English Version
আপডেট : ৪ মার্চ, ২০১৬ ১০:৩৮
আইন আছে, প্রয়োগ নেই..!!

নড়াইল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে হরেক প্রজাতির মিঠা পানির মাছ

উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি
নড়াইল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে হরেক প্রজাতির মিঠা পানির মাছ

 

আসছে ভরা বর্ষা। খাল-বিল পানিতে থৈ-থৈ আর মৎস্যজীবিদের নির্ঘুম রাত জাগার কথা। ভোরের আলো ফুটতেই গ্রামের ছোট ছোট হাট-বাজার আর পাড়া মহল্লায় জেলেদের হাক-ডাকে মুখরিত হওয়ার সুদিন ফুরাতে বসেছে। ‘মাছে ভাতে বাঙালী’ অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে প্রাকৃতিক মাছ। শূন্য শহর থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত এর প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানব দেহে প্রাণীজ আমিষের ৭৮ ভাগ পূরণে সক্ষম নানা প্রজাতির ছোট মাছের অভাবে জনজীবনে পুষ্টিহীনতার প্রকোপ বাড়ছে বৈ কমছে না। বিল-বাওড় ও নদ-নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়া, নদীর নাব্যতা হ্রাস, খাল-বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, মা মাছ নিধন, জলাশয় দুষণ, পানিতে কীটনাশক প্রয়োগ, রাক্ষুসে মাছের চাষ, মৎস্য আইন অমান্য ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছোট মাছ বিলুপ্তির যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মৎস্য অফিস সূত্র জানা যায়।

নড়াইলে আকাশ ছোঁয়া মাছ বাজারে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের নদীর মিঠাপানির সুস্বাদু ছোট মাছ ক্রয়ক্ষমতা সাধ্যের একেবারে বাইরে প্রায়। সাধ ও সাধ্যের মিলন মেলায় ছোট মাছের বাজারে অভাবী মানুষের শুধু চেয়ে থেকে বিত্তশালীর দাম হাকা দেখেই অবাক তাকিয়ে থাকতে হয়। প্রতিনিয়তই বড় মাছের চেয়ে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছের বাজারে ভীড় থাকলেও পর্যাপ্ত মাছ নেই আবার মাছ থাকলেও উচ্চমূল্যের বাজারে ক্রয়ক্ষমতা স্বল্প মানুষের। সরেজমিনে বাজার ঘুরে জানা যায়, নড়াইলের বেশিরভাগ মৎস্য ব্যবসায়ীরা ঋণগ্রস্থ এবং নিজেদের জাল থাকলেও জল নেই, নেই খাল-বিল, নদ-নদীতে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাকৃতিক মাছ যা দেহগঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বাজারে আয়রণ, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন এ সমৃদ্ধ চিরচেনা ছোট মাছের বাজার ব্যাপক চড়া। চাপিলা, চেলাপুটি, খয়রা, কৈ, শিং, মাগুর, ফেসা, রূপচাঁদা, ডানকোনা, রয়না, পিয়ালী, বেলে, টেংরা, সরপুটি বাজারে নেই বললেই চলে। তবে ছোট চিংড়ি, পুটি, বাইম ও চাঁদা মাছের দেখা মিললেও একজন মৎস্যজীবির নিকট ২ কেজির বেশি কল্পনা করা যায়না। দামও সাইজ ভেদে ১’শ থেকে ৮’শ টাকা কেজি। দেশীয় প্রজাতির ভাল কৈ, শিং ও জিয়লের কেজি ৫-৮’শ টাকা দাম হাকানো হলেও বাজারে পর্যাপ্ত নেই। হাতে গোনা দু-চার কেজি চাপিলা, পিয়ালী, টেংরা বিক্রি হলেও প্রতি কেজি ৭-৮’শ টাকা। তাছাড়া রোজার বাজারে ছোট মাছ মেলতে না মেলতেই বেচাকেনা শেষ হয় প্রথম ভাগেই।

শরীরের ৭৮ভাগ প্রাণীজ আমিষের চাহিদা পূরণে সক্ষম এ সকল ছোট প্রজাতির মাছ সংকটের অন্যতম কারণ পানি ও নদ-নদীতে কারেন্ট জালের ব্যবহার, মা মাছ ধরাকে দায়ী করা হলেও ইছামতির বিল এলাকার জেলে হরেন কুমার জানান, স্বল্প মেয়াদীতে জলাশয় ইজারা দেওয়ায় মৎস্যচাষীরা বছর শেষে খামারে বিষ প্রয়োগ করে অতিঅল্প সময়ে বেশি লাভের আশায় রুই, কাতলা, মৃগেলসহ বড় বড় মাছের চাষ করে। যে কারনে প্রাকৃতিক মাছের ডিম ছাড়ার সময় বেশিরভাগ ছোট মাছ মারা পড়ে যায়। জেলেদের পাশাপাশি গ্রামীণ নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত অনেকেই সখের বশে কিংবা জীবিকার তাগিদে এ পেশায় ঝুঁকে পড়লেও আশানুরূপ মাছ নেই। তারা দোয়ারী, ঘুনি, ধর্মজাল, বেড়া জাল, পাতজাল, খেপলা, কারেন্টজাল ব্যবহার করে ছোট প্রজাতির বিভিন্ন মাছ ধরলেও আজকাল বিল-বাওড়, মাঠ-ঘাটে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় এসব মাছ ধরার যন্ত্রের চাহিদাও কম।

এছাড়াও শিয়াল, ভোদর, সাপ, কচ্ছপ, মাছরাঙা, বক, চিল, পানকৌড়ির আক্রমনে কয়েক প্রজাতির ছোটমাছ এখন বিলুপ্তির পথে। সেকেলে প্রত্যন্ত পল্লীর মানুষ চাহিদা মিটিয়ে বর্ষা মৌসুমের অতিরিক্ত মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করতো এখন তা কল্পনাতীত। ৯০ দশকে যার কমতি ছিলনা। ‘মাছে ভাতে বাঙালী’ একটি অতীত ঐহিত্য হারিয়ে বিলুপ্তপ্রায় ২০ প্রজাতির ছোটমাছ সংকটে পড়া শুধু নড়াইলবাসী নয়। দেশের বহু অঞ্চলেই এর প্রভাব লক্ষণীয়।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ করতে সমন্বিত উদ্যেগ প্রয়োজন, বর্ষা মৌসুমে মা মাছ নিধন, প্রাকৃতিক মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সংক্ষরণ, জেলেদের এসব মাছ ধরা থেকে বিরত রাখা, কীটনাশক ও ভারতীয় থায়োডিন ব্যবহার কমানো ও উন্মুক্ত জলাশয় দীর্ঘমেয়াদী ইজারার মাধ্যমে প্রাকৃতিক মাছ সংরক্ষণ করা সম্ভব। তাছাড়া এর উপকারীতা সম্পর্কে জনসচতেনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা বাড়ানো প্রয়োজন।