ব্যাংক গ্যারান্টির অর্থ নগদায়ন করছে না চট্টগ্রাম কাস্টমস

২০১৬ সালের মে মাসে যন্ত্রাংশের ঘোষণা দিয়ে পূর্ণাঙ্গ টেলিভিশন আমদানির মাধ্যমে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয় মাইওয়ান ইলেকট্রনিকস লিমিটেড। মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির এ ধরনের ঘটনায় ফাঁকি দেয়া রাজস্বের অর্থ নগদে আদায়ের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু তা লঙ্ঘন করে ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে চালানটি ছেড়ে দেয় চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। ওই মাসেই এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ব্যাংক গ্যারান্টির অর্থ নগদায়নের জন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। তা সত্ত্বেও ব্যাংক গ্যারান্টির অর্থ নগদায়ন করেনি কাস্টমস। পরবর্তীতে গত ১৩ এপ্রিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পক্ষ থেকে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অনুরূপ নির্দেশনা দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
শুধু মাইওয়ানের চালানের ক্ষেত্রেই নয়, এ রকম শতাধিক চালানে রাজস্ব ফাঁকির অর্থ নগদে আদায়ের পরিবর্তে ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে ছাড়করণের কারণে ফাঁকিকৃত রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস। এর মধ্যে দুই যুগ আগে ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে ছাড়কৃত সিগারেট পেপারের ১৫টি চালানের দেড় কোটি টাকার রাজস্ব এখন পর্যন্ত আদায় করতে পারেনি দেশের সর্বোচ্চ রাজস্ব আহরণকারী প্রতিষ্ঠানটি। নগদে অর্থ পরিশোধ করে ছাড়যোগ্য— এমন চালানে অযৌক্তিক কারণ দেখিয়ে আমদানিকারকদের হয়রানির মাধ্যমে ব্যাংক গ্যারান্টি নেয়ার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। মূলত কাস্টমসের অ্যাসেসমেন্ট (পণ্যের শ্রেণীবিন্যাস নির্ধারণ) কমিটিতে থাকা কিছু অসাধু কর্মকর্তার কারণে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক ও শুল্ক কর্মকর্তারা।
কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আমদানিকারকরা পণ্যের শুল্ক নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে কম দাবি করলে চালানটি সম্পর্কে বাড়তি যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন পড়ে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট পরিমাণ শুল্ক নগদে পরিশোধ করেন ও বাড়তি অর্থের ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে থাকেন। পরবর্তীতে বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান থেকে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এসব চালানের শুল্ক নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সাপেক্ষে ব্যাংক গ্যারান্টির টাকা আদায় অথবা ফেরত দেয়া হয়। তবে পণ্যের শ্রেণীবিন্যাসে অর্থাত্ পণ্যটি কোন এইচএস কোডে অন্তর্ভুক্ত তা ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশনের জেনারেল ইন্টারপ্রিটেশন রুলসে (জিআইআর) স্পষ্ট উল্লেখ থাকলে ব্যাংক গ্যারান্টির সুযোগ নেই। মাইওয়ানের চালানের ক্ষেত্রে তা এ নিয়ম লঙ্ঘনের মাধ্যমে শুল্কায়ন করা হয়। যদিও বিশ্বের সব কাস্টম হাউজই ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশনের জিআইআরের শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী পণ্যের শুল্কায়ন করে থাকে। অতীতে এ ধরনের অনিয়মকৃত অর্ধশতাধিক চালানের ক্ষেত্রে নগদে অর্থ পরিশোধের মাধ্যমে পণ্য ছাড় দেয়া হলেও মাইওয়ানসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এমনটি করা হয়নি বলে জানান শুল্ক কর্মকর্তারা।
আমদানি নথির তথ্যানুযায়ী, গত বছরের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে চীন থেকে টিভি যন্ত্রাংশের একটি চালান আমদানি করে মাইওয়ান ইলেকট্রনিকস। চালানটির বিপরীতে আগামপত্র (বিল অব এন্ট্রি নং-৪৯৬০৩৮) দাখিল করে খালাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান ‘ক্লাসিক শিপিং লাইনস’। চালানটির কায়িক পরীক্ষার পর এলইডি টিভির প্রায় সব যন্ত্রাংশই বিযুক্ত অবস্থায় পাওয়ায় ঘোষিত এইচএস কোড ৮৫২৯৯০৩১ (৫৪ শতাংশ শুল্ক)-এর পরিবর্তে এইচএস কোড ৮৫২৮৭২০০ (৬৪ শতাংশ শুল্ক) অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ আনেন কাস্টমস কর্মকর্তারা।
