নতুন করে তৎপর পুরনো জেএমবি

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট। সারাদেশের ৬৩ জেলায় ৫৫০টি স্পটে একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল জঙ্গি সংগঠন জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। এতে দু'জন নিহত ও ১০৪ জন আহত হন।
সিরিজ বোমা হামলার মোট ১৫৭ মামলার মধ্যে ৬৪টির বিচার দীর্ঘ এক যুগেও সম্পন্ন হয়নি। অন্যদিকে বিচার নিষ্পন্ন হওয়া ৯৩টি মামলার রায়ে ৩৪৯ আসামি খালাস পেয়েছে। ৩২০ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে। তবে এসব মামলার আসামিদের মধ্যে ২৭ জনের অন্যান্য মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। সিরিজ বোমা হামলার মামলা-সংক্রান্ত পুলিশ সদর দপ্তরের নথি পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সমকালের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ইঞ্জিনিয়ার জিয়ার নেতৃত্বে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে পুরনো জেএমবি। জামালপুরের বাসিন্দা জিয়া মূল জেএমবির নতুন আমির। এর বাইরে জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে প্রিজনভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেওয়া আসামি সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন, জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমা মিজান ও মাওলানা সাইদুর রহমান। তাদের মধ্যে সালেহীন ও বোমা মিজান ভারতে পলাতক রয়েছে বলে গোয়েন্দারা মনে করছেন। ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যান থেকে এ দু'জনকে ছিনিয়ে নেয় জঙ্গিরা।
সমকালের তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৫ সালে সিরিজ বোমা হামলার পর সারাদেশে জঙ্গিবিরোধী বড় ধরনের অভিযান শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরের বছর জেএমবির তৎকালীন প্রধান শায়খ আবদুর রহমানকে সিলেট থেকে সপরিবারে গ্রেফতার করা হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর জেএমবি নেতা আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইসহ ছয় শীর্ষ নেতার ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়।
এরপর ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে জেএমবি। তবে ২০১৩ সালে পুরনো জেএমবির কিছু সংখ্যক নেতাকর্মীকে সংগঠিত করার মাধ্যমে কানাডা ফেরত তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে নতুনভাবে দেশে জঙ্গি তৎপরতা শুরু হয়। ২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিসানে হামলা চালিয়ে তাদের ভয়ঙ্কর পুনরুত্থানের জানান দেয়। 'নব্য জেএমবি' নামে পরিচিতি পায় এ সংগঠন।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, সর্বশেষ চলতি বছরের ৪ জুলাই পুরনো জেএমবি তাদের সাংগঠনিক অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে অনলাইনে একটি প্রকাশনা বের করে। জেএমবির পলাতক নেতা সালেহীনের সাক্ষাৎকারভিত্তিক ওই প্রকাশনায় দাবি করা হয়, বাংলাদেশকে টার্গেট করে ১৯৯৮ সালে জেএমবি প্রতিষ্ঠিত হলেও পৃথিবীর অনেক দেশে এখন জেএমবির তৎপরতা রয়েছে। ভারতে সংগঠনটি সক্রিয় জামা'আতুল মুজাহিদীন ইন্ডিয়া (জেএমআই) নামে।
