English Version
আপডেট : ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৯:২৬

১১ হাজার কোটি টাকা সরকারি আমানতের বোঝায় আরো নাজুক বেসিক ব্যাংক

অনলাইন ডেস্ক
১১ হাজার কোটি টাকা সরকারি আমানতের বোঝায় আরো নাজুক বেসিক ব্যাংক

সুদ খাত যেকোনো ব্যাংকের আয়ের প্রধান উৎস। যদিও বহুদিন ধরে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে বেসিক ব্যাংকের বিপদের কারণ। গত সাত বছরে সুদ খাতে ১ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে ব্যাংকটি। এ লোকসান ও বিপর্যয়কে আরো বাড়িয়ে তুলছে উচ্চসুদের সরকারি আমানত। এর পরও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে উচ্চসুদের আমানত এনে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে ব্যাংকটি।

বর্তমানে বেসিক ব্যাংকের আমানত প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। এ আমানতের ৮৫ শতাংশই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর। ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড ৮ দশমিক ১২ শতাংশ। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তে এক বছর আগেই ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছে ব্যাংকটি। ১ শতাংশেরও কম স্প্রেড ব্যাংকটির সংকটকে আরো বেশি নাজুক করে তুলছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ভাবমূর্তি সংকটের কারণে সাধারণ মানুষ এখন বেসিক ব্যাংকে আমানত রাখতে চায় না। একই দৃষ্টিভঙ্গি বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোরও। এজন্য বাধ্য হয়ে আমানতের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেই ধরনা দিতে হয়। সুযোগ বুঝে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারাও আমানতের উচ্চসুদ দাবি করছেন। সরকার মেয়াদি আমানতের সর্বোচ্চ সুদ ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে দিলেও বেসিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে এটি মানা হচ্ছে না। কোনো কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সাড়ে ৭ থেকে ৮ শতাংশ সুদেও আমানত সংগ্রহ করতে হচ্ছে।

পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে ৪৫৬ কোটি টাকা সুদ আদায় করে বেসিক ব্যাংক। যদিও একই সময়ে আমানতের বিপরীতে ৮৭৭ কোটি টাকা সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ব্যাংকটিকে। ফলে গত বছর শুধু সুদ খাতে বেসিক ব্যাংকের লোকসান ছিল ৪২০ কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথমার্ধে সুদ খাতের এ লোকসান আরো বড় হয়েছে। ২০১৯ সালেও সুদ খাতে ২৩৮ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছিল বেসিক ব্যাংক। এর আগে খাতটিতে ২০১৮ সালে ১২৫ কোটি টাকা, ২০১৭ সালে ১৮ কোটি, ২০১৬ সালে ১০৫ কোটি, ২০১৫ সালে ৩১৪ কোটি ও ২০১৪ সালে ১৩৯ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে ব্যাংকটি। সব মিলিয়ে গত সাত বছরে শুধু সুদ খাতে ১ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে বেসিক ব্যাংক। এর সঙ্গে পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয় যুক্ত হয়ে দিনে দিনে আরো নাজুক অবস্থানে চলে যাচ্ছে বেসিক ব্যাংক।

উচ্চসুদের আমানতকেই এ মুহূর্তে বেসিক ব্যাংকের জন্য সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে দেখছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আনিসুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেকের বেশি খেলাপি হওয়ায় বেসিক ব্যাংকের সুদ খাত লোকসানে। আবার এ ব্যাংকের আমানতের গড় সুদও ৮ শতাংশের বেশি। বর্তমান বাজারে এ পরিমাণ কস্ট অব ফান্ড দিয়ে কোনো ব্যাংকের পক্ষেই টিকে থাকা সম্ভব নয়। স্বল্প সুদের সরকারি আমানত সংগ্রহের জন্য গত তিন মাসে আমি অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত কোনো সাড়া আমি পাইনি। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোই আমানতের জন্য এ ব্যাংকের কাছে ৭ শতাংশের বেশি সুদ দাবি করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বেসিক ব্যাংকের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়।

সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ১০ হাজার কোটি টাকার আমানত চাইবেন বলে জানান আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, বেসিক ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড ৮ শতাংশের বেশি। অথচ সরকারের নির্দেশনা হলো সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করতে হবে। মাত্র ১ শতাংশের কম স্প্রেড দিয়ে কোনো ব্যাংকের পক্ষে মুনাফা করা সম্ভব নয়। বেসিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে এটি কল্পনা করাও বৃথা। খেলাপি ঋণ রাতারাতি কমিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। তবে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে এ ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড কমিয়ে দিতে পারে। নামমাত্র সুদে সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের আমানত পায়। ওই চারটি ব্যাংকেই বর্তমানে অলস তারল্যের পাহাড় জমেছে। সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক যদি স্বল্প সুদে বেসিক ব্যাংককে ১০ হাজার কোটি টাকার আমানত দেয়, তাহলে আমরা বেশি সুদের আমানত ছেড়ে দিতে পারতাম। আমানতের সুদহার কমানো ছাড়া এ মুহূর্তে আমাদের কাছে বিকল্প কোনো পথ নেই।

বেসিক ব্যাংকের কাছে বর্তমানে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট আমানতের পরিমাণ ১১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। এ আমানতের মধ্যে ৭ হাজার ৮৪ কোটি টাকা ঢাকায়। বাকি ৪ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেসিক ব্যাংকের শাখাগুলোয় জমা রয়েছে। বেসিক ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি আমানত জমা রয়েছে সরকারি খাতের বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি কোম্পানিগুলোর। এর মধ্যে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ৬৭০ কোটি টাকা, কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানির ৪৪০ কোটি, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির ২৫০ কোটি, গ্যাস সঞ্চালন কোম্পানির ৩৫৫ কোটি, রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের ২৭৮ কোটি, বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমের ২৬০ কোটি, তিতাস গ্যাসের ২৯০ কোটি, পেট্রোবাংলার ২২০ কোটি, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ২০৬ কোটি, পদ্মা অয়েলের ২০০ কোটি, জালালাবাদ গ্যাসের ৬৫ কোটি টাকার আমানত রয়েছে বেসিক ব্যাংকে। এছাড়া বেসিক ব্যাংকে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিসিআইসির ৪০১ কোটি, রাজউকের ৬৫১ কোটি, বিআরডিবি, বিএডিসি, বেপজা, বিআইডব্লিউটিসি, বিআইডব্লিউটিএসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, স্বায়ত্তশাসিত ও আধাস্বায়ত্তশাসিত সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত রয়েছে। এসব আমানতের বিপরীতে সাড়ে ৬ থেকে ৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

বাংলাদেশ স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কমার্স (বেসিক) ব্যাংক লিমিটেডের যাত্রা ১৯৮৯ সালে। প্রতিষ্ঠার পরের দুই দশক দেশের সেরা ব্যাংক হিসেবেই বিকাশ হয়েছিল বেসিক ব্যাংকের। ২০০৯ সাল পর্যন্ত বেসিক ব্যাংককে তুলনা করা হয়েছে বৈশ্বিক জায়েন্ট স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের সঙ্গে। কিন্তু ২০০৯ সাল-পরবর্তী সময়ে লুটপাটের শিকার হয়ে দেউলিয়া হওয়ার দুয়ারে দাঁড়িয়েছে ব্যাংকটি। লুণ্ঠনের শিকার হওয়ার পর গত আট বছরে বেসিক ব্যাংক নিট লোকসান দিয়েছে ৩ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। এ সময়ে ব্যাংকটিকে বাঁচিয়ে রাখতে রাজস্ব থেকে ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিয়েছে সরকার। তার পরও প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে ব্যাংকটি। পাশাপাশি ৩ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা সঞ্চিতি ঘাটতিও রয়েছে বেসিক ব্যাংকের। জুন শেষে বেসিক ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। এ ঋণের মধ্যে ৭ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা বা ৫৩ দশমিক ৯৬ শতাংশই ছিল খেলাপির খাতায়। খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ মন্দমানের হওয়ায় আদায়ের সম্ভাবনাও ক্ষীণ।