English Version
আপডেট : ৯ আগস্ট, ২০১৯ ০৬:২৫
সূত্র:

কোরবানিতে চাহিদার অতিরিক্ত গরুর সরবরাহ : প্রত্যাশিত দাম না পাওয়ার শঙ্কায় খামারিরা

কোরবানিতে চাহিদার অতিরিক্ত গরুর সরবরাহ : প্রত্যাশিত দাম না পাওয়ার শঙ্কায় খামারিরা

ঈদ ঘনিয়ে এলেও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কোরবানির পশুর হাটগুলোয় বেচাবিক্রি এখনো তেমন জমে ওঠেনি। গতকালও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের হাটে ক্রেতা সমাগম ছিল কম। এছাড়া এবার চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি হওয়ায় পশুর ভালো দাম পাওয়া নিয়েও আশঙ্কায় রয়েছেন খামারিরা।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে দেশে কোরবানির পশুর চাহিদা ১ কোটি ১০ লাখ। অন্যদিকে এজন্য পশু প্রস্তুত রয়েছে প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ।

প্রসঙ্গত, দেশে কোরবানির জন্য প্রস্তুত পশুর সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। গত বছর দেশে কোরবানিযোগ্য পশু ছিল প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ, যার একাংশ অবিক্রীত থেকে যায়। অন্যদিকে ২০১৭ সালে দেশে কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল প্রায় ৬২ লাখ।

রাজধানীর কোরবানির পশুর হাটগুলোয় গতকাল ঘুরে দেখা গেছে, এসব হাটে পশুর বেচাবিক্রি কম। ঈদের আগে সর্বশেষ কর্মদিবসে হাট কিছুটা জমে ওঠার কথা থাকলেও দিনভর বৃষ্টির কারণে সেখানে ক্রেতার সংখ্যা ছিল খুবই কম। যারা এসেছেন, তাদেরও কেনার প্রতি তেমন একটা আগ্রহ দেখা যায়নি।

তবে বেপারিদের প্রত্যাশা, আজ থেকে পুরোদমে বিক্রি শুরু হবে। তবে হাটগুলোয় পশুর সরবরাহ অব্যাহত থাকায় কতটা ভালো দাম তুলতে পারবেন, সে বিষয় নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন তারা।

অন্যদিকে ক্রেতারা বলছেন, বেপারিরা এবার আগেরবারের তুলনায় বেশি দাম হাঁকছেন। তবে রাজধানীর বাইরে থেকে আরো সরবরাহকৃত পশু বাজারে প্রবেশ করলে দাম কমে যাবে বলে মনে করছেন তারা। রাজধানীর তেজগাঁও হাটে গতকাল গরু কিনতে এসেছিলেন মো. সোহান নামে এক ক্রেতা। তিনি বলেন, এবার বাজারে গরুর দাম বেশি মনে হচ্ছে। তবে বাজারে এখনো গরু আসছে। কালকের পর দাম আরো কমতে পারে।

এছাড়া ক্রেতাদের অনেকের মধ্যেই এখন হাটের বদলে গবাদি পশুর বড় খামারগুলো থেকে সরাসরি গরু কেনার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। হাটে বেচাবিক্রি না জমলেও খামারগুলোয় কোরবানিতে বিক্রির জন্য রাখা গরুর অধিকাংশই বিক্রি হয়ে গেছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পশ্চিম পাশে বেশ কয়েকটি গরুর খামার গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে সাদিক এগ্রো নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পাঁচটি খামার রয়েছে। এ খামারগুলোয় প্রায় দুই হাজার গরু রয়েছে বলে জানান ম্যানেজার নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, গতবার আমাদের খামারে কোরবানিযোগ্য পশু ছিল ১ হাজার ২০০। এবার তা বেড়ে হয়েছে দুই হাজার। এরই মধ্যে আমরা প্রায় ৭০ শতাংশ গরু বিক্রি করে দিয়েছি। ঈদ পর্যন্ত বিক্রি চলবে।

