English Version
আপডেট : ৪ মার্চ, ২০২০ ১৭:৩৭
সূত্র:

ব্যাংকের ২৬৪ কোটি টাকা দেনা রেখে নব্য পোশাক ব্যবসায়ী উধাও

ব্যাংকের ২৬৪ কোটি টাকা দেনা রেখে নব্য পোশাক ব্যবসায়ী উধাও

চট্টগ্রামের নব্য পোশাক ব্যবসায়ী নাজমুল আবেদিন। এক সময় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের কর্মী ছিলেন। অনিয়মের অভিযোগে চাকরিচ্যুত হয়ে পাড়ি জমান লন্ডন। বছর চারেক আগে দেশে ফিরে পোশাক খাতের ব্যবসায়ী হিসেবে নাম লেখান চট্টগ্রাম ইপিজেডে। এরপর কাঁচামাল আমদানির এলসি ও পরিচালন মূলধন হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেন ঋণ সুবিধা। কিন্তু সেই ঋণের অর্থ পরিশোধ না করে আবারো পালিয়ে গেছেন বিদেশে।

বর্তমানে নাজমুল আবেদিন ও তার পরিবারের মালিকানাধীন তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে ২৬৪ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে ব্যাংকের। চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেয়া এ ঋণের অবস্থা এখন ভালো নয়। খেলাপি ঋণে পরিণত হওয়ায় এরই মধ্যে অর্থঋণ মামলা দায়ের করেছে একটি পাওনাদার ব্যাংক। কিন্তু ঋণগ্রহীতা দেশে না ফেরায় আইনি পদক্ষেপের পরও এ পাওনা আদায় হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা। কারণ এ ঋণের বিপরীতে কোনো ব্যাংকের কাছে  কোন সিকিউরিটি জমা নেই।

নাজমুল আবেদিনের যে তিন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে ব্যাংকগুলো বিপাকে পড়েছে, সে প্রতিষ্ঠান তিনটি হচ্ছে চট্টগ্রাম ইপিজেডের পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান এঅ্যান্ডবি আউটওয়্যার লিমিটেড, নর্ম আউটফিট লিমিটেড ও কোল্ড প্লে লিমিটেড। প্রতিষ্ঠান তিনটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাজমুল আবেদিন। এর মধ্যে নর্ম আউটফিট লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবে তার শ্বশুর জাহিদ হোসেন সিদ্দীকি ও পরিচালক হিসেবে তার স্ত্রীর নাম রয়েছে পাওনাদার ব্যাংকের নথিতে।

সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর তথ্যমতে, নাজমুল আবেদিনের তিন পোশাক কারখানার মধ্যে এঅ্যান্ডবি আউট ওয়্যারের কাছে ব্র্যাক ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১০২ কোটি টাকা, একই প্রতিষ্ঠানের কাছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের ৬০ কোটি, নর্ম আউটফিটের কাছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার প্রায় ৭০ কোটি ও ওয়ান ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ৩২ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে।

ব্র্যাক ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা থেকে গত তিন বছরের বিভিন্ন সময়ে কাঁচামাল আমদানিতে এলসি ঋণ সুবিধা গ্রহণ করে এঅ্যান্ডবি আউটওয়্যার। প্রথমদিকে প্রতিষ্ঠানটির লেনদেন ভালো ছিল। কিন্তু গত এক বছর ধরে যথাসময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছে না তারা। এ ঋণ আদায়ে ব্যাংকটির কর্মকর্তারা নানা চেষ্টা-তদবির করলেও কোনোভাবেই এ অর্থ পরিশোধ করছেন না নাজমুল আবেদিন। এমনকি তিন ব্যাংকের সঙ্গে কোনো যোগাযোগও রক্ষা করছেন না। উপায় না দেখে ১০১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা পাওনা আদায়ে গত ৫ ফেব্রুয়ারি অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করেছে ব্যাংকটি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্র্যাক ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, এ-টাইপের (শতভাগ বিদেশী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান) রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় কোনো সিকিউরিটি ছাড়াই সহজে ঋণ সুবিধা পেয়েছে এঅ্যান্ডবি আউটওয়্যার। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার দেশে না ফেরায় এবং একই মালিকের তিন কারখানার উৎপাদন স্বাভাবিক না থাকায় ব্যাংকের বিনিয়োগ করা ঋণ আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

এঅ্যান্ডবি আউটওয়্যারের কাছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের পাওনার পরিমাণ ৬০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহক ছিল ইস্টার্ন ব্যাংকের। পরে সে ঋণটি অধিগ্রহণ করে মার্কেন্টাইল ব্যাংক। মেয়াদি ঋণ হিসেবে ব্যাংকটির অফশোর ইউনিট থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণটি কিনে নেয়া হয়েছিল। অধিগ্রহণের পরবর্তী দুই বছর প্রতিষ্ঠানটির ঋণ নিয়মিতই ছিল। কিন্তু তারপর থেকেই ধীরে ধীরে রফতানি আদেশ কমতে থাকে। শেষ পর্যন্ত পুরো ঋণটিই আটকে গেছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের।

