English Version
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০২:০০
মুনাফাভোগীদের অশুভ শক্তিতে

নড়াইলে কৃষি জমি হারিয়েছে ২১ হাজার একর

উজ্জ্বল রায়
নড়াইলে কৃষি জমি হারিয়েছে  ২১ হাজার একর

নড়াইল মুলত কৃষি প্রধান জেলা । এই জেলার উৎপাদিত ফসল জেলার  চাহিদা মিটিয়ে অন্য জেলায় পাঠানো হত। জেলার আবাদী জমির পরিমান প্রায় ৭৬ হাজার ৮০৭ হেক্টর হলেও সময়ের পালাক্রমে ধারাবাহিকভাবে এ পরিমান কমেছে। যেন অনেকটা বানিজ্যক চিন্তায় মুনাফাভোগী শ্রেনী পরিকল্পিতভাবে এ কমার পিছনে দায়ী।

দ্যাঢাকাপোষ্ঠডটকমের অনুসন্ধানি এক পতিবেদনে দেথা যাচ্ছে, এ জেলায় নানা শ্রেনীর অশুভ শক্তিতে গড়ে তোলা হচ্ছে শ্ল্পিকারখানা, ইটভাটা, ঘের বসতবাড়ীসহ নানা স্থাপনা। এছাড়াও প্রতিবছর নদী ভাঙ্গন রয়েছে। ফলে দিন দিন গ্রামবাসী হারাচ্ছে তাদের ফসলি জমি। এসব জমি বিক্রয় করাতে অনেক ক্ষেত্রে কৃষকদের বাধ্য  করছে নানা চক্র। এসব কাজে এ জেলার প্রভাবশালীরা জড়িত রয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে পেশি শক্তিরও ব্যবহার হচ্ছে এমন অভিযোগ শোনা গেছে।

ফলে ছোট হয়ে আসছে জেলার কৃষি জমির মানচিত্র। গেল এক দশকে জেলায় ফসলি জমি কমেছে  প্রায় ২১ হাজার ৩০১ একর। আবার প্রতি বছর মধুমতী নদী কেড়ে নিচ্ছে শত শত একর আবাদি জমি। সবচেয়ে দু:খজনক বিষয় বর্তমান কৃষি জমির পরিমান কত, তা কোন তথ্য নেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরে।

জেলা প্রতিনিধি  উজ্জ্বল রায়ের পাঠানো তথ্য মতে, কৃষি জমি হারিয়ে যাওয়া ২১ হাজার ৩০১ একর মধ্যে ইটভাটা তৈরী করতে ৬০০ একর, ইটের কাচামাল হিসাবে মাটি ব্যাবহার করায় ৭ হাজার একর, মৎস্য ঘেরে ৪৩০০ একর, নদী ভাঙ্গনে অন্তত ৪০৫০ একর, ২টি পিকনিক স্পটে  ২১ একর, বসত বাড়িতে  ৪৯৬৯ একর, সরকার জমি অধিগ্রহন করেছে ৩৮২ একর ফসলি জমি নদী নষ্ট হয়েছে।

বিভিন্ন সুত্র মতে, আকার ভেদে একটি ইট ভাটা গড়ে তুলতে কমপক্ষে ৫ একর জমির প্রয়োজন হয়। কোন কোন ইট ভাটা তৈরি করতে ২০-২২ একর জমিও প্রয়োজন হয়। ১০ বছর আগে জেলায় হাতে গোনা  সবোচ্চ ২০ টি ভাটা ছিল।  কিন্তু এখন তা বেড়ে দেড় শতাধিকে পৌছেছে। আর এসকল ইট ভাটা তৈরি করতে অন্তত ৬ শত একর ফসলি জমি ব্যবহৃত হয়েছে বলে কৃষকদের দাবি।

