English Version
আপডেট : ৯ অক্টোবর, ২০১৮ ১১:৩৮

নির্বাচনী বছরে টাকা পাচার বাড়ছে

অনলাইন ডেস্ক
নির্বাচনী বছরে টাকা পাচার বাড়ছে

দেশে বেসরকারি বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে, অথচ ব্যাংকের ঋণ বিতরণ বাড়ছে। একইভাবে বেপরোয়া গতিতে বাড়ছে আমদানি ব্যয়। আর এটিই রহস্যজনক। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত এই আমদানির নাম করে দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে দুর্নীতির টাকা সরানোর হিড়িক পড়ে গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানির নামে বিদেশে পাচার হচ্ছে টাকা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টেও এমন তথ্য উঠে এসেছে। টাকা পাচারের মূল কারণ আস্থাহীনতা এবং নতুন করে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যারা ক্ষমতার সীমাহীন অপব্যবহার ও দুর্নীতি করে রাতারাতি বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন, তারা ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তায় দুর্নীতির টাকা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন।

এ ছাড়া নির্বাচনী বছরে এ রকম নানা ভয়ে অনেকে টাকা বিদেশে পাচার করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, বিদায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রফতানি ও রেমিটেন্স (প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ) মিলিয়ে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে এসেছে, অফিশিয়াল হিসাবেই আমদানি তার চেয়ে অনেক বেশি।

সংকট নিরসনে অর্থ পাচার ঠেকাতে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। এ ক্ষেত্রে এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংস্থাগুলোকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ তাদের। জানা গেছে, বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির হার যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। গেল অর্থবছরে দেশে আমদানি ব্যয় ছিল ৫৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু রফতানি আয় ছিল ৩৬ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন রেমিটেন্স এসেছে ১৪ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার।

আর রফতানি এবং রেমিটেন্স মিলিয়ে ৫১ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে রফতানি ও রেমিটেন্স মিলিয়েও আমদানি ব্যয়ের চেয়ে ২ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার কম। অর্থাৎ দেশে যে হারে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, দেশ থেকে বিদেশে যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি। এটি অস্বাভাবিক। গত ১০ বছরেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি।

এব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের আমদানি ব্যয় যেভাবে বাড়ছে, তা স্বাভাবিক নয়। এখানে টাকা পাচারের যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। তার মতে, নির্বাচনী বছরে টাকা পাচার বাড়ে। কারণ, যাদের কাছে উদ্বৃত্ত টাকা আছে, তারা দেশে রাখাকে নিরাপদ মনে করেন না। সম্পদশালীরা মনে করেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হলে তাদের জন্য সমস্যা হতে পারে।

এ কারণে আমদানিসহ অন্যান্য মাধ্যমে পুঁজি পাচার করা হয়। তিনি বলেন, এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর পাচার রোধে তৎপরতা বাড়াতে হবে।

অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে বিদেশে বাংলাদেশিদের টাকা পাচারের তথ্য চলে এসেছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) রিপোর্ট অনুসারে গত দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ বছরে পাচার হয়েছে ৭৪ হাজার কোটি টাকা।

পাচারের তথ্য এসেছে সুইস ব্যাংকের রিপোর্ট, পানামা ও প্যারাডাইজ পেপারসে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশি কয়েকটি গ্রুপের কানাডা ও সিঙ্গাপুরে বিশাল অঙ্কের সম্পদের তথ্যও যথেষ্ট উদ্বেগজনক।

টাকা পাচারের জন্য সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়কে দায়ী করছে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। এর মধ্যে রয়েছে- বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা, পাচারকারীদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও প্রভাবশালী মহলের নিবিড় সম্পৃক্ততা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর নজরদারির অভাব, দেশে পুঁজি নিরাপত্তার অভাব এবং বেপরোয়া দুর্নীতি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণা অনুসারে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে কয়েকটি পদ্ধতিতে টাকা পাচার হয়।

এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে বেপরোয়া পদ্ধতিতে টাকা বিদেশে যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ট্রাংকে ভরে সরাসরি ডলার নিয়ে যায় প্রভাবশালী মহল। আমদানির নামে এলসি খুলে বিল পরিশোধ করছে, কিন্তু কোনো পণ্যই দেশে আসছে না। বড় অঙ্কের অর্থ পাচারে সাম্প্রতিক সময়ে এটিই অন্যতম পন্থা। এ ছাড়া আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রফতানি মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং) এবং হুন্ডির মতো পুরনো পদ্ধতিগুলো তো আছেই।

সম্প্রতি টাকা পাচারের আরও একটি বড় মাধ্যম হয়ে দেখা দিয়েছে রেমিটেন্স। বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় প্রবাসীদের রেমিটেন্স একটি চক্র সংগ্রহ করে তা বিদেশেই রেখে দেয়। আর এ দেশে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকায় এর দায় শোধ করা হয়। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপ অনুযায়ী এ প্রক্রিয়ায় প্রায় ৪০ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না। ওইগুলোও পাচার হয়ে বিদেশের কোনো না কোনো ব্যাংকে রাখা হচ্ছে।

এব্যাপারে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশের ভেতরে অস্থিতিশীলতার কারণে নির্বাচনকালীন সময় টাকা পাচার বাড়ে। আর পাচার বন্ধের ব্যাপারে সরকারের কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আছে বলে মনে হয় না। এ ধরনের সিদ্ধান্ত থাকলে পানামা পেপারস এবং প্যারাডাইজ পেপারসে যাদের নাম আছে, তাদেরকে ধরে এনে শাস্তি দেয়া হতো।

তিনি বলেন, পত্রিকায় নাম-ঠিকানাসহ বিস্তারিত ছাপা হয়েছে। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রীয় সংস্থা এত লোকজনের বিরুদ্ধে খোঁজখবর নেয়, কিন্তু পাচারকারীদের খোঁজখবর নেয় না। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না থাকলে এনবিআর যতই বাহ্যিক তৎপরতার কথা বলুক, তাতে কোনো লাভ হবে না। তিনি বলেন, টাকা পাচার রোধে নির্বাচনের আগে কিছু করবে বা কোনো পদক্ষেপ নেবে বলে মনে হয় না।

কিন্তু অন্তত এতটুকু আশা করছি, নির্বাচনী ইশতেহারে দলগুলো বলবে, আমরা অবৈধভাবে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে যথোপযুক্ত, দৃশ্যমান ও কার্যকর উদ্যোগ নেব।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৮ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ প্রায় ৮৯ হাজার কোটি টাকা। অবলোপন মিলিয়ে তা ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এ ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এই ঋণের বড় অংশই বিদেশে পাচার করা হয়েছে।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছে ৯৬ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৯৯ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। এ হিসাবে আলোচ্য বছরে বিনিয়োগ নিবন্ধন কমেছে। একইভাবে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিদেশি ও যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগের নিবন্ধন হয়েছে ৯৩২ কোটি ডলার। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ১ হাজার ৩৭৭ কোটি ডলার। এ হিসাবে বিদেশি বিনিয়োগও কমেছে।

আর এই পরিমাণ নিবন্ধন হলেও বাস্তবতা আরও করুন। নিবন্ধনের পর প্রকৃত বিনিয়োগ একেবারে কম। চার বছরে মোট দেশজ উৎপাদন, প্রবৃদ্ধি বেড়েছে প্রায় দেড় শতাংশ। এই হিসাবে বিনিয়োগ বাড়ার কথা ৬ শতাংশের মতো। কিন্তু বেড়েছে আড়াই শতাংশের কম। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বিনিয়োগের সঙ্গে প্রবৃদ্ধি সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

এ প্রসঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তিন কারণে বিদেশে টাকা পাচার হতে পারে। প্রথমত, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে কিছু লোক বিদেশে টাকা নিতে পারে। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত কালো টাকা পাচার হতে পারে। এ ছাড়াও বিনিয়োগ মন্দার কারণেও ব্যবসায়ীদের টাকা বিদেশে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, কারণ যাই হোক, টাকা পাচার হওয়া দেশের জন্য সুখবর নয়।

সরকারের দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে- টাকা ফিরিয়ে আনা এবং জড়িতদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন, এনবিআর এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকে একযোগে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।