এ প্রসঙ্গে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) মতিউল হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ইস্টার্ন ব্যাংকের মতো ভালো ব্যাংকের গ্রাহক হিসেবে আমরা ঋণটি অধিগ্রহণ করেছিলাম। যদিও এ অধিগ্রহণের ফল সুখকর হয়নি। শুনেছি নাজমুল আবেদিন লন্ডনে চলে গেছেন। সেখান থেকে চিঠি পাঠিয়ে ঋণ পরিশোধের জন্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।

এদিকে ওয়ান ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, নাজমুল আবেদিনের দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা ছিল ওয়ান ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসার মান খারাপ হওয়ায় এঅ্যান্ডবি আউটওয়্যারের ঋণটি সমন্বয় করে নেন তিনি, যেটি ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সমন্বয় করা হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। তবে নর্ম আউটফিটের কাছে বিতরণ করা ৩২ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে এখন ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। কারণ ঋণটি এরই মধ্যে শ্রেণীকৃত হয়ে পড়েছে। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, ঋণ পরিশোধের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

নাজমুল আবেদিন প্রতারণা করেছেন এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের সঙ্গেও। তার প্রতিষ্ঠানের ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্র খুলেছিল ব্যাংকটি। সময়মতো দেশ থেকে পণ্য রফতানিও হয়েছিল। কিন্তু জাল কাগজপত্র তৈরি করে রফতানিপণ্য তিনি নিজেই ছাড়িয়ে নিয়েছেন। যদিও ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করেননি। এজন্য এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পক্ষ থেকে নাজমুলের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে প্রতারণার মামলা করা হয়েছে।

এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, শ্বশুরের নামে কোম্পানি খুলে নাজমুল আবেদিন জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। প্রতারণার উদ্দেশ্যেই ওই গ্রাহক কোম্পানি খুলেছেন। শেষ পর্যন্ত প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে লন্ডন চলে গেছেন। ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে এনআরবিসি ব্যাংক আরো সতর্ক হতে পারত। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদের একাধিক সদস্যের তদবিরেই ঋণপত্র খুলতে হয়েছিল। এক্ষেত্রে ব্যাংকারদের খুব বেশি কিছু করার ছিল না।

সিইপিজেড এলাকার বিভিন্ন কারখানা মালিক ও পাওনাদার ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারখানার উৎপাদন বৃদ্ধি বা ব্যবসায় মুনাফা নয়, নাজমুল আবেদিনের মূল টার্গেট ছিল ব্যাংক থেকে ঋণ হাতিয়ে নেয়া। সেই চিন্তা থেকে ব্যাংকগুলো প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তা কিংবা পরিচালকদের ম্যানেজ করে সহজ শর্তে বড় অংকের ঋণ সুবিধা পেয়েছেন। এ ঋণের বেশির ভাগ টাকায় ব্যবসায় বিনিয়োগের পরিবর্তে কাঁচামাল আমদানিসহ বিভিন্ন পন্থায় বিদেশে পাচার করেছেন। গত তিন মাস ধরে তিনি আর দেশে ফিরছেন না।

উল্লেখ্য, নাজমুল আবেদিনের বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে চট্টগ্রামের অভিজাত আবাসিক এলাকা খুলশীর ৬ নম্বর রোডের বে গ্রিন ভ্যালি। আর লন্ডনের ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে সি/ও-২২ রাদারফ্রুড ক্লোজ, অক্সব্রিজ-ইউবি ৮৩ ডব্লিউজি, লন্ডন, ইউকে।

এদিকে নাজমুল আবেদিনের তিনটি কারখানার ১ হাজার ৭০০ শ্রমিকের বেতন বকেয়া হয়ে পড়েছে চার মাস ধরে। বকেয়া বেতনের দাবিতে গত ১১ ফেব্রুয়ারি শ্রমিকরা সিইপিজেড এলাকায় বিক্ষোভ করে। মজুরির দাবিতে এর মধ্যে এঅ্যান্ডবি আউটওয়্যারের জিএম কমার্শিয়ালকে মারধরের ঘটনাও ঘটেছে।

এ বিষয়ে সিইপিজেডের জেনারেল ম্যানেজার মো. খোরশিদ আলম বণিক বার্তাকে বলেন, গত কয়েক মাস ধরে প্রতিষ্ঠান তিনটির অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। শ্রমিকদের বেতন বকেয়াসহ প্রতিষ্ঠান তিনটির উৎপাদনও অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠান তিনটি রান করতে না পারলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নাজুমল আবেদিনের প্রতিষ্ঠান তিনটির বর্তমান অবস্থা এবং পোশাক খাতের নব্য ব্যবসায়ী হয়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ২৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ হাতিয়ে নেয়ার বিষয়ে এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম শাখার যুগ্ম পরিচালক রেজাউল করিম বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছেন।