বৈসাবী উৎসবে মেতেছে পাহাড়

উৎসব আয়োজনে সেজেছে পাহাড়। ঐতিহ্যবাহী বৈসাবী, বিজু,সাংগ্রাই, বৈসু ও বাংলা নববর্ষকে বরণ করতে পল্লীতে পল্লীতে এখন চলছে নানা আমেজ। সরকারী- বেসরকারী ও সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হাতে নিয়েছে বর্ণিল কর্মসূচী। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন সামাজিক উৎসবের আয়োজন করছে।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, মারমা উন্নয়ন সংসদসহ স্থানীয় বিভিন্ন সম্প্রদায় আলাদা আলাদা ভাবে তাদের ঐতিহ্য তুলে ধরতে নানা কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়েছে।
বিজু, সাংগ্রাই, বৈসাবী অনুষ্ঠানে রঙ বাহারী সাজে ঐতিহ্যবাহী পোশাকে দেখা যাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীদের। ঘরে ঘরে মেহেমান আপ্রায়ণের জন্য প্রস্ততি নিচ্ছে ব্যস্ত পাহাড়ী পল্লীবাসী।
এই ব্যাপারে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ ১১ই এপ্রিল ২০১৬ সম্মিলিত ভাবে বৈসাবি ও শুভ বাংলা নববর্ষ পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ইতিমধ্যে মারমা উন্নযন সংসদ ও মারমা সংগঠন ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যান সংস পৃথক পৃথক ভাবে বিভিন্ন কর্মসুচী গ্রহন করেছে। আগামী ১৪এপ্রিল থেকে মূল উৎসব শুরু হবে।
এবার মারমা ও রাখাইন সম্প্রদায় ১৩ই এপ্রিল মূল ধর্মীয় উৎসব পালন করবে । ০৭ এপ্রিল হতে ১০এপ্রিল ২০১৬ পর্যন্ত বৈসু-সাংগ্রাইং-বিজৃু (বৈসাবি) খাগড়াছড়ি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউটের উপ-পরিচালক সুখময় চাকমার ৪ দিনব্যাপী আয়োজন করেছে।
২৯৮নং খাগড়াছড়ি আসনে সাংসদ কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার স ম মাহবুব-উল-আলম, পাজেপ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী, শরনার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্সেও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কৃঞ্চ চন্দ্র চাকমা, জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান, পুলিশ সুপার মজিদ আলী উপস্থিত ছিলেন।
খাগড়াছড়ি ৯টি উপজেলায় চাক্মা, মারমা, ত্রিপুরা ও বাঙ্গালীসহ সকল সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবে পাহাড়ে বর্ষবরণ করার ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহন করেছে। তাইতো পাহাড়ে এখন সাজ সাজ রব। এছাড়াও উপজাতীয় গ্রামে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ক্লাব ও সমিতি’র উদ্যোগে বিভিন্ন এতিহ্যবাহী খেলাসহ জাতীয় খেলায়ও আয়োজন করে উৎসবকে আরো আনন্দময় করে তোলার ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ সুপার মজিদ আলী বলেন, পাহাড়ে বর্ষবরণ উৎসবকে প্রাণবন্ত করতে নিছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে।
বৈচিত্রময় আপ্যায়নতার তিনটি দিন-----