পরবর্তীতে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটি শুল্ক কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করায় তখন অ্যাসেসমেন্ট কমিটির বৈঠক হয়। আটজনের এ কমিটিতে ছয়জন শুল্ক কর্মকর্তা ও একজন করে আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের প্রতিনিধি থাকেন। বৈঠকে ছয়জন শুল্ক কর্মকর্তার চারজনই প্রস্তুতকৃত বা পূর্ণাঙ্গ পণ্যের এইচএস কোডের পক্ষে মত দেন। ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশনের জিআইআরের ২/এ ধারা অনুযায়ী এর আগেও বাংলাদেশ হোন্ডা প্রাইভেট লিমিটেড, যশোর ট্রেডিং প্রাইভেট লিমিটেড, গ্লোবাল ব্র্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেড, এনার্জি মিটার কোম্পানি লিমিটেডসহ অর্ধশতাধিক চালানে এ ধরনের অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ পণ্য হিসেবে শুল্কায়নের তথ্য-প্রমাণও অ্যাসেসমেন্ট কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়। অন্য দুই শুল্ক কর্মকর্তা, আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধি— এ চারজন বিষয়টির সঙ্গে একমত না হয়ে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দলের মতামত চান। আটজনের প্রতিনিধি দলের চারজন পক্ষে ও চারজন বিপক্ষে মত দেয়ায় চালানটির নমুনা পরীক্ষণের জন্য বুয়েটে পাঠানো হয় এবং ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে সেটি ছাড় দেয়া হয়। অথচ এক্ষেত্রে সিন্ধান্তের জন্য চালানটির নমুনা এনবিআরের কাছে পাঠানোর নিয়ম রয়েছে।
পরবর্তীতে গত বছরের জুলাইয়ের শুরুর দিকে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর চালানটি পর্যালোচনা করে কাস্টমসের এ ধরনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। কাস্টমস কমিশনারকে পাঠানো অধিদপ্তরের তত্কালীন মহাপরিচালক হোসাইন আহমেদ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে, ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে চালানটির খালাস যথাযথ হয়নি ও নমুনা পরীক্ষার জন্য বুয়েটও যথাযথ প্রতিষ্ঠান নয়। মাইওয়ানের এ চালানে কী পণ্য রয়েছে বা পূর্ণাঙ্গ পণ্য হতে আর কী কী উপাদান প্রয়োজন, সে বিষয়ে বুয়েটের ধারণা থাকলেও তাদের কাস্টমস অ্যাক্ট ও ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্জানাইজেশনের রুলস সম্পর্কে ধারণা থাকার কথা নয়। তাই চালানটি বুয়েট কর্তৃপক্ষের মতামতের ভিত্তিতে বিবেচনা নেয়া হলে সরকার রাজস্ব হারাবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। একই সঙ্গে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের পৃথক কায়িক পরীক্ষার প্রতিবেদনে চালানটিতে পূর্ণাঙ্গ পণ্য রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
সর্বশেষ চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব মো. শরফুদ্দিন মিঞা স্বাক্ষরিত এক পত্রে বলা হয়েছে, মাইওয়ান ইলেকট্রনিকসের ‘পার্টস অ্যান্ড কম্পোনেন্ট ফর এলইডি টিভি’ শীর্ষক চালানটির প্রতিনিধিদের বক্তব্য, পণ্যের নমুনা, ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহীত তথ্য, বিসিটি ও এক্সপ্লানেটরি নোটস ইত্যাদি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আমদানিকৃত চালানের সব পণ্য একত্র করলে তা টেলিভিশনের এসেনশিয়াল ক্যারেক্টার গঠন করে। যা ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্জানাইজেশনের জিআইআর অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ টিভি হিসেবে এইচএসকোড ৮৫২৮৭২০০-এ শ্রেণিবিন্যাসযোগ্য হবে। এনবিআরের পক্ষ থেকে ব্যাংক গ্যারান্টির অর্থ নগদায়ন করতে কাস্টমসকে নির্দেশ দেয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার এএফএম আবদুল্লাহ খান বণিক বার্তাকে বলেন, এনবিআরের নির্দেশনার বিষয়টি আমার নজরে আসেনি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি। বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য চালানটি খালাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ক্লাসিক শিপিং লাইনের স্বত্বাধিকারী মো. শফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।