ব্যাংক আমানত সংকটে, মুদ্রানীতিতে তাই বড় পরিবর্তন আসছে না

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। যদিও ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে এর অনেক নিচে— মাত্র ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। নতুন সরকার আসার পর দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি কিছুটা সম্প্রসারণমূলক হবে বলে প্রত্যাশা ছিল সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু ব্যাংকগুলো আমানত সংকটে থাকায় বড় কোনো পরিবর্তন আসছে না নতুন মুদ্রানীতিতে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অপরিবর্তিত রেখেই ২০১৮-১৯ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা হচ্ছে আজ। এতে পরিবর্তন আসছে না নীতি সুদহারেও।
আজ বেলা সাড়ে ১১টায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম সম্মেলন কক্ষে গভর্নর ফজলে কবির এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন। ডেপুটি গভর্নর, প্রধান অর্থনীতিবিদসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত থাকবেন।
মুদ্রানীতি প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা অপরিবর্তিত রেখেই দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে অপরিবর্তিত থাকছে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা। এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১৬ দশমিক ৮ শতাংশই রাখা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতির অনেক লক্ষ্যই অর্জিত হয়নি। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। অন্যদিকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোয় আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়নি। এ অবস্থায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে না। কারণ ব্যাংকের কাছে আমানত না থাকলে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা নেই। আবার ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমানো হলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পরিস্থিতি বিবেচনায় মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রাগুলো অপরিবর্তিত রাখার নীতিতে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগযোগ্য আমানত রয়েছে ৮১ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা। এ আমানতের অর্ধেকের বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর হাতে। ২০১৮ সালের অক্টোবর শেষে এ ব্যাংকগুলোর হাতে বিনিয়োগযোগ্য আমানত ছিল ৪৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা। একই সময়ে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর হাতে মাত্র ২০ হাজার ৯১৩ কোটি টাকার বিনিয়োগযোগ্য আমানত ছিল। অর্থাৎ গড়ে একটি বেসরকারি ব্যাংকের হাতে ৫০০ কোটি টাকার আমানতও নেই। নির্বাচন ঘিরে অক্টোবর-পরবর্তী তিন মাসে ব্যাংকগুলো থেকে বড় অংকের আমানত তুলে নিয়েছেন গ্রাহকরা। এতে ব্যাংকিং খাতে আমানত সংকট আরো তীব্র হয়েছে।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকগুলোর হাতে বিনিয়োগযোগ্য পর্যাপ্ত আমানত নেই। এডি রেশিও (ঋণ ও আমানতের অনুপাত) সমন্বয় করার জন্য ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদহারে আমানত সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ফলে বছরের প্রথমার্ধে মুদ্রানীতির ঘোষিত বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। এ অবস্থায় ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বাড়ালে সেটি পূরণের সম্ভাবনা নেই। মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল করতে হলে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমাতে হবে। একই সঙ্গে সম্প্রসারিত করতে হবে বন্ড মার্কেট। এতে মুদ্রাবাজার ও পুঁজিবাজার উভয়ই স্থিতিশীল থাকবে।
বেসরকারি খাতে না বাড়লেও ব্যাংকঋণে সরকারি চাহিদা বাড়ায় এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা বাড়ানো হবে বলে জানা গেছে। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। এটি দশমিক ১ থেকে দশমিক ২ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানো হতে পারে। তবে বাজেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অপরিবর্তিত থাকছে। অপরিবর্তিত থাকছে নীতি সুদহারসহ অন্যান্য বিষয়ও।
তবে বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় যথাযথ মুদ্রানীতিই ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, মুদ্রানীতি প্রণয়নের আগে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সাবেক গভর্নর, ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈঠক করেছে। সবার পরামর্শ নিয়েই মুদ্রানীতির উপকরণগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্বাচনী বছর হওয়ায় অর্থবছরের প্রথমার্ধে মুদ্রানীতির কিছু লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। আশা করছি, নতুন সরকারের মেয়াদে নতুন মুদ্রানীতি কার্যকর ও ফলপ্রসূ হবে।
প্রতি বছর মুদ্রানীতি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায় পুঁজিবাজারে। একই পরিস্থিতি এবারো। কয়েকদিন ধরেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মুদ্রানীতি নিয়ে আগ্রহ কাজ করছে। নতুন মুদ্রানীতি বাজারবান্ধব হবে কিনা, এটি জানার জন্য অপেক্ষা করছেন তারা।
মুদ্রানীতির সঙ্গে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরে মুদ্রানীতি ঘোষণার পর পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে দেখা গেছে। এ অবস্থায় নতুন মুদ্রানীতিতে দেশের পুঁজিবাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীরা আশাব্যঞ্জক বক্তব্য প্রত্যাশা করেন। জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই সূচকের উন্নতি হচ্ছে। সরকার ও নতুন অর্থমন্ত্রী প্রাণোদ্দীপ্ত পুঁজিবাজার প্রত্যাশা করে। ব্যাংকগুলোর এডি রেশিও সমন্বয় নিয়ে মানি মার্কেটে অস্থিরতা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব অস্থিরতা নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি অর্থবছর দুই দফায় মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। জাতীয় বাজেট ঘোষণার পর এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়। প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয়। ডিসেম্বরের পর মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের অবস্থা পর্যালোচনা এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে সংযোজন-বিয়োজন আনা হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি বিদায়ী বছরের ৩১ জুলাই ঘোষণা করা হয়েছিল।
অর্থবছরের প্রথমার্ধের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাজারে ব্যাপক মুদ্রার (ব্রড মানি) জোগানে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১০ দশমিক ২ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে অর্জিত হয়েছে ৪ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। আগামী জুন পর্যন্ত ব্যাপক মুদ্রার জোগানে ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে।
বিদায়ী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ। এর বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আগামী জুন পর্যন্ত এ হার ১৫ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত করার কথা রয়েছে।
চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। ওই সময় পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে মাত্র ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ১৪ শতাংশ। অর্থবছরের বাকি সময়ে এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে আছে কৃষিঋণ বিতরণও। এজন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে গভর্নর ফজলে কবিরের বক্তব্যে কৃষিঋণ বাড়াতে ব্যাংকগুলোর প্রতি তাগিদ দেয়া হবে। একই সঙ্গে তাগিদ আসবে এসএমইসহ উৎপাদনমুখী শিল্পে ঋণপ্রবাহ বাড়ানো ও ভোগ-বিলাস ঋণের লাগাম টানার। খেলাপি ঋণের হার ও পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্যও ব্যাংকগুলোর প্রতি গভর্নরের নির্দেশনা থাকবে বলে জানা গেছে।