English Version
আপডেট : ১৪ আগস্ট, ২০২১ ১০:৩৭

ধরাছোঁয়ার বাইরে সেই সিন্ডিকেট

অনলাইন ডেস্ক
ধরাছোঁয়ার বাইরে সেই সিন্ডিকেট

হরহামেশা কারসাজি করে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এর নেপথ্যে রয়েছে একাধিক সিন্ডিকেট। চক্রটি বেআইনিভাবে পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট থেকে প্রতি বছর হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলেও বাস্তবে সেটি হচ্ছে না। ফলে ওই অসাধু চক্র পণ্যকে টার্গেট করছে, বাড়াচ্ছে দাম। আর সিন্ডিকেটের ফাঁদে পড়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন ভোক্তারা। বাড়তি দরে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিত্যপণ্য নিয়ে গড়ে উঠা সিন্ডিকেট একই সময় চাল থেকে শুরু করে ডাল, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, শাক-সবজি, চিনি, মসলা নিয়ে কারসাজি করছে। এমনকি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ থেকে শুরু করে অক্সিজেন, ইনজেকশন, কম্পিউটার সামগ্রীসহ মুখরোচক খাবারেও রয়েছে তাদের লম্বা হাত। এসব পণ্যের যখন উৎপাদন কম হয় এবং চাহিদা ও সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে, সেক্ষেত্রে অসাধুরা অহেতুক দাম বাড়িয়ে দেয়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেই বাড়তি দাম অব্যাহত থাকে। ওই সময়ের মধ্যে ভোক্তার পকেট কেটে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। বছরের পর বছর এ অপকর্ম চললেও রহস্যজনক কারণে সরকারের সংশ্লিষ্টরা একরকম নির্বিকার। মাঠপর্যায়ে কয়েকজনকে নামমাত্র জরিমানা করে দায়সারা গোছের দায়িত্ব সম্পন্ন করেন তারা। অধরা থেকে যায় সিন্ডিকেটের মূল নায়করা।

২০১৯ সালে ভারতে পেঁয়াজের উৎপাদন কম হলে অসাধুরা সিন্ডিকেট করে জুলাই থেকে দেশে এই পণ্যের দাম বাড়াতে থাকে। আগস্টে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে বাংলাদেশে এ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটির দাম লাগাম ছাড়া হয়ে ওঠে। অক্টোবর পর্যন্ত দাম বাড়তে বাড়তে ৩০ টাকা কেজি পেঁয়াজ সর্বোচ্চ ৩২০ টাকায় বিক্রি হয়। ওই সময়ে ভোক্তার পকেট থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। তবে কনসাস কনজ্যুমারস সোসাইটির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সিন্ডিকেট ভোক্তার পকেট থেকে তখন প্রায় ৩ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

এছাড়া প্রতি বছরই ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলে এবং জুলাই থেকে আগস্টে চালের দাম বাড়ানো হয়। চলতি বছরে চালের দাম বাড়িয়ে ১৩ মে থেকে ২৫ জুন এ ৪৯ দিনে ভোক্তার পকেট থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন চালের পাশাপাশি অসাধুরা আটার দামও বাড়াতে শুরু করেছে। পাশাপাশি করোনাকালে প্রয়োজনীয় ওষুধের চাহিদা বাড়ায় অসাধুরা দামও বাড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি শাক-সবজির দামও চড়া। কাঁচা মরিচ খুচরা বাজারে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা।

এছাড়া প্রতি বছর রোজার মাসকে কেন্দ্র করে চিনি, ছোলা, শসা, বেগুনের দাম হয় আকাশচুম্বী। কোরবানির ঈদ ও শীতে বাড়ে মসলার দাম। এভাবে একটির পর একটি পণ্যকে টার্গেট করে দাম বাড়ানো হয়। এভাবে প্রায় পুরো বছরই সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পরেও কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ানো হয়।

