ল্যাবএইডের গাফিলতিতে এবার ডা. শাম্মীর মৃত্যু, মৃত শরীরে নানা পরীক্ষা নিরিক্ষা!

আমার দেশের সোনার ছেলেরা আছে না?’ এমন চটকদার টিভি বিজ্ঞাপন দিয়ে যে ল্যাবএইড চিকিৎসা ব্যবসায় দু’হাতে মুনাফা লুটছে, বাড়িয়েছে ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য; সেখানে রোগীদের জীবনের নিরাপত্তা কমে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের অধ্যাপক মৃদুল কান্তি চক্রবর্তীর চিকিৎসা অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করলে যে ল্যাবএইড ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল সেখানে এবার তাদের অব্যবস্থাপনা ও গাফিলতির কারণে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নাঈমুল হক শাম্মীর করুণ মৃত্যু নিয়ে বির্তকের ঝড় উঠেছে। তার মৃত্যুর জন্য ল্যাবএইড যে বক্তব্য দিচ্ছে, শাম্মীর বন্ধু-বান্ধব ও চিকিৎসকরা তা গ্রহণ করছেন না। উল্টো তাদের অভিযোগ ল্যাবএইডের বিরুদ্ধে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকেও এসেছে নানা কথাবার্তা। এ বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে এমন সব তথ্য উঠে এসেছে যা বিস্ময়কর।
একজন ডাক্তারের কপালে যদি ঘটে এমন পরিণতি, তাহলে সাধারণ রোগীদের কী অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১২ ডিসেম্বর সকাল ১১টার দিকে হার্টের নরমাল চেক হিসেবে ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে এনজিওগ্রাম করাতে ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে যান ডা. নাঈমুল হক শাম্মী। এমনকি হাসপাতালে বসে নিজের ফেসবুকে ১১টা ২২ মিনিটে একটি ছবি আপলোড করেন। এরপর এনজিওগ্রাম চলাকালীন সময়েই তার মৃত্যু হয়।
পেশায় ডাক্তার হয়েও এনজিওগ্রাম করার পুরো সময়টা সেখানে থাকতে পারেননি এক প্রত্যক্ষদর্শী। ল্যাবএইডের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. ওয়াদুদ তাকে সেখান থেকে বের করে দেন। যে রুমের মধ্যে ডা. শাম্মীর এনজিওগ্রাম করা হয়েছিল সেখানে জরুরি প্রয়োজনে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা ছিল না। রোগীর প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাকে সময়মতো অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়নি।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ৮-১০ মিনিট চিৎকার করলে অফ ডিউটিতে থাকা অন্য এক চিকিৎসক সেখানে প্রবেশ করেন। প্রতক্ষ্যদর্শী ডা. রোকসানা আক্তার নিজের ফেসবুকে এ বিষয়ে জানিয়েছেন, অফ ডিউটির ডাক্তার প্রবেশ করার আগেই মৃত্যু হয় নাঈমুল হক শাম্মীর। এরপর নিজেদের বাঁচাতে মৃত লোককে নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নীরিক্ষা শুরু করে। যা কোনভাবেই কাম্য নয়। তিনি আরো বলেন, সময় মতো অক্সিজেন সরবরাহ করা হলে এবং একজন এন্যাস্থেটিস্ট সেখানে উপস্থিত থাকলে মৃত্যুঝুঁকি কমে আসতো।
ডা. নাঈমুল হক শাম্মীর মৃত্যুর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরণের বক্তব্য তুলে ধরছে ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ। হার্টে ৩টি ব্লক ধরা পড়েছে এমন কথা এনজিওগ্রামের সময় রোগীকে জানানো হলে তার প্রেসার বেড়ে যায় এবং ফুসফুসে পানি জমতে শুরু করে। ফলে তিনি মারা যান।
কিন্তু দেশে এবং বিদেশে অবস্থানরত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। এছাড়া কোনো রোগীকে এনজিওগ্রাম করার সময় তার হার্টে কয়টা ব্লক ধরা পড়েছে সেটা বলার কোনো নিয়ম নেই। এতে করে রোগীর মানসিক শক্তি কমে যায়। এটা চিকিৎসা বিজ্ঞানের নৈতিকতার পরিপন্থী।
সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে কার্ডিয়াক সার্জন বিগ্রেডিয়ার মুসা খান, যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসক নজরুল ইসলাম, অস্ট্রেলিয়া থেকে ফেরদৌস আলম এবং দেশের বিখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ আবদুল্লাহ জামিলও একই মত দিয়েছেন। তারা বলেছেন, এনজিওগ্রাম করতে এসে মারা যাওয়ার ঘটনা খুবই দুর্লভ। ১০ হাজারের মধ্যে একজনের মৃত্যু হতে পারে, সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে ডা. শাম্মীর মৃত্যুঝুঁকি কমে আসতো বলেও মনে করেন তারা।ল্যাবএইডের গাফিলতিতে এবার ডা. শাম্মীর মৃত্যু
এদিকে, ডা. শাম্মীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ফেনী বিএমএ’র সভাপতি ডা. শাহীদুল ইসলাম কাওসার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের অবস্থান কারো বিরুদ্ধে নয়। আমরা প্রকৃত সত্যটা জানতে চাই। সেদিন এনজিওগ্রাম করার সময় কী ঘটেছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সত্যটা জানালে আমরা খুশি হবো। না হলে নিজেরা তদন্ত করে প্রকৃত সত্যটা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরবো।
নিহত শাম্মীর আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ন্যাশনাল ইন্সিটিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হসপিটালের সহযোগী অধ্যাপক নিউরো সার্জন নোমান খালেদ চৌধুরী বলেন, বন্ধু শাম্মী আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, তাকে আর ফিরে পাবো না। তবে আমরা প্রকৃত সত্যটা জানতে চাই। এনজিওগ্রামের সময় কী ঘটেছিল, তাকে বাঁচানোর জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা জানতে চাই। এছাড়া এ ধরণের দুর্ঘটনা রোধে আমাদের কী করণীয় তাও শেখা যাবে। এখানে দোষারোপের ব্যাপার নয়; এটা আমাদের স্বাস্থ্যখাতের মান উন্নয়নের জন্যই প্রয়োজন।
এ বিষয়ে ডা: আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তার মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে। এমনকি ঘটনার পর থেকেই তিনি ল্যাবএইড হাসপাতালে আর আসছেন না। এদিকে, ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান ইমন বলেন, এ বিষয়ে আমি এখনই কিছু বলতে পারবো না। আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে আপনাকে ফোন করবো।উৎসঃ পূর্বপশ্চিম