English Version
আপডেট : ২২ ডিসেম্বর, ২০১৯ ১২:৪৮
সূত্র:

বেসিক কোনো কাজ নেই বেসিক ব্যাংকের

বেসিক কোনো কাজ নেই বেসিক ব্যাংকের

আমানত সংগ্রহ, ঋণ বিতরণ ও আদায় সর্বোপরি ঋণপত্র (এলসি) খোলাই ব্যাংকের মৌলিক কাজ। যদিও এ কাজগুলো কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে লুণ্ঠনের শিকার বেসিক ব্যাংকের। বিশ্বের কোনো ব্যাংকই এখন বেসিক ব্যাংকের এলসি খুলতে রাজি হচ্ছে না। ব্যাংকটির সঙ্গে লেনদেন আছে—এমন গ্রাহকদের সন্দেহের চোখে দেখে দেশের অন্য ব্যাংকগুলোও। এজন্য ভালো গ্রাহকরা বেসিক ব্যাংক থেকে বিদায় নিচ্ছেন।

ব্যাংকের মৌলিক কাজ না থাকায় মাস শেষে কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ ও লোকসানের হিসাব কষাতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে ব্যাংকটির কর্মকাণ্ড। কোনো উদ্যোগেই কমছে না ব্যাংকটির খেলাপি ঋণও। প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়ে ধুঁকছে ব্যাংকটি। টানা ছয় বছর ধরে ৩ হাজার ১৫ কোটি টাকা নিট লোকসান দেয়া বেসিক ব্যাংক চলতি বছরও বড় অংকের লোকসান গুনতে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লুণ্ঠনের শিকার বেসিক ব্যাংক সংস্কারে সরকারের গৃহীত উদ্যোগ গতানুগতিক। ব্যাংকটিকে মূলধন পুনর্ভরণ বাবদ এরই মধ্যে সরকার ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা দিয়েছে। এ পরিমাণ টাকা দিয়ে দেশের অন্তত আটটি নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স পাওয়া যেত। কিন্তু এ টাকাও শেষ হয়ে গেছে বেসিক ব্যাংকের। এ অবস্থায় বেসিক ব্যাংকের বিলুপ্তি বা অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণেই সমাধান দেখছেন তারা।

তবে বিলুপ্তি বা একীভূতকরণ নয়, বরং বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির কাছে বিক্রির পক্ষে মত আলাউদ্দিন এ মাজিদের। নজিরবিহীন লুটপাটের পর ব্যাংকটিকে টেনে তুলতে ২০১৪ সালে তাকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়েছিল সরকার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বেসিক ব্যাংকের বর্তমান অবস্থার দায়ভার সরকারের। এজন্য সরকারকেই ব্যাংকটিকে টেনে তুলতে হবে। গতানুগতিক পদক্ষেপে বেসিক ব্যাংককে ঠিক করা যাবে না। সরকার অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করে তার মাধ্যমে ব্যাংকের খেলাপি ঋণগুলো কিনে নিক। অন্তত একটি সূচক ভালো হলে বেসিক ব্যাংক বিপর্যয় কাটাতে পারবে।

২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর নেতৃত্বে লুটপাটের শিকার হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক। তারপর থেকে কোনোভাবেই বিপর্যয় সামাল দিতে পারছে না ব্যাংকটি। বিতরণকৃত ঋণের ৬০ শতাংশ তথা প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকাই খেলাপি ঋণ, প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা করে মূলধন ও সঞ্চিতি ঘাটতি নিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। গত ছয় বছরে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান দেয়া বেসিক ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতি আরো বাড়ছে। খুইয়ে ফেলা মূলধন জোগান দিতে বেসিক ব্যাংককে সরকার এরই মধ্যে ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা দিয়েছে। এর পরও সরকারের কাছে আরো ৪ হাজার কোটি টাকা চেয়ে আবেদন করেছে বেসিক ব্যাংক। অথচ স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে আদর্শ ও অভিজাত ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃত ছিল ব্যাংকটি।

স্বর্ণালি সময়ে বেসিক ব্যাংকের এমডি হিসেবে দীর্ঘ সময় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন বর্তমান চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মাজিদ। তার মতে, এক সময় বেসিক ব্যাংকের এলসি নেয়ার জন্য বিদেশী ব্যাংকগুলো আমাদের পেছনে ঘুরত। এখন কোনো ব্যাংকই বেসিক ব্যাংকের এলসি নিচ্ছে না। এজন্য ভালো ও বড় গ্রাহকরা এ ব্যাংক ছেড়ে চলে গেছে। যেসব গ্রাহককে আমরা প্রজেক্ট ঋণ দিচ্ছি, তাদের কিছু পণ্য বেসিক ব্যাংকের মাধ্যমে রফতানি হয়। তবে এজন্য তৃতীয় কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলতে হচ্ছে। এতে বেসিক ব্যাংকের খুব বেশি লাভ হচ্ছে না। অন্য ব্যাংকগুলোও পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে।

আলাউদ্দিন এ মাজিদের আক্ষেপের সত্যতা পাওয়া যায় ব্যাংকটির গ্রাহকদের বক্তব্যে। এক সময় বেসিক ব্যাংকের নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন, বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতের এমন একাধিক শিল্প উদ্যোক্তা বলেন, বেসিক ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুললে বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক ও ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান কালো তালিকাভুক্ত করছিল। সময়মতো এলসি দায় মেটানোর সক্ষমতাও ব্যাংকটির নেই। বেসিক ব্যাংকের গ্রাহক পরিচয়ের কারণেই অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে। এজন্য ব্যাংকটি থেকে নিজেকে দূরে রাখার নীতি গ্রহণ করেছি।

খেলাপি ঋণের বোঝা, প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতির মতো মৌলিক সূচকগুলোর খারাপ পরিস্থিতির কারণেই অন্য দেশের ব্যাংকগুলো বেসিক ব্যাংকের এলসি নিচ্ছে না বলে জানান আলাউদ্দিন এ মাজিদ। তিনি বলেন, এত খারাপ মৌলিক সূচকের ব্যাংকের সঙ্গে অন্য দেশের ব্যাংক লেনদেন করবে না এটিই স্বাভাবিক। এজন্যই এলসি খোলা বন্ধ রয়েছে। তবে আমানত সংগ্রহ ও সীমিত পরিসরে ঋণদান কার্যক্রম চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেসিক ব্যাংকে ব্যক্তি আমানত বেড়েছে।

তবে এতটা খারাপ পরিস্থিতিতে বেসিক ব্যাংককে বাঁচিয়ে রাখার কোনো কারণ দেখছেন না বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, দেউলিয়া প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া ঘোষণা করা উচিত। বিশ্বের কোনো সভ্য দেশে এ ধরনের ব্যাংককে বাঁচিয়ে রাখা হয় না। বেসিক ব্যাংককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মৌলিক কোনো সংস্কারও আমরা দেখিনি।

প্রায় একই অভিমত ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞ মামুন রশীদের। তিনি বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাত সংস্কার নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে, কিন্তু কোনো উদ্যোগ দেখছি না। রুগ্ণ ব্যাংকিং খাত নিয়ে অর্থনীতি সামনে এগোবে না। বেসিক ব্যাংকের যে পরিস্থিতি, তাতে এটিকে উন্নতি করা যাবে তারও সম্ভাবনা নেই।

১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেড বা বেসিক নামে যাত্রা করা ব্যাংকটির সাফল্য ছিল গর্ব করার মতো। সরকারি ব্যবস্থাপনায়ও বাণিজ্যিক ব্যাংক ভালো করতে পারে এর উদাহরণ ছিল বেসিক ব্যাংক। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে শুরু হয় ব্যাংকটির বিপর্যয়। ওই বছরের ডিসেম্বর শেষেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল বিতরণকৃত ঋণের মাত্র ৪ শতাংশ। এরপর থেকেই দ্রুত অবনমন ঘটতে থাকে বেসিক ব্যাংকের। ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে বাড়তে থাকে খেলাপি ঋণ। এর বিপরীতে কমতে থাকে মুনাফার অংক। ২০১৩ সালে এসে প্রথমবারের মতো লোকসানে পড়ে ব্যাংকটি। এরপর লোকসানের পাল্লা কেবল ভারীই হয়েছে বেসিক ব্যাংকের। টানা ছয় বছর বেসিক ব্যাংক নিট লোকসান দিয়েছে ৩ হাজার ১৫ কোটি টাকা। চলতি বছর বেসিক ব্যাংকের লোকসান ৫০০ কোটি টাকা ছাড়াবে বলে জানা গেছে।

চলতি বছরের জুন শেষে বেসিক ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণ ছিল ১৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৯ হাজার ১১৩ কোটি টাকার ঋণ, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৬০ শতাংশের বেশি। একই সময়ে বেসিক ব্যাংক ৪৪৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে।

বেসিক ব্যাংকের শাখা সংখ্যা ৭২টি। ব্যাংকটিতে কর্মরত কর্মীর সংখ্যাও ২ হাজার ১০০। মৌলিক কাজ না থাকায় বিশাল এ কর্মী বাহিনীর বড় অংশই অলস সময় কাটাচ্ছে। আমানত সংগ্রহ, বিভিন্ন সেবা সংস্থার বিল ও ফি জমা নেয়া, কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা পরিশোধ ও সেবা প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে ব্যাংকটির কার্যক্রম। খেলাপি হওয়া ঋণ আদায়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই কর্মীদের।

বেসিক ব্যাংকের বিপর্যয়ের শুরু ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর হাতে। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ৬ জুলাই পর্যন্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ওই সময়েই ঘটে বড় অংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা। সে সময় বেসিক ব্যাংকের এমডির দায়িত্বে ছিলেন কাজী ফখরুল ইসলাম। বেসিক ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আবদুল হাই বাচ্চু চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেয়ার পর ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ১৪১ কোটি টাকা, যা সে সময় পর্যন্ত বিতরণকৃত ঋণের ৪ শতাংশ। এরপর থেকেই বাড়তে থাকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ৬০ শতাংশ ছাড়িয়েছে।