একই অবস্থা পার্শ্ববর্তী বেঙ্গল ফার্ম হাউজেরও। গত বছর প্রতিষ্ঠানটির খামারে কোরবানিযোগ্য গরু ছিল ১৩৮টি। এবার তা বেড়ে হয়েছে ৪২৮টি। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার কাজী মইনুল ইসলাম জানান, গতকালের মধ্যেই ফার্ম হাউজের প্রায় ৯৫ শতাংশ গরু বিক্রি হয়ে গেছে। ৪২৮টি গরুর মধ্যে ২০-২৫টি বাদে অন্য সব গরু বিক্রি হয়ে গেছে।

মেঘডুবি এগ্রো নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক মাহমুদ বলেন, এবার কোরবানির জন্য আমাদের ১ হাজার ৪০০ গরু প্রস্তুত করা হয়। এর মধ্যে এক হাজারেরও বেশি বিক্রি হয়ে গেছে। এর আগে গত কোরবানির ঈদেও ৮০০-র বেশি গরু বিক্রি করেছিল প্রতিষ্ঠানটি।

হাটে বেচাবিক্রি না জমলেও খামারগুলো থেকে পশু বিক্রির এ রমরমা অবস্থার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বৃষ্টি, গরম ও ডেঙ্গুর মধ্যে মানুষ এখন হাটে গিয়ে গরু কিনতে চায় না। ফার্মের মধ্যে ক্রেতারা সুন্দর পরিবেশ পায়, সুস্থ গরু পায়। এর কারণে তারা এখান থেকে গরু কিনে স্বস্তি পায়। আগামীতে এ চাহিদা আরো বাড়বে।

প্রায় একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি শোনা গেল সাইফুর রহমান ইমন নামে বেঙ্গল ফার্ম হাউজের এক ক্রেতার মুখে। তিনি বলেন, অনেকেই মনে করেন হাটে গরু কিনলে কম দামে পাওয়া যায়, কিন্তু আমার কাছে বিষয়টি ভুল মনে হয়। খামারের গরু ও বাজারের গরুর মূল্য মোটামুটি একই আছে। এখন তো গরুর বিভিন্ন সমস্যার কথা শুনি। তাই আমি মনে করি, বাজারের তুলনায় খামার থেকে গরু কেনাই ভালো।

দেশে একসময় কোরবানির জন্য ভারতীয় গরুর ওপর নির্ভর করতে হতো। ভারত সরকার গরু রফতানিতে কড়াকড়ি আরোপ করায় গত কয়েক বছরে বাজারে দেশী গরুর চাহিদা বেড়েছে। ফলে অনেকেই গরুর খামার স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবমতে, দেশে বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে পাঁচ লাখেরও বেশি খামার রয়েছে। এ সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। আশা করি ঈদের আগেই বাকিগুলো বিক্রি হয়ে যাবে।

কোরবানির পশুর হাটে বেচাবিক্রিতে মন্দা দেখা যাচ্ছে রাজধানীর বাইরের হাটগুলোতেও। সেখানকার খামারি ও পশুপালকরা ভালো মুনাফা করলেও বিপাকে রয়েছেন হাটের বেপারিরা। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বণিক বার্তার প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—

পাবনা: জেলার বেশ কয়েকটি পশুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে পশুর দাম চড়া হলেও ক্রেতা নেই। বেপারিদের অনেকেই গ্রাম থেকে পশু কিনে জেলার বিভিন্ন হাটে বিক্রির চেষ্টা করছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঢাকামুখী হতে হচ্ছে তাদের। ঢাকার বাজার থেকে শেষ মুহূর্তে ভালো দাম আদায়ের প্রত্যাশা করছেন তারা।

আবার স্থানীয় পর্যায়েও কোরবানিযোগ্য পশু প্রস্তুত রয়েছে চাহিদার অনেক বেশি। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আল মামুন হোসেন জানান, পাবনায় এবার কোরবানির উদ্দেশ্যে ২০ হাজারেরও বেশি খামারে প্রায় ২ লাখ ১৮ হাজার পশু প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে গরু ও মহিষ এক লাখ। ছাগল ও ভেড়া রয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার। অন্যদিকে এবার জেলায় পশু কোরবানি হবে ১ লাখ ৯২ হাজার। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এসব পশু দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা যাবে বলে আশাবাদী তিনি।