স্খানীয় একাধিক ভাটার ম্যানেজার জানান, সাধারনত মধ্যম সারীর একটি ভাটায় বছরে ৪০/৫০ লাখ ইট পোড়ানো হয়ে থাকে। আর প্রতি ৮ হাজার ইটের জন্য কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার হয় ১ হাজার ঘনফুট মাটি। যে মাটির যোগান দেওয়া হয় কৃষি জমি থেকে। এজন্য প্রতিটি ভাটায় বছরে ৫/৬ একর জমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহৃত হয়। সে হিসাবে দেড় শতাধিক ভাটাতে প্রতি বছর অন্তত ৭শ একর জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি ব্যবহৃত হয়। আর দশ বছরে পরিমান দাড়ায় ৭ হাজার একর।

প্রায় ১০ বছর আগেও যে জমিতে ধান, পাট ও অন্যান্য ফসল উৎপাদন হতো সেই জমি এখন বসতবাড়ি। বিল পাড়া, নতুন পাড়া, চর পাড়াসহ বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়ে উঠছে কৃষি জমিতে গড়ে নতুন এলাকা সমুহ। বিলের জমিতে একটি বাড়ি হলে দু এক বছরের মধ্যে সেই এলাকায় তৈরী হচ্ছে নতুন নতুন বসতি। আর অপরিকল্পিতভাবে কৃষি জমিতে গড়ে ওঠা বসতবাড়ি দখলের ফলে একদিকে যেমন ফসল উৎপাদন কমছে। অপরদিকে পাল্টে যাচ্ছে জেলার কৃষি জমির মানচিত্র।

কৃষি জমিতে কেন বসত বাড়ি তৈরী করছেন এমন পরিবারের সদস্যরা জানালেন, বাড়ছে জনসংখ্যা আর এই কারনে কৃষি জমিতে নতুন বাড়ি করছেন। শহরের জমির দামের তুলনায় কৃষি জমির দাম কম হওয়ায় কৃষি জমিতে গড়ে উঠছে বসতবাড়ি।

জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ থেকে জানা যায়, গত ১১ বছর আগে নড়াইলে মোট জনসংখ্যা ছিল ৬ লক্ষ ৭০ হাজার ৩শ ২০ জন বর্তমানে জনসংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছে ৭ লক্ষ ৮০ হাজার ৭শ ৪৫ জনে। গড় হিসেবে  দেখা গেছে প্রতি ৪ জনের জন্য একটি বসতবাড়ি প্রয়োজন হয়। এই বাড়তি জনসংখ্যার বাসস্থানের  জন্য বসতবাড়ি বৃদ্ধি পেয়েছে অন্তত ২৭ হাজার ৬শ ৬ টি। আর এই বাড়ি গুল ৯০ ভাগই হয়েছে গ্রামে। গ্রামে কৃষকের বসত বাড়ি করার জন্য বেশি জমি প্রয়োজন হয়। কারন কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল বাড়ির উঠানে (আঙ্গিনায়) উড়ানো, শুখানুর কাজ করে ঘরে তোলে। আর একটি বসতবাড়ি তৈরী করতে জমির প্রয়োজন হয় গড়ে বিশ শতক। ফলে  ২৭ হাজার ৬শ ৬ টি বাড়ি তৈরী করতে জমি প্রয়োজন হয়েছে ৫ লক্ষ ৫২ হাজার ১শ ২০ শতক অর্থাৎ ৫ হাজার ৫শ ২১ একর। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে অন্তত ৯০ শতাংশ নতুন বসতবাড়িই তৈরী হয়েছে ফসলি জমি নষ্ট করে।  অর্থাৎ বাড়তি বসতবাড়ি তৈরী করতে ফসলী জমি নষ্ট হয়েছে ৪ হাজার ৯শ ৬৯ একর।

নড়াইল জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ভুমি অধিগ্রহন শাখা থেকে জানা যায়, গেল ১০ বছরে নড়াইলের তিনটি উপজেলা থেকে বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠান করার জন্য ৭৮ একর জমি অধিগ্রহন করা হয়েছে। আর  রেল লাইন করার জন্য জমি অধিগ্রহনের প্রক্রিয়াধিন রয়েছে প্রায় ৪০০ একর। আর এই মোট ৪৭৮ একর জমির অন্তত আশি ভাগ রয়েছে ফসলী জমি। অর্থাৎ ১০ বছরে সরকার ৩৮২ একর ফসলি জমি অধিগ্রহন করেছে।

মৎস্য বিভাগ সুত্রে, গত ১০ বছরে নড়াইলের তিনটি উপজেলায় ২ হাজারের বেশি নতুন মৎস্য ঘের বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই ঘের তৈরী করতে জমি প্রয়োজন হয়েছে ৪ হাজার ৩শ একর। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে নতুন শতভাগ তৈরী করা হয়েছে ফসলি জমির উপর। অর্থাৎ ১০ বছরে মৎস্য ঘেরে চলে গেছে  ৪ হাজার ৩শ একর ফসলি জমি।

নদী ভাঙ্গন এলাকা ঘুরে জানা যায়, নড়াইল জেলার লোহাগড়া ও কালিয়া উপজেলার মধুমতী নদীর ২ পাড়ে রয়েছে মোট ৭৬টি গ্রাম ও হাজার হাজার একর ফসলি জমি রয়েছে। প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে মধুমতি নদী তীর সংলগ্ন কালিয়া ও লোহাগড়া উপজেলার শিয়েরবর, মাকড়াইল, মঙ্গলহাটা, মহাজন, শালনগর, ধানাইড়, বকজুড়ি, রামকান্তপুর, আমডাঙ্গা, বারইপাড়া এলাকাসহ ২টি উপজেলার ৭৬ গ্রাম ভাঙ্গনের মুখে পড়ে নদীর গর্ভে চলে যায় বাড়িঘর, গাছপালা বাজার সহ  ও শত শত একর ফসলি জমি।

শত বছর যাবৎ ভাঙ্গছে নদীর ২ পাড়ের হাজার হাজার একর ফসলি জমি। তবে কি পরিমান জমি নদী গর্ভে চলে গেছে সেটা সরকারী কোন দপ্তরের জানা নেই। বিভিন্ন ইউনিয়ন ভুমি অফিস, ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা চেয়ারম্যান সাথে কথা বলে জানা গেছে গত ১০ বছরে গড়ে ভাঙ্গন কবলিত এলাকার ৭৬ টি গ্রামের মধ্যে অন্তত ৫৪টি গ্রামের প্রতিটা গ্রামে  ১৫ জন করে তাদের ফসলি জমি নদীতে হারিয়ে ভুমি হিন হয়েছে। আর এক এক জন কৃষক হারিয়েছেন ৫ থেকে ১৫ একর জমি। হিসাবে দেখা গেছে এক জন কৃষকের যদি ৫ একর জমি নদীতে চলে যায়। তাহলে ৫৪ টি গ্রামের ৮১০ জন কৃষকের ৪০৫০ একর ফসলি জমি নদী  গর্ভে চলে গেছে।

মধুমতি নদীর পাড়ে ঘাঘা পশ্চিমপাড়া গ্রামের বাসিন্দা কবির মোল্যা জানান, বাবা রেখে গিয়েছিল ১২ একর জমি সেই জমিতে চাষাবাদ করে  ৭ ছেলেমেয়ে নিয়ে ভালভাবেই  চলছিলো তার সংসার। গেল ১৬ বছরে তার চাষের সব জমি  আস্তে আস্তে মধুমতির কবলে চলে যায় তার জমি। গেল ১০ বছরে ৯ একর ফসলি জমি মধুমতী নদীতে চলে গেছে  তার। পরে অন্যের জমিতে চাষ করে ছেলেমেয়ে নিয়ে কোন রকমে বসবাস করছিলেন কবির মোল্যা,স্ত্রী পরের বাড়িতে কাজ করে ছেলে মেয়েদের খাওয়ায়। এত বড় সংসার চালাতে হিমশিম খেলেও  রাতে নিজের বাড়িতে ঘুমাতেন এই ছিলো তাদের শান্তনা। কিন্তু গেল বছর (২০১৫ সাল) নদী ভাঙ্গনে তার সেই ভিটেটুকু চলে গেছে মধুমতির পেটে। ঘর বাধার আর কোন জায়গাই যে নেই তার। বাধ্য হয়ে ঘাঘা গ্রামের কবর স্থানের পাশের একটু খালি জায়গায় তার ভাঙ্গা চাল আর পাটকাঠির বেড়ার ঘরে সেখানেই সংসার পেতেছেন। রাতে শেয়ালের ডাকে ছোট ছেলেমেয়েদের ভয় লাগলে ও তার যে আর কোন উপায় নেই। রাতদিন রাক্ষুসে নদীকে গালি দিয়েই স্বস্তি হয় তার।

