জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছেই, বিপদ দেখছে বিপিডিবি

যুক্তরাষ্ট্রে শেল অয়েলের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞাও উৎপাদন সংকোচনের পরিস্থিতি তৈরি করছে। এর বিপরীতে চীন-ভারতের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোয় জ্বালানি তেলের চাহিদা অব্যাহতভাবে বাড়ছে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠছে জ্বালানি তেলের দাম। অক্টোবরের শুরুর দিকেই প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ৮৬ ডলারে উঠেছিল। আগামী বছরের শেষ নাগাদ তা ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দিচ্ছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের অব্যাহত এ দাম বৃদ্ধিতে বিপদ দেখেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। কারণ দেশের মোট বিদ্যুতের প্রায় ৩৩ শতাংশ (ক্যাপটিভ বাদে) আসে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে। ডিজেলচালিত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জ্বালানি তেলের দামও পরিশোধ করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটিই। এসব কেন্দ্রে ব্যবহূত জ্বালানি তেলের বাড়তি দাম পরিশোধে আরো চাপে পড়বে বিপিডিবি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে আর্থিকভাবে এমনিতেই ন্যুব্জ হয়ে আছে বিপিডিবি। ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিপিডিবির লোকসানের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আর্থিক সংকটের কারণে বেসরকারি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে নির্ধারিত সময়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে তা অবশ্যই চিন্তার বিষয় বলে জানান বিপিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এতে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ওই দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে গ্রাহককে দিতে গেলে বিপিডিবির ওপর আর্থিক চাপ বাড়বে। সেক্ষেত্রে সরকারের কাছ থেকে বাজেটারি সাপোর্ট বা ভর্তুকির বাড়তি চাহিদা তৈরি হবে।
২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারের উপরে ছিল। পরবর্তী সময়ে তা কমতে থাকে এবং ২০১৬ সালের শুরুর দিকে ব্যারেলপ্রতি ৩০ ডলারের নিচে নেমে আসে। গত বছরের নভেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম আবার বাড়তে শুরু করে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের অন্যতম জোগানদাতা ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে শেল অয়েলের উৎপাদন কমে যাওয়া এ দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। উৎপাদন কমিয়ে পণ্যটির দাম বাড়াতে চাইছে জ্বালানি তেল রফতানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেকও। এরই মধ্যে এর ফলাফলও দেখা যাচ্ছে। গত অক্টোবরেই প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ৯০ ডলারের কাছাকাছি চলে যায়।
ব্লুমবার্গ ও দি ইকোনমি ফোরকাস্ট এজেন্সির প্রতিবেদন বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের এ দরবৃদ্ধি আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। ২০১৯ সাল শেষ নাগাদ তা ১১৮ ডলারে পৌঁছে যেতে পারে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইআইএ) মনে করছে, ২০১৯ সালে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম বর্তমানের চেয়ে গড়ে দেড় থেকে ২ ডলার বাড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে শেল অয়েল ও ওপেকভুক্ত দেশগুলোয় উৎপাদন বাড়লেই কেবল জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি এ পর্যায়ে থাকবে বলে জানিয়েছে তারা। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে শেল অয়েলের উৎপাদন এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের অব্যাহত দাম বৃদ্ধি বিপিডিবির আর্থিক চাপ আরো বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এ পরিস্থিতি থেকে বিপিডিবিকে বাঁচাতে হলে সরকারকে হয়তো ভর্তুকির পরিমাণ এখনকার দ্বিগুণ করতে হবে। তা না হলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। আর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অন্যান্য খাত, সর্বোপরি দেশের অর্থনীতির ওপর।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, পৃথিবীর কোথাও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সম্পর্ক নেই। অনেক আগেই এসব দেশ জ্বালানি তেল ও বিদ্যুৎকে আলাদা করে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন জ্বালানি তেলের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের দামও বেড়ে যায়, অর্থনীতির জন্য যা ঝুঁকিপূর্ণ।
বিপিডিবি সূত্রে জানা যায়, ক্যাপটিভ পাওয়ারসহ (৩৪০০ মেগাওয়াট) দেশে বর্তমানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০ হাজার ৪৩০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে দৈনিক সাড়ে ১০ হাজার থেকে ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে বর্তমানে প্রাকৃতিক গ্যাস, ফার্নেস ও ডিজেল অয়েল, হাইড্রো এবং কয়লা— এ চার ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন হচ্ছে ৩৩ শতাংশ বিদ্যুৎ, যার উৎপাদন ব্যয় গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের চেয়ে অনেক বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে গ্যাসভিত্তিক প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ক্রয়ে পিডিবির ব্যয় হয়েছে মাত্র ২ টাকা ২০ পয়সা থেকে ২ টাকা ৫৩ পয়সা। যদিও একই সময়ে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ক্রয়ের বিপরীতে পিডিবির গড় ব্যয় হয়েছে ১১ টাকা ২৩ পয়সা। আর ডিজেলভিত্তিক প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খরচ হয়েছে গড়ে ২৭ টাকা ২৭ পয়সা, যা গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতের চেয়ে চার গুণ থেকে ১২ গুণ পর্যন্ত বেশি।