তবে শেষ পর্যন্ত জেলার বেপারিরা কতটা লাভবান হতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার বাজারে চাহিদা কম থাকায় তা বেপারিদের বেশ ভাবিয়ে তুলছে। স্থানীয় গরু ব্যবসায়ী মনিরুল মিয়া জানান, ঢাকার বাজারে এক চালান গরু পাঠিয়েছিলেন। তবে লাভ করতে পারেননি। ঢাকাসহ আশপাশের হাটগুলোয় বড় গরুর ক্রেতা কম। গ্রাম থেকে চড়া দামে খামারি ও পশুপালকদের কাছ থেকে গরু কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। দেড়-দুই মণ ওজনের গরু দাঁত হলেই বেপারিদের তা কিনতে হচ্ছে ৫০-৫৫ হাজার টাকায়। কিন্তু ঢাকার বাজারে এর দাম উঠছে ৪৫-৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

ফেনী: জেলায় কোরবানির পশুর মজুদ রয়েছে পর্যাপ্ত। বিশেষ করে দেশী গরু-মহিষ রয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট। এর পরও এখানকার কোরবানির হাটগুলোয় বিদেশী গরুর উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। ফলে পশুর ভালো দাম পাওয়া নিয়ে ব্যাপক শঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

ঈদের মাত্র তিনদিন বাকি থাকলেও ফেনীর পশুর হাটগুলোয় ক্রেতা সমাবেশ ঘটলেও বেচাবিক্রি এখনো জমে ওঠেনি। উপরন্তু বেশ কয়েকটি পশুর হাটেই এখন দেশী গরুর পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে বিদেশী গরুর আধিক্য। স্থানীয় খামারিদের অভিযোগ, কম দামে বাজারে বিদেশী গরু পাওয়া যাওয়ায় দেশী গরুর উপযুক্ত দাম মিলছে না। ফলে তারা শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন।

জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ফেনীতে এবার কোরবানির পশুর চাহিদা রয়েছে লক্ষাধিক। অন্যদিকে স্থানীয় খামারিদের কাছে মজুদ রয়েছে ৮৮ হাজার পশু। কোরবানির পশুর ৯০ শতাংশ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি খামারি ও বেপারিদের ন্যায্যমূল্য আদায়ে তা যথেষ্ট। কিন্তু ব্যবসায়ীদের জন্য হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদেশী গরুর সরবরাহ।

বর্তমানে ফেনীর সীমান্ত এলাকা দিয়ে চোরাচালান প্রতিরোধে সতর্ক রয়েছে প্রশাসন। সীমান্তবর্তী ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী ও পরশুরামে বিজিবি সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করছে। এছাড়া সীমান্তে টহল বাড়ানো হয়েছে।

ঝিনাইদহ: জেলার হাটগুলোতেও বেপারিদের মধ্যে হতাশা দেখা যাচ্ছে। লোকসানের আশঙ্কায় তেমন লাভ না করেই অনেকে স্বল্প মুনাফায় গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন। অনেকের ধারণা, গরুর দামের বর্তমান প্রবণতা বজায় থাকলে তারা কিছুটা হলেও লাভবান হবেন। অন্যথায় তাদের লোকসান গুনতে হবে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবার জেলায় কোরবানির জন্য ২৩৭টি খামারে ৫৫ হাজার ৮৯৬টি গরু পালন করা হয়েছে। জেলার চাহিদা পূরণ করে অর্ধেকেরও বেশি গরু বাইরের জেলায় সরবরাহ হবে বলে প্রত্যাশা খামারি ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের।

যশোর: জেলায় গরুর হাট এখনো তেমন জমেনি। হাটগুলোয় বিপুল পরিমাণ পশুর সমাগম হলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী দাম পাচ্ছেন না বিক্রেতারা। আবার ক্রেতারা বলছেন, গত বছরের চেয়ে এবার গরুর দাম বেশি চাওয়া হচ্ছে। তবে বেশির ভাগ ক্রেতারা গ্রামে গিয়ে খামারিদের কাছ থেকে সরাসরি পশু কিনে নিচ্ছেন।

যশোরের সবচেয়ে বড় হাট বসে শার্শা উপজেলার সাতমাইলে। হাটে প্রচুর গরু উঠলেও কাঙ্ক্ষিত দাম পাচ্ছেন না বেপারিরা। এ কারণে তাদের অনেকেই ঢাকামুখী হবেন বলে জানিয়েছেন।