সমকামী ও হিজড়াদের রক্ষায় রক্ষণশীলতাকে ভয় পেতেন জুলহাজ

রাজধানীর কালাবাগানের লেকসার্কস রোডের নিজ বাসায় দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত মার্কিন দূতাবাসের সাবেক কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশে সমকামী এবং হিজড়া সম্প্রদায় সম্পর্কিত প্রথম ম্যাগাজিন “রূপবান” এর সম্পাদক জুলহাজ মান্নান সমকামীদের অধিকার রক্ষার পথে রক্ষণশীল সমাজকে প্রধান বাধা বলে মনে করতেন।
২০১৫ সালের ১৮ই জানুয়ারি বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে জুলহাজ বলেছিলেন, এদেশের রক্ষণশীল সমাজে সমপ্রেম নিয়ে পত্রিকা বের করতে গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে তাদের বেশ কৌশলী হতে হয়েছিল। বিষয়টি তাদের জন্য একটি বাড়তি চাপ হিসেবে কাজ করছিল মন্তব্য করে জুলহাজ আরও বলেছিলেন, এধরণের পত্রিকা প্রকাশে সমস্যায় পড়তে হয় তাদের।
সাক্ষাতকারে তিনি আরো বলে ছিলেন, ‘রূপবান’ সমকাম নয় বরং সমপ্রেমে বিশ্বাসী মানুষের ভালবাসার অধিকারের বিষয়টি তুল ধরতে চায়। সমপ্রেমে বিশ্বাস করে এমন মানুষদের জীবনধারা, ভালোলাগা ও দুঃখ কষ্টের বিষয়টি তুলে ধরে রূপবান।
ওই সাক্ষাতকারে জুলহাজ মান্নান বলেছিলেন, “বাংলাদেশে সমকামীরা অদৃশ্য জীবনযাপন করে, কিন্তু আমরা জানাতে চাই যে এই সমাজেই আমরা আছি এবং আমরা আপনাদের পরিবারেই সদস্য।”
বাংলাদেশে সমকামী এবং হিজড়া সম্প্রদায় সম্পর্কিত প্রথম ম্যাগাজিন রূপবানের এক বছর পূর্তিতে বিবিসি বাংলাকে ওই সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন জুলহাজ মান্নান।
বিগত ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো রূপবান পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এর পরপরই বিভিন্ন শ্রেনীপেশার ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ব্যাপক সমালোচনার মুখে যখন রুপবান প্রকাশ করা নিয়ে খানিকটা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা তখন জুলহাজ ভয় না পেয়ে সামনে এগিয়ে যাবার উৎসাহ দিয়েছিলেন। ওই বছরের (২০১৪) ২৬ শে ফেব্রুয়ারি রুপবানের প্রথম প্রকাশ উপলক্ষ্যে জুলহাজ মান্নানের এক স্বাগত বিবৃতির খানিকটা হুবহু তুলে ধরছি:
“রূপবান নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বিষয়বস্তু নিয়ে সমালোচনা একপেশে লেগেছে। উল্লেখিত লেখাগুলো ছাড়াও আরো অনেক রকম লেখা ছাপা হয়েছে যা প্রেম, সম্পর্ক, সাহিত্য, জীবনাচার, আইন, স্বাস্থ্যবিষয়ক। সেসব নিয়ে মতামত জানা গেলনা।
বিষয়বস্তু নির্বাচনে ম্যাগাজিনের গ্রহনযোগ্যতা, জনপ্রিয়তা ও বিপনন ছাড়াও বাংলাদেশী রূপবানদের ফেরেস্তা নয় বরং মানুষ হিসাবে উপস্থাপনের বিষয়টি গন্য করা হয়েছে। প্রেম, সম্পর্ক, স্বাস্থ্য বা ফ্যাশনের মত “ফেটিশ”, রমনা পার্ক, পুল-পার্টি, এই সবই তাদের (বা তাদের অনেকের) বাস্তবতা; যা অস্বীকার করা মিথ্যাচারের শামিল।
জানামতে, রূপবানের পরবর্তী সংখ্যার কাজ চলছে; সুতরাং তারা “এখন চুপচাপ” বা “অস্তিত্ব প্রকাশের পর “ঠিক হয় নাই” চিন্তা করে পিছনে সরে যাওয়ার” মত কিছু হয় নাই। তবে প্রকাশকদের অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয়েছে, তাই অনেক ভুল-ত্রুটি রয়ে গেছে যা অবশ্য পরিত্যয্য। আত্মহত্যা নয় সামনে ভালো করবে রূপবান এই আশা করি ।”
দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত জুলহাজ সমকামী ও হিজড়াদের অধিকার নিয়ে কাজ করেছেন। ব্যক্তি জীবনে কবিতার প্রতি বেশ দুর্বলতা ছিল তার। ফেসবুকে তিনি প্রায় কবিতা লিখতেন।
উল্লেখ্য, সোমবার (২৫ এপ্রিল) সন্ধ্যা ৬টার দিকে রাজধানীর ৩৫ উত্তর ধানমন্ডির একটি বাসায় ৫ দুর্বৃত্ত ঢুকে দু'জনকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীসহ আরও দু'জন আহত হয়েছেন। নিহতদের একজন জুলহাজ মান্নান এবং অপরজন তার বন্ধু মাহবুব তন্ময়।
এদের মধ্যে জুলহাজ মান্নান বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মোজিনার প্রটোকল কর্মকর্তা ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের আগে সমকামীদের অধিকার নিয়ে পত্রিকা 'রূপবান' সম্পাদনার পাশাপাশি তিনি উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডিতে কাজ করতেন। জুলহাজ আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির খালাতো ভাই ছিলেন।
এদিকে জুলহাজ মান্নানের নিহতের খবরটি বিশ্ব বিভিন্ন গণমাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জুলহাজের মৃত্যর খবর প্রকাশের সাথে সাথে বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছর ধরে একের পর ব্লগার খুনের ঘটনাকে উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করা হয়।