উপজাতীয়দের প্রধান উৎসব বৈসাবির ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে তেমনি উৎসবে তিন দিনের নামও আলাদা। ত্রিপুরাদের বৈসু,মারমাদের সাংগ্রাই আর চাকমার বিজু এ তিন ভিন্ন চেতনার উৎসবের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে বৈসাবির নাম করণ। আনন্দ, বেদনা, চিন্তা, চেতনায় উদ্দীপ্ত অনুষ্ঠানে বাঙ্গালীদের (বড়য়া, হিন্দু, মুসলিম) পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণ করে আনন্দে মেতে উঠেন।
মনের আনন্দ আর শুভেচ্ছা বিনিময় করে একে অপরকে কাছে টেনে নেয় বর্ষ বরণের মধ্য দিয়ে। মানুষের ঘরে ঘরে বর্ষ বরন ও বর্ষ বিদায় উৎসবের আনন্দের বন্যা সকলের মধ্যে নতুনের বার্তায় সিক্ত করে। এ বিশেষ দিনে উৎসবে মধ্য দিয়ে চাক্মা, মারমা ও ত্রিপুরারা বিশেষ আকর্ষনীয় অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন।
এতে চাকমাদের বিজু হেসে খেলে ঐতিহ্যবাহী নৃত্য, ত্রিপুরা সম্প্রদায় গরাইয়া নৃত্য ও মারমারা ঐতিহ্যবাহী জলকেলি উৎসব বা পানি খেলায় মেতে উঠে।
মারমা সম্প্রদায়ের সাংগ্রাই উৎসব: মারমারা সাংগ্রাই ১ম দিনকে পেইংছুয়ে (১২ এপ্রিল), ২য় দিনকে আকেই মুল সাংগ্রাই, (১৩ এপ্রিল) ৩য় দিনকে (১৪এপ্রিল) আক্যে ও ৪র্থ দিনে-আপ্যেইং (১৫এপ্রিল) আতাদা হিসেবে পালন করে পুরানো বছরকে মুছে ফেলে নতুন বছর গ্রহণের ঐতিহ্যবাহী মৈত্রী পানীয় উৎসব বা জলকেলী উৎসবের মাধ্যমে তরুণ-তরুণীরা, যুবক-যুবতীদের একে অপরকে বর্ষ বরণ ও বিদায় বৃষ্টিতে সিক্ত করে। সাংগ্রাই এর প্রধান উৎসবে মন্দির বা ক্যায়াং ঘরে প্রথমদিনে ভালভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতায় মেতে উঠে তারা। দায়ক-দায়িকারা টানা তিনদিন অবস্থান নিয়ে দীক্ষায় অভিভূত হয়ে বুদ্ধ মূর্তির সামনে ফুল রেখে ও মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রণাম করেন। পল্লীবাসীরা ক্যায়াং ঘরে গুরু ভিক্ষু, শ্রমন, সাধুদের উদ্দেশ্যে ছোয়াইং প্রদান করে থাকেন। পরে চন্দন পানি, দুধ ও ডাবের পানি দিয়ে বুদ্ধ মূর্তিকে স্নান করানোর মধ্য দিয়ে সূচনা হয় সাংগ্রাই এর নতুন বছর। ঐ দিন তরুণ-তরুণীরা জলবর্তী পাত্র দিয়ে দলে দলে এসে সাংগ্রাইতে মিলেমিশে জলকেলি বা পানীয় খেলাতে মেতে উঠে। এতে বিভিন্ন খেলাদুলা,ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক নৃত্য,নৌকাবাইচ এর আয়োজন করে থাকে।
এছাড়াও অনেক এলাকায় দল বেঁধে বুদ্ধমূতিকে গোসল,এরপর পরবর্তী দিনে উৎসবের মূল দিনের খানাপিনা আয়োজন। উৎসবের ২য় দিন প্রতিটি বাড়ীতে নানা মূখরোচক খাবারের আয়োজন করা হয়। এতে ৩০-৩৭ বা তার বেশী আনাসপাতি দিয়ে তৈরী পাচন এবং পানীয় পরিবেশন করা হয়। নানা বয়সী লোকজন সারাদিন দল বেঁধে হৈ-হুল্লার করে ঘুরে বেড়ায়।