এ বিষয় সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সি একাধিকবার বলেছেন, পণ্যমূল্য বাড়ানোর নেপথ্যে সিন্ডিকেট জড়িত। অযৌক্তিকভাবে পণ্যের দাম বাড়ানোর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চালের দাম বাড়ার বিষয়ও খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার একাধিকবার সিন্ডিকেটের কারসাজির কথা বলেছেন। জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। তারপরও কোনো সিন্ডিকেট সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যার কারণে ধানের বাম্পার ফলনের পরও চাল বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে মোবাইল কোর্ট ও নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের আইনের আওতায় সামান্য জরিমানা ও হাতেগোনা কয়েকজনের সপ্তাহখানেকের জেল দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, ২০২০ সালে পণ্যমূল্য বাড়লে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) থেকে একটি তদন্ত হয়েছে। দেশের বড় বড় বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোতে পরিচালিত ওই তদন্তে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে কারা জড়িত তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে অভিযোগ- পণ্যমূল্য নিয়ে কারা কারসাজি করে তাদের সব তথ্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে রয়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেটগুলো প্রভাবশালী হওয়ার কারণেই মূলত তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। তবে আলোচিত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সদিচ্ছার অভাব ও আইনি দুর্বলতাকে দায়ী করেছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার ব্যাপারে স্থায়ী নীতিমালা দরকার।

এটির প্রচার করে যেমন সবাইকে জানাতে হবে, তেমনি ভোক্তা ও বিক্রেতা দুপক্ষকেই সচেতন করতে হবে। ব্যত্যয় ঘটলে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। জানতে চাইলে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, অসাধুরা যে কোনো অজুহাতে ভোক্তার পকেট কাটে। সুযোগ পেলেই সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে অতি মুনাফা করতে চায়।

তাছাড়া অনেক সময় পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি থাকলেও পণ্যের দাম বাড়ে। তবে অসাধু পন্থায় দাম বাড়ালেও দৃষ্টান্তমূলক কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। যার কারণে অসাধুরা বারবার একই পন্থায় ভোক্তার পকেট কাটে। তাই সংশ্লিষ্টদের এখনই কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। অসাধুদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এতে ভোক্তার উপকার হবে। কারণ এখন করোনাকালে সবার আয় কমেছে। তাই ব্যয় বেশি হলে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাছাড়া যে সব পণ্য আমদানি করা হয়, তা আগেভাগে আমদানি করে রাখলে পণ্য নিয়ে অসাধুরা কারসাজি করতে পারবে না।

সূত্র জানায়, পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের একাধিক সংস্থা রয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই), স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় প্রশাসন। কোনো পণ্যের দাম অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে গেলে এসব প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করে। পরিচালনা করে মোবাইল কোর্ট। এর মাধ্যমে খুচরা বা পাইকারি ব্যবসায়ীদের সপ্তাহখানেকের জন্য জেল ও লাখ টাকার জরিমানা করে। এর বাইরে কোনো শাস্তি দেয় না। প্রচলিত আইনেও এর বেশি শাস্তি দেওয়ার বিধান নেই।

এছাড়া নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর রয়েছে আলাদা আইন। এগুলো হচ্ছে- কৃষি বিপণন আইন, নিরাপদ খাদ্য আইন, ওজন ও পরিমাপ মানদণ্ড আইন, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন আইন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ভোজ্যতেলে ভিটামিন এ সমৃদ্ধকরণ আইন, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন, শিল্প এলাকায় রাসায়নিক পণ্য আইন, পশু জবাই ও মাংসের মান নিয়ন্ত্রণ আইন।

সূত্র জানায়, পণ্যমূল্য তদারকি করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে ঢাকা শহরে ৩২টি মোবাইল টিম রয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর প্রতিদিন নিত্যপ্রয়োজনীয় ৩৭টি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। এগুলোর বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা মাঠপর্যায়ে তদারকি করে। কিন্তু জনবলের অভাবে সব বাজারে সব সময় তদারকি করা সম্ভব হয় না। ফলে অনেকেই বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি করে। এ প্রসঙ্গে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ যুগান্তরকে বলেন, পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে মোবাইল কোর্ট ও বিভিন্ন সংস্থার আইনের আওতায় তদারকি করা হয়। এর বাইরে গিয়ে কিছু করার সুযোগ সংস্থাগুলোর হাতে নেই। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি জরিপ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটি হলে পণ্যের চাহিদা, উৎপাদন, আমদানি ইত্যাদি তথ্য বিশ্লেষণ করে পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে।

জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (উপ-সচিব) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার যুগান্তরকে বলেন, অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নির্দেশে প্রতিদিন বাজার তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। কোনো অনিয়ম পেলেই সঙ্গে সঙ্গে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তাছাড়া সিন্ডিকেট ভাঙতে মিল পর্যায় থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তিনি জানান, যেখানেই অনিয়ম পাব সেখানেই ভোক্তা আইনের মধ্যে এনে অভিযুক্তদের শাস্তি ব্যবস্থা করা হবে, যাতে ভোক্তারা তাদের নিজ অধিকার নিয়ে পণ্য ক্রয় করতে পারেন।