মাদকবাহী ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হলেন দুই পুলিশ কর্মকর্তা
.jpg)
পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটল দুই সাহসী পুলিশ কর্মকর্তার। মাদকবাহী ট্রাককে মোটরসাইকেল নিয়ে ধাওয়া করে আটকানোর চেষ্টাকারী চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক সাদেকুল ইসলাম ও শিক্ষানবিশ সার্জেন্ট আতাউল ইসলামকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছে ওই ট্রাকের চালক। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর সোয়া ৫টার দিকে শিবগঞ্জের কানসাট পল্লীবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সামনের সড়কে এ ঘটনা ঘটে।
সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনরত পুলিশ কর্মকর্তা দুজনকে হত্যা করে পালিয়ে যাওয়ার সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই ঘাতক ট্রাকচালক সিরাজুল ইসলামকে ট্রাকসহ আটক করা হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার বশির আহমেদ পিপিএম বার বলেন, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনায় ট্রাকচালকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা ও মাদক চোরাচালানের অপরাধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, সোনামসজিদ স্থলবন্দর থেকে ছেড়ে আসা একটি ট্রাকে মাদকের চালান যাচ্ছে ঢাকায়, এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সাদেকুল ইসলাম ও আতাউল ইসলাম আগে থেকেই কানসাট গোপালনগর মোড়ে অবস্থান নেন। গোপালনগর মোড়ে তাঁরা ট্রাকটিকে (ঢাকা-মেট্রো-ট-১৪-৮৯৪৮) থামার সংকেত দিলে ট্রাকচালক সংকেত অমান্য করে পাশ কাটিয়ে পালিয়ে যায়। সাদেকুল ও আতাউল তখন মোটরসাইকেল নিয়ে দ্রুত ধাওয়া করে ট্রাকটিকে। এক কিলোমিটারের একটু বেশি দূরে এসে ট্রাকের সামনের দিক থেকে গতিরোধের চেষ্টা করেন তারা। এ সময় ট্রাকচালক চলন্ত ট্রাক দিয়ে ধাক্কা দেয় সাদেকুল ও আতাউলের মোটরসাইকেলটিকে। ধাক্কা খেয়ে তারা ছিটকে পড়লে ট্রাকের চাকা চলে যায় সাদেকুল ও আতাউলের পায়ের ওপর দিয়ে। ঘটনাস্থলেই তারা মারা যান।খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে।পরে ময়নাতদন্তের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে লাশ পাঠানো হয়।
ওদিকে, মাদকবাহী ট্রাকের চাপায় দুই পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যু সংবাদ থানায় এসে পৌঁছলে থানাজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। খবর পেয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আল মামুন দ্রুত এসে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। সহকর্মীরা জানান, ট্রাকের চাকায় প্রাণ হারানো শিক্ষানবিশ পুলিশ সার্জেন্ট আতাউল ইসলাম মাত্র ১৫ দিন আগে শিবগঞ্জ থানায় যোগ দিয়েছিলেন। জয়পুরহাটের সতিঘাটা গ্রামের শাহজাহান আলীর ছেলে আতাউল শিবগঞ্জ ডাকবাংলোর একটি ঘরে বসবাস করতেন। কর্মজীবনের শুরুতেই সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এভাবে তার জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ায় সহকর্মীরা শোকে মুষড়ে পড়েন। তারা বলেন, খুব হাসিখুশি ও বিনয়ী ছিলেন দুজনই।
দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে পিশে মারার পর চালক ট্রাক নিয়ে পালিয়ে গেলে পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সব ধরনের বহির্গমন পথে অস্থায়ী চৌকি বসায়। অবশেষে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ভোলাহাট সড়কের কাশিয়াবাড়ী এলকায় ধরা পড়ে ঘাতক ট্রাকচালক সিরাজুল ইসলাম (৩৮)। সে ঝালকাঠি জেলার নলছিটির অনুরাগ গ্রামের আওয়াল হোসেনের ছেলে।
ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধারের পর শিবগঞ্জ থানা পুলিশ তা ময়নাতদন্তের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। ময়নাতদন্তের দায়িত্বে নিয়োজিত সদর হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ট্রাকের চাকায় পিষ্ট সার্জেন্ট আতাউল ইসলামের পেটের নিচ থেকে দেহের বাকি অংশ ও এসআই সাদেকুল ইসলামের ডান পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ ছাড়া দুজনেরই পেটের নিচের অংশ সম্পূর্ণ পিষ্ট ছিল। তাঁদের দেহ ট্রাকের সামনের ও পেছনের চাকায় পিষ্ট হওয়ায় এ অবস্থা হয়। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুলিশ লাইনে। সেখানে জানাজা শেষে তাঁদের পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। গতকাল বিকেলেই লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাঁদের গ্রামের বাড়িতে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার বশির আহমেদ পিপিএম বার বলেন, যেহেতু পুলিশ কর্মকর্তা দুজন অনডিউটি নিহত হয়েছেন, তাই পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁদের পারিবারকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে।
নিহত উপপরিদর্শক (এসআই) সাদেকুল ইসলাম মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তারের ছেলে। তাঁর জন্ম ১৯৮০ সালে। তিনি ২০০৩ সালে উপপরিদর্শক (এসআই) পদে (বিপি নং-৮০০০০২১৯৪৭) পুলিশ বিভাগে যোগদান করেন। মা-বাবার একমাত্র ছেলে সাদেকুল ইসলাম নওগাঁর মান্দা থেকে ১১ মাস আগে শিবগঞ্জ থানায় যোগদান করেন। তিনি দুই কন্যা সন্তানের জনক। বড় মেয়ে সাদিয়ার বয়স সাত ও ছোট মেয়ে সামিনার এক বছর।
শিক্ষানবিশ শেষ হলো না সার্জেন্ট আতাউলের। নিহত সার্জেন্ট আতাউল ইসলাম এক বছর সারদার ট্রেনিং ও ১০ দিন ছুটি শেষে মাত্র এক সপ্তাহ আগে শিবগঞ্জ থানায় যোগদান করেন শিক্ষানবিশ সার্জেন্ট হিসেবে। একমাত্র ছেলের মৃত্যুর খবরে মা মাছুদা বেগম চিৎকার করে কান্নার পাশাপাশি প্রলাপ বকছেন। ঢাকার মিরপুর থেকে ছুটে আসা বড় বোন শাহনাজ পারভিন কেঁদে কেঁদে বলছেন, দুই দিন আগেও আতাউল তাঁকে ফোন করে বলে, ‘আপু, তুই ভালো থাকিস, নিজের প্রতি যত্ন রাখিস, আমার জন্য চিন্তা করিস না, আমি থানার মধ্যে নিরাপদে আছি।’শোকে মুষড়ে পড়েছে আতাউলের বাড়ি জয়পুরহাট সদর উপজেলার সতিঘাটা গ্রাম।