চাকমা সম্প্রদায়ের বিজু উৎসব : পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য উপজাতীয়দের তুলনায় চাকমারা খুব সচেতন ও প্রফুল্ল মনের জাতি। চাক্মারা ১ম দিনে ফুল বিজু, মুল বিজু ও গোজ্যেপোজ্যে উৎসব পালন করে থাকে। চাকমারা উৎসবের প্রথম দিনে ঘরবাড়ী ও আঙ্গিনা পরিস্কার করা ও ফুল দিয়ে সাজায়। পাহাড়ী ছড়া, ঝর্ণা বা নদীতে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে মা গঙ্গাকে পূজা করে গোসল করেন তারা। খাগড়াছড়িতে ‘সর্বজনীন বৈসাবি উদযাপন কমিটি’ গঠন করে এর উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে সম্মিলিত বৈসাবী উদযাপন করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি (বৈসু-সাংগ্রাই-বিঝু)’ সমাগত। এ উৎসবকে সুষ্ঠুভাবে উদযাপনের লক্ষ্যে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও জেলা কার্বারী এসোসিয়েশনের সভাপতি রণিক ত্রিপুরাকে আহ্বায়ক ও সমাজকর্মী তৃপ্তিময় চাকমাকে সদস্য সচিব করে ২৩ সদস্যের ‘সর্বজনীন বৈসাবি উদযাপন কমিটি’ গঠন করা হয়েছে।
এতে খাগড়াছড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ বিশিষ্ট মুরুব্বীদের নিয়ে ১৭ সদস্যের একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়েছে। কমিটির উদ্যোগে বৈসাবি উপলক্ষে কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে-১২এপ্রিল ২০১৬,মঙ্গলবার সকাল ৬-৭টায় চেঙ্গী নদীতে (চেঙ্গী ব্রীজ এলাকায়) ফুল ভাসানো হবে। একই দিন সকাল ৯টায় বর্ণাঢ্য র্যালি ও সন্ধ্যায় শান্তি ও মঙ্গল কামনায় পল্লীতে পল্লীতে ফানুস উড়ানো হবে। র্যালিটি মধুপুর থেকে শুরু হয়ে উপজেলা পরিষদ মাঠে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
১৪ এপ্রিল ২০১৬ বৃহস্প্রতিবার বর্ষ বিদায় ও বর্ষবরণ উপলক্ষে খাগড়াছড়ির মহাজন পাড়ায় প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হবে। বৈসাবি উৎসব সুষ্ঠু ও সফলভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব তৃপ্তিময় চাকমার স্বাক্ষরিত পক্ষ থেকে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে। এই ছাড়াও পাড়ার যুবক যুবতীরা নদী থেকে পানি তুলে প্রবীণদের গোসল করিলে আশীর্বাদ নেন।
৩য় দিনে দল বেঁধে মন্দিরে গিয়ে নতুন বছরে সুখ, শান্তি সমৃদ্ধি কামনা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়। অনেকের উৎসবের তিনদিন মন্দির, বাড়ীর আঙ্গীনা, নদীর ঘাট, সবুজ গাছের নীচে এবং গোয়াল ঘরে বিভিন্ন দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে মোমবাতি প্রজ্জলন করেন।
ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বৈসু: ত্রিপুরাদের বৈসুক সাধারণত সামাজিক উৎসব। ত্রিপুরারা বাংলা নববর্ষের শেষ দিনটিকে বৈসুমা বা বৈসুকমা, তার আগের দিনটিকে হারি বৈসু এবং নববর্ষ ১ম দিনটিকে আতাডাক বলে। হরি বৈসুককের দিন তারা বিভিন্ন ধরনের ফুল দিয়ে ঘর সাজায়, গরু, মহিষ, ছাগলসহ গৃহপালিত পশুদের খুব ভোরে ঘর থেকে ছেড়ে দেয়। তরুণ-তরুণীরা নতুন কাপড় পড়ে এই ঘর থেকে ঐ ঘরে ঘুরে বেড়াই।
ত্রিপুরারা তাদের বৈসুমা দিনে তাদের বাড়িতে অতিথিদের মদ, পিঠা, পাচন ও দিয়ে আপ্যায়ন করে ঐ দিন ত্রিপুরা ছেলে-মেয়েরা নুনছড়ি দেবতা পুকুর বা নদী থেকে জল এনে তাদের নানা-নানী, দাদা-দাদীসহ স্থানীয় গুরুজনদের স্নান করিয়ে তাদের কাছে আর্শীবাদ গ্রহণ করেন। বৈসু সময় ত্রিপুরারা গরাইয়া নাচে শিল্পিরা পাহাড়ী পল্লীতে ঐতির্য্যবাহী নৃত্য পরিবেশন করে।