তিনি আরও জানান তাদের গ্রামে তার মত অন্তত ৫০ জন কৃষকের  জমি নদীতে চলে গেছে। এখন আর জমি বর্গা করতে চায়লেও  কোন লোক জমি বর্গা দিতে চাইনা । কারন সব কৃষকের জমিইতো নদীতে কেড়ে নিয়েছে।

ভাঙ্গন কবলিত মধুমতি পাড়ের ফসলি জমি রক্ষার ব্যাপারে কোন আশার কথা শোনাতে পারেননি  নড়াইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ মনির”ল ইসলাম। তিনি  বলেন, আপাতত এলাকার মধুমতির ভাঙ্গনের ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তেমন কিছুই করনীয় নেই, তবে আমরা মধুমতি নদীর কালনা অংশ থেকে মাগুরা পর্যন্ত নদী তীর বাধের জন্য প্রকল্প প্রনয়ন করেছি, তা পাশ হলে আশাকরি আর ভাঙ্গন থাকবে না এবং হাজার হাজার একর ফসলি জমি নদী গর্ভে বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা পাবে। এতে এলাকার শত শত কৃষক লাভবান হবে। 

কৃষি বিভাগ থেকে জানা যায়, এক একর জমিতে বছরে ১৫ থেকে ১৬ মন ধান উৎপাদন হয়। তাহলে ২১ হাজার ৩০১ একর জমিতে বছরে শুধু ৩ লাখ ১৯ হাজার ৫১৫ মন ধানই উৎপাদন হত।

নড়াইল কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ পরিচালক শেখ আমিনুল হক জানান, ফসলি জমির উপরি ভাগের মাটি কেটে ইট ভাটায় কাচামাল হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে সে জমিতে কোন ফসল আবাদ করতে পারছেনা কৃষকরা। এছাড়া আবাদী জমিতে যেখানে ফসল উৎপাদন হয় সেখানে যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে বসতি স্থাপন রোধে প্রশাসনকে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে। একটা বিধি নিষেধ করে যত্রতত্র বাড়িঘর নির্মান বন্ধের পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি আরও বলেন প্রতি বছর জেলার শত শত একর ফসলি জমি মধুমতি নদী গর্ভে চলে যায়। এ ব্যাপারে সকারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

জেলা প্রশাসক মোঃ হেলাল মাহমুদ শরীফ বলেন, ভুমি ব্যাবস্থাপনা ম্যানুয়ালে কর সংক্রান্ত নিতিমালা থাকলেও ভুমি ব্যবহার নিতিমালা নেই। এই কারনে যার জমি সে যে কোনভাবে ব্যবহার করতে পারে এত আইনগতভাবে বাধা দেওয়ার এখতিয়ার নেই। তবে অবাধে বিলের জমিতে বসতি স্থাপনসহ বিভিন্ন ভাবে কমে যাওয়ার বিষয়টি তিনি সরকারকে অবগত করবেন। এবং এই বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করে।

আগামী দিনের খাদ্য নিরাপত্তায়, পরিবেশ ও ফসলি জমি রক্ষায় অপরিকল্পিতভাবে কৃষি জমি দখল করে বসতি স্থাপন রোধে কার্যকর ব্যাবস্থা গ্রহন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন এলাকার সচেতন মহল।