মাদকের বিরুদ্ধে ব্যতিক্রমি যুদ্ধ

নড়াইলে মাদক রোধে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন পুলিশ সুপার সরদার রকিবুল ইসলাম। শুধু কথায় নয়, একের পর এক অভিযান করে তার প্রমাণও দিচ্ছেন তিনি।
জানা যায়, নড়াইলের এই পুলিশ সুপার মাদকের আগ্রাসন রোধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছিলেন সম্প্রতি। মাত্র কিছুদিন আগেও নড়াইলের বিভিন্ন থানা ছিলো যেন এক ‘আতঙ্কের নাম’ । চলতি বছরের ফেব্রুয়ারীতে আলোচিত বিভিন্ন মামলা নিয়ে আলোচনায় উঠে আসে নড়াইলের এসব থানা।
নানারকম হেনস্তার ভয়ে অনেকেই সেবা নিতে যেতে ভয় পেতেন এমন অভিযোগও ছিলো । চাঁদাবাজি, হয়রানি, পুলিশের সোর্সের নামে নাজেহালসহ এ সকল থানার নানা অভিযোগের চিত্র হঠাৎ উধাও এখন। নতুন করে দায়িত্ব নেবার পর বয়সে তরুন এই পুলিশ সুপার সাধারন মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে জনগনকে পুলিশ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করে নানা কার্যকরী উদ্যেগ নিয়েছেন ।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইতিমধ্যে এলাকার চিহ্নিত অনেক মাদক ব্যাবসায়ী গা ঢাকা দিয়েছে। গ্রেফতার হয়েছেন বেশ কয়েকজন । একইসাথে বন্ধ হয়ে গেছে চিহ্নিত মাদকের স্পট। মাদকসেবী আর মাদক ব্যাবসায়ীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ অনেকেই হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন। স্থানীয় সচেতন মহল পুলিশ সুপারের এমন ধারাবাহিক অভিযান ও ‘জিরো টলারেন্সকে’ সাধুবাদ জানিয়েছেন।
মাদকাসক্তির কুফল ও নির্মূলের ‘শপথ নেয়া’ এই পুলিশ সুপার গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছেন, এলাকার সচেতন মানুষের কাছ থেকেও অনেক সহযোগীতা পাচ্ছেন তিনি। বহু সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশের ধমনীর শোণিত ধারায় আজ প্রবেশ করেছে মাদকদ্রব্য নামক মৃত্যু-কুটিল কাল নাগিনীর বিষ। যা এক তীব্র নেশা।
দেশের লাখ লাখ তরুণ-তরুণী আজ এই মরণ নেশায় আসক্ত। দাবানলের মত এটি ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন শহরে, শহরতলীতে, গ্রামে-গ্রামান্তরে। এই মরণ নেশা থেকে জাতির যুবসমাজকে রক্ষা করা না গেলে এ উন্নয়নশীল জাতির পুনরুত্থানের স্বপ্ন অচিরেই ধুলিসাৎ হয়ে যাবে। সুতরাং আমার নেতৃত্বাধীন নড়াইল জেলায় কেউ মাদক সেবী বা ব্যবসায়ী প্রমানিত হলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।
দেশজুড়ে মাদকের ভয়াল থাবা ও আগ্রাসন সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, যে দ্রব্য সেবনে বা গ্রহণে মানুষ কিছু সময়ের জন্য বিশেষ প্রতিক্রিয়া অনুভব করে, দৈহিক ও মানসিকভাবে নেশায় আচ্ছন্ন হয় তাকে মাদকদ্রব্য বলে।
আর দৈহিক ও মানসিক উত্তেজক আনন্দানুভূতির এ অস্বাভাবিক অবস্থাই মাদকাশক্তি। এদেশে গাজা, মদ, ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবা ও শীসাসহ আরও অনেক জনপ্রিয় মাদক ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সহজ আনন্দ লাভের বাসনা, মাদকের কুফল সম্পর্কে অজ্ঞতা, প্রতিকূল পারিবারিক পরিবেশ, বন্ধু- বান্ধব ও সঙ্গী সাথীদের প্রভাব, পারিবারিক পরিমন্ডলে মাদকের প্রভাব, কৈশোর ও যৌবনের বেপরোয়া মনোভাব , বেকারত্ব, হতাশা ও আর্থিক অনটন, মনস্তাত্বিক বিশৃংখলা ও মাদকের সহজলভ্যতাই মাদকাসক্তির অন্যতম প্রধান কারণ।
নতুনত্বের প্রতি মানুষের চিরন্তন নেশা, নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের দুর্নিবার আকর্ষণ ও আপাত ভালো লাগার অনুভূতি-তাড়িত হয়েও অনেকে মাদক ব্যবসায়ীদের পেতে রাখা ফাঁদে কীট-পতঙ্গের মত ধরা দেয়। এভাবেই নৈরাজ্যের সুতীব্র যন্ত্রনায় দগ্ধীভূত হয়ে যুবসমাজ বেছে নেয় মাদকাসক্তির মাধ্যমে আত্মবিনষ্টির পথ। মাদকের অপব্যবহারে ব্যক্তি তো বটেই, পুরো পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রকেও নানাভাবে ক্ষতির সম্মুখীন করে।
মাদকের নিষ্ঠুর ছোবলে অকালে ঝরে যাচ্ছে বহু তাজা প্রাণ এবং অংকুরেই বিনষ্ট হচ্ছে বহু তরুণ-তরুণীর সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। মাদকদ্রব্য তরুণ সমাজের এক বিরাট অংশকে অকর্মন্য ও অচেতন করে তুলছে, অবক্ষয় ঘটাচ্ছে মুল্যবোধের। মাদকাসক্ত ভীরু ব্যক্তি খোজে সাহস, দুর্বল খোজে শক্তি, দুঃখী খোজে সুখ, কিন্তু অধঃপতন ছাড়া আর কিছুই জোটে না। অনেকে মাদকের অর্থের যোগান দিতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ছে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি সহ নানা অনৈতিক কর্মকান্ডে। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর মতে সুশৃংখল জীবন যাপনই পারে মাদকমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ করতে।
অন্যদিকে এ সমস্যা মোকাবেলা ও সমাধানের সবচেয়ে কার্যকর বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া হচ্ছে- প্রতিকারমূলক, প্রতিরোধমূলক ও পূণর্বাসনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তাছাড়া অবৈধ মাদক পাচারকারী ও চোরাচালানকারীদের চিহ্নিত করে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা সহ ব্যাপক সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের মাঝে নৈতিক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলা। এক্ষেত্রে পিতা-মাতা, অভিভাবক, শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রশাসন, নীতি-নির্ধারক, রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক সহ সকল স্তরের নাগরিরকদের ঐক্যবদ্ধ অঙ্গীকার ও প্রচেষ্টা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
তবেই আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে মাদকের অভিশাপ থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত নড়াইল জেলার সকল পুলিশ অফিসারদের নির্দেশ দেয়া রয়েছে, মাদক ব্যবসায় ও ডাকাতি এবং ধর্ষণের সাথে জড়িত প্রমাণ হলে ছাড় দেয়া হবে না। অভিযুক্তদেরকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, এভাবেই দেশের প্রতিটি পুলিশ কর্মকর্তা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিলে খুব দ্রুতই বদলে যাবে সমাজের হাজারো অনিয়ম।