English Version
আপডেট : ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ১৪:১৭

লন্ডনে আদম পাচারের অভিযোগ আনল ব্রিটিশ সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক
লন্ডনে আদম পাচারের অভিযোগ আনল ব্রিটিশ সরকার

এবার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে লন্ডনে আদম পাচারের অভিযোগ আনল ব্রিটিশ সরকার। অভিযোগে বলা হয়েছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন, বিমানের পাসপোর্ট কন্ট্রোল ইউনিট (পিসিইউ) ও বিভিন্ন দেশী-বিদেশী এয়ারলাইন্স ও কতিপয় ট্রাভেল এজেন্সির নেতৃত্বে গড়া একটি সিন্ডিকেট এ আদম পাচারের সঙ্গে জড়িত। ভুয়া ও জাল ভিসায় লন্ডনে প্রবেশের সময় গত এক মাসে ১৩ জনকে চিহ্নিত করে তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে হিথ্রো ইমিগ্রেশন পুলিশ। গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এক মাসে এই ১৩ ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছে ব্রিটিশ সরকার। মঙ্গলবার ব্রিটিশ হাইকমিশনের দুই ইমিগ্রেশন বিশেষজ্ঞ সরেজমিন বিমানের প্রধান কার্যালয় বলাকা পরিদর্শনে যান। এ সময় তারা বিমান পরিচালনা পর্যদের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিন ও বিমানের সিইও ব্রিটিশ নাগরিক কাইল হেউডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তারা বিমানসহ বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে জাল ভিসা ও পাসপোর্টে লন্ডনে আদাম পাচারের এই ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন। তারা অভিযোগ করে বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে বিমানের পিসিইউ ও শাহজালালের ইমিগ্রেশন পুলিশের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। শুধু এই দুটি বিভাগই নয়, এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার দুর্নীতিবাজ সদস্য, বিমানের কতিপয় সিবিএ নেতা, শাহজালালের স্ক্যানিং মেশিন অপারেটর, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) নিরাপত্তা গার্ড, ট্রলিম্যান, ম্যান-পাওয়ার ডেস্কের কতিপয় কর্মী, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের নিুস্তরের কতিপয় কর্মী ও বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মালিক-কর্মচারীরা। তারা বিমানের চেয়ারম্যান ও এমডির কাছে এসব অভিযোগ উত্থাপন করেন এবং দ্রুত তদন্ত দাবি করেন। একই সঙ্গে বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা জোরদারেরও তাগিদ দেন। এ সময় তারা আবারও বিমানের জনবলের ঘাটতি ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বিমানের এমডি কাইল হেউড ব্রিটিশ হাইকমিশনের দুই ইমিগ্রেশন বিশেষজ্ঞ দলের বিমান পরিদর্শনের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, সম্প্রতি জাল-জালিয়াতি ও ভুয়া ভিসা, পাসপোর্টে বাংলাদেশ থেকে অস্বাভাবিক হারে লন্ডনে আদম পাচার হচ্ছে। ব্রিটিশ ইমিগ্রেশন দলের সঙ্গে বিমানের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শাহজালালের ইমিগ্রেশন পুলিশ জড়িত বলে তাকে জানানো হয়েছে। কাইল এ ঘটনায় একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হচ্ছে বলে যুগান্তরকে জানান। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এ ধরনের আদম পাচার বাণিজ্য হরহামেশাই ঘটছে। আশংকাজনক হারে বেড়েছে গলাকাটা পাসপোর্টে (পিসি বাণিজ্য) আদম পাচার। জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে এই পাচারের সবচেয়ে বড় রুট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও ভারতীয় নাগরিকরা ও শাহজালালকে নিরাপদ রুট মনে করে এই পথে পিসি বাণিজ্য করছে। জানা গেছে, এ খাত থেকে প্রতি মাসে সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটের আয় গড়ে ২০ থেকে ৫০ কোটি টাকার বেশি। বিমানবন্দরে কর্মরত একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, ট্রাভেল এজেন্টরা পাচারের জন্য মানুষের জোগান দেয়। আর পাসপোর্ট জোগান দেয় বিমানবন্দরকেন্দ্রিক একটি ছিনতাইকারী চক্র। তারা প্রবাসী যাত্রীদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ছিনতাই করে ফকিরাপুলে নিয়ে যায়। সেখানে ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে অ্যাসিড দিয়ে ছিনতাই করা পাসপোর্ট থেকে ছবি তুলে ফেলা হয়। এরপর সেখানে পাচার করা মানুষের ছবি সংযুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ বিমানসহ দেশী-বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলো এদের বোর্ডিং কার্ড ইস্যু করে। এরপর সিভিল এভিয়েশন ও ইমিগ্রেশন পুলিশের কিছু দুর্নীতিবাজ সদস্য পাচারকৃতদের বিমানবন্দর থেকে উড়োজাহাজে তোলার বন্দোবস্ত করে। জানা গেছে, প্রতি পিসি থেকে গড়ে দুই-পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে এই টাকা ভাগ-বাটোয়ারা হয় টপ টু বটম। জানা গেছে, পাচার হওয়া এসব আদম বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিদেশে গিয়ে বৈধভাবে কোনো কাজ করতে পারে না। তারা গ্রেফতার হয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের কারাগারে মানবেতর জীবনযাপন শেষে সর্বস্বান্ত হয়ে কিছুদিন পর দেশে ফিরে আসে। বেশ কিছুদিন আগে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বিমানবন্দরকেন্দ্রিক এ চক্রের ৫০ সদস্যের একটি তালিকা তৈরি করেছিল। এদের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক একটি এয়ারলাইন্সের কাস্টমার সার্ভিস এজেন্ট ছোট মিজান, সিভিল এভিয়েশনের কর্মচারী জাহাঙ্গীর হোসেন মিয়া (২১ নারী ও শিশু পাচার মামলার আসামি), পিসি সম্রাট গার্ড ইকবাল (ডি শিফট), মনিরুজ্জামান (বরিশাল), জিন্না (সিরাজগঞ্জ), মহসিন তালুকদার, হাকিম, হামিদ, বেলায়েত হোসেন, সেলিম, নিরাপত্তা অপারেটর শহীদুল ইসলাম শাহীন, ইএম হেলপার আক্তার, মফিজ ওরফে সাফারি মফিজ, নিরাপত্তা সুপারভাইজার আনোয়ার হোসেন (কুমিল্লা), মঞ্জু, রেজাউল (একজন পরিচালকের পিয়নের ছোট ভাই), ভুট্টু, ফজলু, গার্ড মিলান কান্তি শর, হেভি লাগেজ অপারেটর শামীম, অপারেটর খলিল, গার্ড নজরুল, রবিউল, টিপু, ইসমাইলের দুুই মেয়ের জামাতা শামীম ও সুজন, ম্যানপাওয়ার ডেস্কের হাকিম, মকবুল, আশরাফ, ট্রলি অপারেটর ফারুক, শহিদ, রহিম, সেলিম প্রমুখ। বিমানবন্দরের কর্মীরাই নিরাপত্তার জন্য বড় ঝুঁকি : এর আগেও ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানের নয় বলে জানিয়েছিল একটি ব্রটিশ এভিয়েশন গোয়েন্দা দল। খোদ বিমান চলাচল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকায় বাংলাদেশের প্রধান বিমানবন্দরটির নিরাপত্তা ব্যবস্থাতেই রয়ে গেছে অনেক গলদ। ফলে এই বিমানবন্দরটি থেকে উড়ে যাওয়া কোনো বিমানে যদি বোমা পেতে রাখা হয় এবং অন্য কোনো দেশে গিয়ে সেই বিমান বিস্ফোরিত হয় তাহলে উৎস দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ওপরই এর দায় বর্তাবে। বাংলাদেশ সরকার যদিও বলছে বিমানবন্দরগুলোতে নিরাপত্তার সব ব্যবস্থাই রয়েছে এবং সম্প্রতি তা আরও জোরদার করা হয়েছে, কিন্তু উড়োজাহাজের একজন সাবেক পাইলটের বক্তব্য, বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব যাদের হাতে রয়েছে তারাই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা প্রশ্নে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না। তাদেরকে এটার ওপর শিক্ষা দেয়া বা গ্র“মিং করাটা অত্যাবশ্যক, বলছিলেন বাংলাদেশে উড়োজাহাজের সাবেক পাইলট ক্যাপ্টেন নাসিমুল হক। বিশ্বের যে কোনো আধুনিক বিমানবন্দরে কর্মীদের ভেতরে প্রবেশ বা বের হওয়ার জন্য কম্পিউটারাইজড ইলেকট্রনিক কার্ড পাঞ্চ করতে হয়। এর ফলে তার প্রত্যেকটি ফটক অতিক্রম করার তথ্য কম্পিউটারে লিপিবদ্ধ থেকে যায়। সে কোনো স্পর্শকাতর এলাকায় অকারণে প্রবেশ করছে কিনা বা সন্দেহজনক চলাফেরা করছে কিনা সেটাও এর ফলে জানা যায়। কিন্তু ঢাকার বিমানবন্দরে এ ব্যবস্থা নেই। ক্যাপ্টেন হক বলছেন, যারা এয়ারপোর্টের ভেতরে কাজ করে, তাদের মাধ্যমেই অস্ত্র বা বোমা এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা চৌকি অতিক্রম করার ঝুঁকি বেশি থাকে। ‘এরা যখন খুশি তখন ঢুকছে, যখন খুশি তখন বের হচ্ছে। যদি পুরো এলাকাটা সিল করে দেয়া হয় এবং যে ঢুকবে সে একটা কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকবে, যেখানে কেন্দ্রীয় কম্পিউটারে ওঠে যাবে যে এই লোকটা এতটার সময় ঢুকেছে। তা থেকে বোঝা যাবে, ওর যদি ডিউটি না থাকে এবং ও যদি ভেতরে ঢোকে, তাহলে তাকে ধরতে হবে।’ বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোতে নিরাপত্তা বিধান করার জন্য অনেক আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মুখে পড়তে হয় বলেও উল্লেখ করেন নাসিমুল হক। তিনি বলেন, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিধান করা যাদের দায়িত্ব সেই সিভিল এভিয়েশনকে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি প্রয়োজন হয়। এটা অনেক সময় সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। দ্রুত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার জন্য সিভিল এভিয়েশেনের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা থাকা জরুরি।