পেশাদার সন্ত্রাসীরাও ভয় পায় পুলিশ সোর্সকে

অপরাধীদের সম্বন্ধে নিয়মিত তথ্যদাতারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশ ও র্যাবের র কাছে 'সোর্স' হিসেবে পরিচিত। নাম-পরিচয় গোপন রেখে সম্ভাব্য ও সংঘটিত অপরাধ এবং অপরাধীদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে তারা। পরে তা পুলিশ বা র্যাবকে সরবরাহ করে। নিরাপত্তার কারণে তাদের পরিচয় গোপন রাখা হয়। এ জন্য তাদের নিয়মিত আর্থিক সহায়তা (সোর্স মানি) দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে এলাকার দাগি, সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীরাও নিজেদের স্বার্থে থানায় সোর্স হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে নানা অপকর্ম করছে। ধরা পড়ার ভয়ে খোদ পেশাদার সন্ত্রাসীরাও এসব সোর্সকে ভয় পায়। সন্ত্রাসী ও পুলিশের সঙ্গে সখ্যের কারণে সাধারণ মানুষ তাদের নিয়ে থাকেন আতঙ্কে। তথ্য পাওয়ার জন্য পুলিশ যেমন তাদের খাতির করে, তেমনি অসাধু পুলিশ সদস্যদের কাছে এ সোর্সরাই 'সোনার ডিমপাড়া হাঁস'। তাদের মাধ্যমেই নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে কথিত 'আটক বাণিজ্যে'র নামে হাতিয়ে নেওয়া হয় অর্থ।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আর সন্ত্রাসীদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ইদানীং রাজধানীর বিভিন্ন থানায় বেপরোয়া এবং ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে সোর্স নামধারী এসব সন্ত্রাসী। বুধবার রাতে রাজধানীর শাহআলীতে এক চায়ের দোকানি বাবুলের কাছে টাকা চেয়ে না পেয়ে তার ওপর চড়াও হয় পুলিশ। চুলা থেকে শরীরে আগুন লেগে ক্ষুদ্র চা বিক্রেতা বাবুল বৃহস্পতিবার মারা যান। ওই ঘটনার নেপথ্যে জড়িত রয়েছে পুলিশের সোর্স দেলোয়ার আর আইয়ুবের নাম।
গত ১৭ জানুয়ারি কাফরুল এলাকায় সাবেক এক সিনিয়র সহকারী সচিবের ছেলেকে তল্লাশির নামে পকেটে ইয়াবা বড়ি ঢুকিয়ে দেয় এক সোর্স। পরে পুলিশ তাকে ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে আটক করে চাঁদা দাবি করে। পরে তাকে মুচলেকায় ছেড়ে দেওয়া হয়। ২৪ জানুয়ারি উত্তরায় পুলিশের কথিত সোর্সের মাধ্যমে এক তরুণ ব্যবসায়ীকে আটক করে আড়াই লাখ টাকা দাবি করে পুলিশ।
২০১৪ সালে মিরপুর থানা পুলিশ সোর্স খোকন, নাসিম, ফয়সাল ও পলাশের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঝুট ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান সুজনকে গ্রেফতার করে। পরে টাকার জন্য মিরপুর থানার এসআই জাহিদুর রহমান, এএসআই রাজকুমার ও দুই কনস্টেবল মিলে ওই ব্যবসায়ীর ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে তাকে হত্যা করে। ওই ঘটনায় জড়িত এসআই জাহিদুর ও সোর্স নাসিম বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য ও স্থানীয় সূত্রগুলোর মতে, রাজধানীর বিভিন্ন থানার অধীনে কর্মরত ভয়ঙ্কর সোর্সদের মধ্যে রয়েছে_ ধানমণ্ডি ও কলাবাগান এলাকায় মিন্টু, নাজির, ফাতেমা ও লাল চাঁন; গুলশানে নাদিম ও ফর্মা স্বপন; মোহাম্মদপুরে হানিফ, রাসেল ও জয়নাল; ডেমরায় বাবু সেলিম; পল্টন এলাকায় মরিয়ম, শাহাবউদ্দিন, আজমল, খলিল; সবুজবাগে বজলু মিয়া; রমনা এলাকায় হেরোইনচি স্বপন, মালেক, খলিল ও আক্তার। কামরাঙ্গীরচর থানা এলাকায় রয়েছে মাদক মামলার আসামি সিডি মিন্টু, সোহেল, আরিফ, আশরাফ; হাজারীবাগে জসিম, রনি, শাহজাহান ও ওয়াসিম। লালবাগ ও চকবাজার এলাকায় আছে বিল্লাল, আবদুর রব, আলমগীর, বাসেত, আজমল, তৌহিদসহ কয়েকজন। শাহবাগে ফর্মা কাদের; নিউমার্কেট এলাকায় নাদিম ও কাইল্লা বাবু সোর্স হিসেবে এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পল্লবী এলাকায় ডাকাতি মামলার আসামি সাইফুল সোর্স হিসেবে কাজ করে থাকে। দেলোয়ার, তারেক, রাজু ও রহমান সোর্সের পরিচয় দিয়ে পুরো এলাকায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। মিরপুর ও কাফরুল এলাকায় সোর্সদের তালিকায় বাবু, সুমন, মোশারফ, শাহীন, খ্রিস্টান বাবুু, তামান্না তামু রাজু ও আলমগীর অন্যতম।
পুরান ঢাকা সূত্রাপুর ও কোতোয়ালি এলাকায় জামান, লিটন, শম্ভু, মনোয়ারা, সেলিম, ইয়াবা ঝিলু, ফেনসি রমজান, কানাই, সামসু, জাহাঙ্গীর, শাকিল, সুজন, মাসুদ, সাবি্বর, বাবলু, শফিক ও মুজিবর নিয়ন্ত্রণ করে পুরো এলাকা। শ্যামপুর, কদমতলী ও গেন্ডারিয়া এলাকায় সোহাগ, আমির, সোহেল, শিপন, জাহাঙ্গীর, ভাগিনা রবিন, নজরুল, লালু, রহিম, আলী এবং যাত্রাবাড়ীতে শাহে আলম, আলতাফ, মাসুম, সুমন, শাহীন, সালাম ও ফর্মা সিরাজ সোর্স হিসেবে এলাকায় দোর্দণ্ড প্রতাপ রাখে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, কাগজপত্রে থানার কোনো সোর্স থাকার কথা নয়। এর পরও বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ পেয়ে গত বছর ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয় থেকে প্রত্যেক থানায় চিঠি দিয়ে সোর্স নামধারী এসব অপরাধীর ব্যাপারে ওসিদের সতর্ক হতে বলা হয়েছে।