লকডাউনে এবারও কেন ছাড় পাবে না ক্রেডিট কার্ডধারীরা

বেসরকারি একটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক আনোয়ার হোসেন। থাকেন মিরপুর শেওড়াপাড়া এলাকায়।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধে মার্চ মাসের বিল পরিশোধের জন্য বেরিয়ে বাড়ির পাশে ব্যাংকটির শাখা বন্ধ পান। অগত্যা বিল পরিশোধ না করে বাসায় ফেরেন।
লকডাউনের মধ্যে ব্যাংক খোলা থাকলেও সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতি দুই কিলোমিটারের মধ্যে একটি শাখাই খোলা। আর আনোয়ার হোসেনের পক্ষে অন্য একটি শাখায় যাওয়া সম্ভব ছিল না।
১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউনের আগে যখন ৫ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত প্রথমবারের মতো লকডাউন দেয়া হয়, সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেডিটকার্ডধারীদের বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছিল।
তবে সেই সময় যাতায়াতে এতটা কড়াকড়ি ছিল না, যেটা এখন করা হয়েছে। তবু এবার কার্ডের বিল পরিশোধ নিয়ে কোনো ধরনের নির্দেশনা জারি না হওয়ায় সময়মতো বিল পরিশোধ করতে না পারা গ্রাহকের ঘাড়ে চাপতে যাচ্ছে জরিমানা ও সুদের বোঝা।
আনোয়ার হোসেন বলেন,‘কিছুদিন আগের লকডাউনে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ দিয়েছিল কেউ বিল না দিলেও জরিমানা বা বাড়তি কোনো চার্জ লাগবে না। কিন্তু এবার কেন সেই সুবিধা দেয়া হয়নি, সেটা বুঝতে পারলাম না।’
যারা অনলাইন ব্যাংকিংয়ে লেনদেন করেন, তারা একই ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করলে বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে ঝামেলায় পড়েননি। কিন্তু তিনি অন্য কোনো ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানের কার্ড ব্যবহার করলে অনলাইনে বিল পরিশোধ করতে পারছেন না। গত বুধবার থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে আইটি বিপর্যয়ের কারণে অনলাইনে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তরের বিএফটিএন সুবিধা বন্ধ আছে।
ক্রেডিট কার্ডের বিল সময়মতো দিতে না পারলে জরিমানার পাশাপাশি অনেক বেশি হারে সুদ দিতে হয়। ব্যাংকে সুদহার ৯ শতাংশ হলেও কার্ডের সুদ ২০ শতাংশ পর্যন্ত আছে।
বাংলাদেশে গত এক দশকে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। এখন এই কার্ডধারীর সংখ্যা ১৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আর প্রতি মাসে লেনদেন এখন ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
করোনাকালে নগদ অর্থের বদলে কার্ডে ইলেকট্রনিক উপায়ে টাকা পরিশোধের চল আরও বেড়েছে। এখন পাড়া-মহল্লায় বড় মুদির দোকানেও কার্ডে কেনাকাটা করা যায়।
একাধিক ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকরা বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে চলমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকের সব শাখা খোলা নেই। বাইরে চলাফেরায় বিধিনিষেধ থাকায় তারা সঠিক সময়ে বিল জমা দিতে পারছেন না। কিন্তু ক্রেডিট কার্ডে যথাসময়ে বিল পরিশোধ না করলে সুদের খড়্গ আছে। কারণ, ব্যাংকগুলো সরল সুদ ও বিলম্ব ফি আরোপ করে।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে আয় কমে গেছে। কোম্পানি বন্ধ থাকার কারণে লোকসান গুনতে হবে। সামনে অবস্থা আরও খারাপ হবে কি না, বুঝতে পারছি না। সংসার চালাতে গত মাসে ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা ঋণ নিয়েছি। এই মুহূর্তে কিস্তি দেয়া সম্ভব নয়। বিলম্ব ফি ও চক্রবৃদ্ধি সুদ আরোপ হলে আর্থিক সংকটে পড়তে হবে।’
এর আগে ক্রেডিট কার্ডে বাড়তি কোনো চার্জ না নেয়ার জন্য ৪ এপ্রিল সার্কুলার জারি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
