলেটার পাশে পাশে থাকার চেষ্টা করেছি । খেয়াল রেখেছি যেন সে এসব কথাবার্তার মুখোমুখি না হয়। তবে বাইরে একদম না বের হয়ে তো পারা যেত না। যেদিনই বাইরে যেতাম ফিরলে দেখতাম ছেলে আমার মুষড়ে আছে। বাইরে থেকে ফেরার পর এক মধ্যরাতে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটা আমায় প্রশ্ন করে, "বাবা, কান্না চেপে রাখলে কী বুকে ব্যাথা হয়? আমার বুকে এত ব্যাথা করে কেন?" আমি তাকে বুকে জড়িয়ে শান্ত করে জিজ্ঞেস করলাম, "কী হয়েছে?" সে বলল, "নানা-নানী সারাদিন আম্মুর কথা বলে আমার খুব কান্না আসে। কিন্তু কান্না করতে পারি না, আমার বুকে ব্যাথা করে।" তারপর আমাকে বলল যেন তাকে চট্টগ্রামের বাসার মত সুন্দর বাসায় নিয়ে যাই, দু'মাসের মধ্যেই।

ছেলের নানার বাড়িতে অস্বস্তি হওয়ার অনেক কারণ ছিল। আমার শ্বশুরবাড়িতে যৌথ পরিবার। অর্থাৎ, আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, আমার শ্যালিকা ও তার স্বামী, আমার শ্বাশুড়ির নিজের বোন এবং সেই বোনের স্বামী-সন্তানসহ মোট তিনটি পরিবার আমার শ্বশুরের চার বেডরুমের ঘরটিতেই থাকে। আমার শ্বশুরপক্ষের জামাতারা নিজের শ্বশুর-শ্বাশুড়ি নিয়ে শ্বশুরঘরেই থাকে, এটা তাদের পারিবারিক রীতি (যাতে আমি অভ্যস্ত নই)। মিতু মারা যাওয়ার পর আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে শ্বশুরঘরের একটি রুমে থাকতাম। ঘরটা যেন আরও ঘিঞ্জি হয়ে উঠল। শ্বশুরঘরের লোকজনেরও আরও কষ্টে পড়তে হল। তাছাড়া চারপাশে বস্তিবাসীর চেঁচামেচি আর অশ্লীল কথোপকথন ছেলেকে আরও খিটখিটে করে তুলছিল।

জন্মের পর থেকে যে সন্তানদের আমরা সুবচনে অভ্যস্ত করেছিলাম তারা মায়ের মৃত্যুর পর চারপাশ থেকে গালমন্দ শিখতে শুরু করল। এভাবেই দিন কাটছিল। মাঝে আর বাসা পরিবর্তন নিয়ে ছেলের সাথে কোন কথা হয়নি, ভাবলাম হয়ত সে ভুলে গেছে। কিন্তু হঠাৎ একদিন ছেলে আমাকে টেনে ক্যালেন্ডারের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, "বাবা, আজ তোমার দু'মাসের সময় শেষ।" আমি অবাক হয়ে দেখলাম ছেলে আমার দু'মাস ধরে ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে দিন গুনছিল নানার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার। তারপর আমি ছেলের কাছ থেকে আরও ১৫ দিন সময় চেয়ে নিলাম।

সবদিক বিবেচনা করে আমি শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে জানালাম যে বাচ্চারা এই পরিবেশে অনভ্যস্ত এবং থাকতে চায় না, তাই তাদের নিয়ে সুন্দর পরিবেশে থাকা প্রয়োজন। তারা খুব সুন্দর সমাধান দিলেন। বললেন তাদের ঘরের উপরেই আরও ঘর তৈরী করতে আমি যেন ১০ লক্ষ টাকা দেই এবং সেখানেই থাকি। আমি যে দশ টাকার লোকও নই, একথা বোঝানোর মত সাধ্য আমার ছিল না। আর ঘর ঘিঞ্জি না হওয়ার সমাধান স্বরূপ বললেন যেন আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজন কেউই আমার কাছে না আসে। আমার শ্বশুর বললেন, হয় আমাকে আমার বাবা-মা ছাড়তে হবে, না হয় শ্বশুর-শ্বাশুড়ি ছাড়তে হবে। আমি কী মরে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম? কী জানি! তবে আমি চুপ ছিলাম, কৃতজ্ঞ ছিলাম।

দিন কাটছিল যুগের গতিতে। ছেলেমেয়ে রাত বারটা পর্যন্ত পড়াশোনা করতে শুরু করল। আমি ভীত হয়ে উঠলাম। কারণ শিশু বয়সে পড়াশুনার চাপ নেওয়াটা আমি মানসিক বিকাশের অন্তরায় হিসেবেই দেখি। তাছাড়া মা হারিয়ে আমার সন্তানেরা এমনিতেই তীব্র মানসিক চাপের মাঝে ছিল। আমি একদিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম এত রাত পর্যন্ত তারা কী পড়াশুনা করে। তখন ছেলে বলল নানী বলেছে তাকে বনশ্রী আইডিয়াল স্কুলে চান্স পেতেই হবে এবং তাই 'ছোটআম্মু' তাদের মধ্যরাত পর্যন্ত পড়ায়। ভাবলাম মিতুর ছোটবোন শায়লার কথা বলছে। কিন্তু পরে আবিষ্কার করলাম মিতুর সদ্য এসএসসি পাশ করা ১৬ বছর বয়সী খালাতো বোনকে (যে তার পরিবারসহ মিতুর বাবার বাড়িতেই থাকে) আমার ছেলেমেয়েকে 'আম্মু' ডাকা শেখানো হয়েছে এবং আমাদের সবকিছুর তদারকিও সেই বাচ্চা মেয়েটিকে দিয়ে করানো হয়।

একদিন ছেলের স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে মায়ের ভূমিকায় পাশে এসে বসে মেয়েটি। বিভিন্ন সময়ে তাকে এগিয়ে দেওয়া হত বাচ্চাদের মায়ের ভূমিকায়। রাতে ফিরে দেখতাম ছেলেমেয়ে নিয়ে সে আমার ঘরেই আছে। আমার স্ত্রী মারা যাওয়ায় আমি এতটা বিকারগ্রস্ত হইনি যে, একটা ইন্টার পড়ুয়া ১৬ বছরের বাচ্চামেয়েকে বিয়ে করে আমার বাচ্চাদের 'মা' বানাতে হবে। তাদের একটাই কথা, শ্বশুরের বাড়িতেই নতুন ঘর বাঁধতে হবে এবং সেখানেই থাকতে হবে। আমার ঐসময়কার অনুভূতি কোন শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে দিনদিন এসব আচরণ এতটাই বিধতে লাগল যে, আমি আমার দ্বিমত প্রকাশের জন্য কোন শব্দ না খুঁজে বরং একটা চাকরি ও বাসা খুঁজে নিলাম। আমার শ্বশুর পক্ষকে জানিয়েই বাসা নিয়েছি এবং এতে তারা ভীষণ মনঃক্ষুণ্ণও হয়েছিলেন। বলেছিলেন এর পরিণাম হবে খারাপ এবং আমাকে পচিয়ে ছাড়বেন তারা। তবে প্রস্থানে আমি চুপই ছিলাম, কৃতজ্ঞ ছিলাম।