জেএমবি প্রতিষ্ঠার পর থেকে বেশ কিছু ঘটনাকে তাদের ভাষায় 'সাফল্য' বলে দাবি করেছে। তার মধ্যে রয়েছে ২০০৫ সালে দেশজুড়ে সিরিজ বোমা হামলা। এ হামলাকে তারা 'সাউন্ড ব্লাস্ট' নামে আখ্যায়িত করেছে। যেসব স্পটে সিরিজ বোমা হামলা হয়েছে প্রতিটি জায়গায় তারা 'ইসলামি আইন বাস্তবায়ন' শিরোনামে লিফলেট ফেলে যায়। এছাড়া ২০১৪ সালে ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে পুলিশ হত্যা করে জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাকে তারা 'বিরল' বলে আখ্যা দিচ্ছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, আল কায়দার আদর্শে বিশ্বাসী জেএমবি প্রতিষ্ঠার পর থেকে একের পর রক্তক্ষয়ী হামলা চালায়। ২০০১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার গুড়পুকুরের রক্সি সিনেমা হল ও সার্কাস মাঠে বোমা হামলা চালায় তারা। এরপর থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত অন্তত ৪০টি হামলায় জড়িত ছিল এ জঙ্গি সংগঠন।
এসব হামলায় শতাধিক ব্যক্তি নিহত হন। জেএমবির হামলার মধ্যে রয়েছে ময়মনসিংহে সিনেমা হলে বোমা হামলা, নাটোরে বোমা হামলা। আইএসের অনুসারী নব্য জেএমবি প্রতিষ্ঠার পর জেএমবির উল্লেখযোগ্য হামলা হলো রাজধানীর গোপীবাগে সিক্স মার্ডার ও ফার্মগেটে মাওলানা ফারুকী হত্যা।
দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে সারাদেশে পুরনো জেএমবির সদস্য রয়েছে পাঁচশ'র কাছাকাছি। কারাগারে রয়েছে আরও পাঁচশ' নেতা-কর্মী। আপাতত বড় কোনো হামলার সক্ষমতা তাদের না থাকলেও গোপন তৎপরতা থেমে নেই। আর্থিক নেটওয়ার্ক আরও মজবুত হলে যে কোনো সময় জেএমবির ঘুরে দাঁড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে জেএমবি তাদের নতুন আমির ইঞ্জিনিয়ার জিয়ার নেতৃত্বে চলছে।
জঙ্গি কর্মকাণ্ডের একজন পর্যবেক্ষক সমকালকে জানান, ২০১৩ সাল থেকে তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে নব্য জেএমবি যতগুলো হামলা চালিয়েছে সেগুলোর বিষয়ে পুরনো জেএমবি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। যদিও নব্য জেএমবিতে পুরনো জেএমবিরই একাধিক শীর্ষ নেতা যোগ দেয়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো_ সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, মাওলানা আবুল কাশেম ওরফে বড় হুজুর।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলাম ও নব্য জেএমবি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পুরনো জেএমবির অনেক নেতা-কর্মী ওই দুই সংগঠনে যুক্ত হলেও এখনও নতুন করে সংগঠনটি আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠতে পারে। তারা যে এখনও তৎপর এর প্রমাণ হলো কারাবন্দি জঙ্গিদের মামলা লড়তে তারা সাংগঠনিকভাবে অর্থ ব্যয় করে। আবার কেউ অসুস্থ বা পঙ্গু হলে তাকেও সাহায্য করা হয়।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে জেএমবির বড় ধরনের হামলা চালানোর মতো সক্ষমতা নেই। সিরিজ বোমা হামলায় জড়িত অধিকাংশ জঙ্গিকে আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন সমকালকে বলেন, সিরিজ বোমা হামলা মামলার একটি অংশের বিচার আজও শেষ হয়নি। কিছু মামলায় অভিযুক্তরা খালাস পেয়েছে। জঙ্গি মোকাবেলার ক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। শুধু পুলিশ দিয়ে উগ্রবাদ মোকাবেলা করা যায় না।
সিরিজ বোমা হামলার মোট আসামি ১১০৬ :২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলা-সংক্রান্ত হামলার সর্বশেষ নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ ঘটনায় ১৫৭ মামলার মোট আসামি এক হাজার ১০৬ জন। ১৪৭টি মামলায় এরই মধ্যে অভিযোগপত্র ও ১০টির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। গত এক যুগে ৯৩টি মামলায় নিম্ন আদালতের রায় পাওয়া গেছে। বিচার নিষ্পন্ন মামলায় ৩২০ আসামির সাজা ও ৩৪৯ জনকে খালাস দেওয়া হয়। বিচারাধীন মামলার আসামি চারশ'।