এতে বলা হয়, লকডাউনে বিল পরিশোধের সীমা পেরিয়ে গেলে কোনো প্রকার লেট পেমেন্ট ফি আরোপ করতে পারবে না ব্যাংক। পূর্ববর্তী মাসের বিলের সুদের ওপর নতুন কোনো সুদ আরোপ করা যাবে না। বিলের সময় পার হয়ে গেলে কেবল মূল অঙ্কের টাকার ওপর সুদ আরোপ করা যাবে।
ওই সময়ে যাদের বিল দেয়ার সময় শেষ হওয়ার কথা, তাদের জরিমানা ছাড়া বিল পরিশোধে আরও পাঁচ কার্যদিবস সময় দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
৫ এপ্রিল সোমবার থেকে এক সপ্তাহের লকডাউন শুরুর আগের দিন রোববার এই নির্দেশ দেয়া হয়।
ওই নির্দেশনায় প্রযুক্তিভিত্তিক লেনদেনের সীমাও কিছুটা বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। যেসব কার্ড দিয়ে কেনাকাটার সময় কার্ডটি দূর থেকে ধরেই লেনদেন করা যায়, সে ধরনের কার্ডের প্রতিটি লেনদেনের ব্যয়সীমা ৩ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ হাজার টাকা করা হয়।
মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এর আগে ক্রেডিট কার্ড নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা শতভাগ পরিপালন করা হয়েছে। কোনো গ্রাহক কিস্তি না দেয়ার কারণে ঋণসীমা অতিক্রম করলেও বাড়তি চার্জ আরোপ করা হয়নি। কিন্তু সেই সার্কুলারের সময়সীমা পার হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন করে কোনো নির্দেশনা জারিও করেনি। ফলে এখন আগের নিয়মে গ্রাহককে ক্রেডিট কার্ডের বিল শোধ করতে হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৭ সালে ব্যাংকগুলোর ক্রেডিট কার্ড পরিচালনা-সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করে। ওই নীতিমালায় অন্য যেকোনো ঋণের তুলনায় ক্রেডিট কার্ডে ব্যাংক সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ বেশি সুদ নিতে পারবে বলে জানানো হয়।
২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া অন্য সব ঋণে সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মানে ক্রেডিট কার্ডে সর্বোচ্চ সুদ হওয়ার কথা ১৪ শতাংশ। তবে এই নির্দেশনাও অমান্য করে অনেক ব্যাংকই বিভিন্নভাবে এর চেয়ে বেশি টাকা আদায় করত।
ফলে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে কোনো ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডে ২০ শতাংশের বেশি সুদ নিতে পারবে না বলে নতুন নির্দেশনা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটি ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়।
এতে আরও বলা হয়, ক্রেডিট কার্ডে সুদ আরোপ শুরু হবে ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত সময়ের পর। বর্তমানে ব্যাংকগুলো ৪৫ দিন পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেয়।
আর ক্রেডিট কার্ডে ঋণসীমার বিপরীতে ৫০ শতাংশের বেশি নগদ উত্তোলন করা যাবে না।
ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কেনাকাটায় ৪৫ দিন পর্যন্ত বিনা সুদে বিল পরিশোধের সুযোগ থাকে। অর্থাৎ প্রতি ৩০ দিনের খরচের ওপর বিল তৈরি করে ওই বিল পরিশোধের জন্য ১৫ দিন সময় দেয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে বিল পরিশোধ করলে কোনো সুদ আরোপ করা হয় না। আর এই সময় পার হয়ে গেলে ওই বিলের ওপর সরল হারে সুদ আরোপ করে ব্যাংক। বিল পরিশোধে বিলম্ব হলে এই সুদহার চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে।
করোনা দুর্যোগে লকডাউন পরিস্থিতিতেও ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকদের এই জরিমানার মুখে ঠেলে দেয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বক্তব্য জানতে পারেনি নিউজবাংলা। মুখপাত্র সিরাজুল ইসলামকে দিনের বিভিন্ন সময় কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।